বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ত্রিশালে একদিন ...

সুমন্ত গুপ্ত
  ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

ঝিক ঝিক ছন্দে ট্রেন এগিয়ে চলছে এয়ারপোর্ট স্টেশন পেরিয়ে। দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌঁছলাম ময়মনসিংহ স্টেশনে আমাদের ট্রেন থেকে নামিয়ে দিয়ে ট্রেন ছুটে চললো তার পরবর্তী গন্তব্য দেওয়ানগঞ্জের দিকে। আমরা ট্রেন থেকে নেমে রিকশা ঠিক করলাম ত্রিশাল বাস স্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য। আমাদের ব্যাটারিচালিত রিকশা তুফানের গতিতে এগিয়ে চলছে আর আমি উপভোগ করছি ময়মনসিংহ শহরকে বেশ ঘিঞ্জি শহর অফিস খোলার দিন থাকায় রাস্তায় বেশ জ্যাম। গাঙ্গিনার পাড়, সি কে ঘোষ রোড, সেহড়া ঢাকা রোড দিয়ে এগিয়ে চলছি। ত্রিশাল বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে আমরা পদ্মা গেট লক সার্ভিসের বাসে উঠলাম প্রায় ২০ মিনিট পর বাস আমাদের বইলর নামক স্থানে নামিয়ে দিল। এর পর বাস থেকে নেমে আমরা ব্যাটারিচালিত অটো করে পৌঁছে গেলাম আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য দারোগা বাড়িতে। গেট পেরিয়ে আমরা ভেতরে প্রবেশ করে দেখি নজরুল স্মৃতি কেন্দ্রে তালা ঝুলছে সঙ্গে সঙ্গে হাতের ঘড়ি দেখি তখন মাত্র বারোটা বাজে আর কোনো বন্ধ বার না যে বন্ধ থাকবে মনটা খুব খারাপ লাগছিল। অগত্যা আমরা আশপাশে ঘুরে দেখছিলাম। আর মনে মনে কোনো লোক পাওয়া যায় কিনা দেখছিলাম শেষ পর্যন্ত পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখা মিলল এক মানবের। তিনি বললেন, এই স্মৃতি কেন্দ্রের কেয়ারটেকার দিনের বেশির ভাগ সময়ই তালা মেরে ঘুমিয়ে থাকেন বুঝি আল আমিন বলে ডাক দেন, তিনি আসবেন আমরা চিৎকার করে ডাকা শুরু করলাম কোনো সাড়া-শব্দ নাই। আমরাও নাছোড়বান্দা শেষ পর্যন্ত ওই ভদ্রলোক একজনের মোবাইল নাম্বার দিলেন বললেন, তার সঙ্গে কথা বলেন ফোন দেওয়ার পর মোবাইলের ওপর পাশের লোককে বললাম আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। তিনিই বললেন আপনারা কিছু সময় অপেক্ষা করেন আমি লোক পাঠাচ্ছি। আমাদেরও দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভালো লাগছিল না, পরে সামনের চা স্টলে গিয়ে চা খেলাম। দেখা হলো ওই অঞ্চলের প্রবীণ ব্যক্তি রহিম সাহেবের সঙ্গে, তিনি বলছিলেন অনেকবছর পার হলেও ভবনটিতে প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকার কারণে ভবনের সার্বিক কাজে অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রায় আধা ঘণ্টার পর দেখা মিলল একজন আপা আসছেন তিনি-ই জিজ্ঞেস করলেন আপনারা কি ঢাকা থেকে এসেছেন, আমরা হঁ্যা বললাম, তিনি পরিচয় জানতে চাইলে বললেন ওনার নাম ইন্নি, তিনি কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি ডিপেস্নামাতে শেষ বর্ষের ছাত্রী, তিনিই আমাদের পুরো এলাকা ঘুরিয়ে দেখালেন। তিনি বলছিলেন, ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে জাতীয় কবির জন্মদিন উপলক্ষে প্রদত্ত বাণীতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালির স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার রূপকার। ১৯২৯ সালে ১৫ ডিসেম্বর কলকাতা আ্যালবার্ট হলে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে দেওয়া জাতীয় সংবর্ধনা সভায় প্রদত্ত মানপত্রের জবাবে নজরুল বলেছিলেন, সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা আমার ধর্ম। যে কুলে যে সমাজে যে ধর্মে যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি। নজরুলের এ ধরনের বলিষ্ঠ উচ্চারণ নিয়ে গবেষণার সহযোগী ক্ষেত্র এখন এই পাঠাগার। এখানে কবি নজরুল যে ঘরটিতে থাকতেন সেটি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। কবি তার কবিতা, গানে যে সব গাছের নাম উলেস্নখ করেছেন সেই গাছগুলো দিয়ে নজরুল স্মৃতি কেন্দ্রে ব্যতিক্রমধর্মী দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষ বাগান তৈরি করা হয়েছে। এখানে কবি যে পুকুরে গোসল করতেন সেটিও সংরক্ষণ করা আছে। বিলের পাড়ে একটি বটগাছের নিচে কবি নজরুল আপন মনে বাঁশিতে সুর তুলতেন। এটি এখন নজরুল বটবৃক্ষ। দুই বাংলার নজরুল ভক্তদের কাছে এটি তীর্থ স্থানের মর্যাদা পেয়েছে। বটের নিচে প্রায়ই বসে কবিদের আসর। আজ কবি নেই কিন্তু এই বটগাছটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে কবির অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। এখানকার মনোরম পরিবেশ পর্যটকদের মোহিত করবে। নিচ তলায় ময়মনসিংহ ত্রিশালে অবস্থানকালে যে খাটে ঘুমাতেন কবি সে খাটটি রয়েছে সঙ্গে মিলনায়তনে, দ্বিতীয় তলায় উঠে আমরা দেখা পেলাম কবির বিভিন্ন ধরনের ছবি যা যে কাউকেই মুগ্ধ করবে সঙ্গে লাইব্রেরি দেখা পেলাম প্রায় কয়েক হাজার বই আছে এই লাইব্রেরিতে এখানে যত্নসহকারে রয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের স্বহস্তে লিখিত বই, নজরুলের জীবন নিয়ে লেখা বই, নজরুলকে নিয়ে সমালোচনা করাসহ বিভিন্ন গানের রেকর্ড। কবি ওপর বই ছাড়া ও সমসাময়িক লেখকদের বইও আছে এখানে। এর পর আমরা গেলাম ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ডের পাশেই নজরুল একাডেমি। কবির স্মৃতিবিজড়িত দরিরামপুর হাই স্কুলই বর্তমানে নজরুল একাডেমি। এই স্কুলে কবি ৭ম ও ৮ম শ্রেণিতে লেখাপড়া করেছেন। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার খাতায় নজরুল লিখেছিলেন আমি এক পাড়াগাঁয়ে স্কুল-পালানো ছেলে, তার ওপর পেটে ডুবুরি নামিয়ে দিলেও 'ক' অক্ষর খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্কুলের হেডমাস্টারের চেহারা মনে করতেই আজও জলতেষ্টা পেয়ে যায়। কবির স্মৃতিকে ধরে রাখতে কবির সেই ক্লাসরুম ও দেয়ালে এই কবিতার লাইন খোদাই করে সংরক্ষণ করা আছে। স্কুল মাঠের পাশেই রয়েছে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নজরুল মঞ্চ ও শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত আধুনিক রেস্ট হাউস। দেখতে দেখতে আমাদের বিদায়ের সময় চলে এলো আমরা আবার ৫টা ২০-এর তিস্তা এক্সপ্রেস করে ফিরে গেলাম সেই চিরচেনা শহর পানে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<88695 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1