মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দূর নীলিমায়

নতুনধারা
  ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সুমন্ত গুপ্ত

ভোর ৫টা, হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যায় তুমুল বৃষ্টির শব্দে। ভেন্টিলেটর দিয়ে প্রবাহিত ঠান্ডা হাওয়ায় গরম কাপড় আরেকটু টেনে নিলাম, তাও যুবুথবু অবস্থা কাটছে না। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে আরও ঘুম পাচ্ছিল। হঠাৎ ঘড়ি ঘোষণা দিল আর শুয়ে থাকার সময় নেই, এখনই শয্যা ত্যাগ করতে হবে। সকাল ৭টা, আমরা গন্তব্য পানে যাত্রা শুরু করলাম দশজনের দল নিয়ে। আমাদের সঙ্গে আছেন ভোজনরসিক তপন দাদা। যাত্রা শুরুর পরপরই মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হলো আবার। গাড়িতে বসে বৃষ্টি দেখার মজাই আলাদা। আমাদের আরেক সঙ্গী হাসু, আসল নাম আবুল হাসনাত সাব্বির আহমেদ কোরেশী সায়েম। এত বড় নাম যে কেউ তাকে ওই নামে ডাকে না। সবাই হাসু বলেই ডাকে। গলা ছেড়ে গান গাওয়া শুরু করল তাও পুরনো দিনের গান। বেশ ভালো সময় পার করছিলাম আমরা। এদিকে বৃষ্টি ও কমে এলো, বৃষ্টির ফলে গাছপালা যেন নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সকালে কারোরই নাশতা করা হয় নাই, সবার পেটে খিদায় চো চো করছে। খাবারের দায়িত্বে তপনদা তখন নিশ্চুপ বসে আছেন। নাঈম ভাই আরেকটু হলে গাড়ি থেকে নেমেই যেতেন খাবারের সন্ধানে গাড়ি চলছে হঠাৎ করে তপনদা ঘোষণা দিলেন যে হরিপুর বাজারে গাড়ি থামাতে হবে, সেখানে আমাদের জন্য স্পেশাল সকালের নাশতা ব্যবস্থা করা হয়েছে। গাড়ি থামানো হলো হরিপুর বাজার থেকে একটু সামনে তপনদার কথামতো। কিন্তু খাবার দোকান দেখে সবার চোখ ছানাবড়া। মূল রাস্তা থেকে নিচে একটা খুপরি ঘর আর সঙ্গে দুটা টেবিল আর বেঞ্চ দেয়া। সবার চেহারা দেখে মনে হলো সবাই খুবই দুঃখিত। দাদা সবার অবস্থা বুঝতে পেরে সবাইকে বললেন আগে সবাই নাশতা করেন দেখেন কি খাবার আছে আপনাদের জন্য, খাবার একবার খেলে পরে বারবার খেতে ইচ্ছা করবে। আমরা দোকানে গিয়ে বসলাম দেখলাম একজন বৃদ্ধ মহিলা কি যেন রান্না করছিলেন আর বেশ সুন্দর গন্ধ বের হয়েছে। একটু পরে আমাদের টেবিলে খাবার এসে হাজির হলো। আমরা হোটেলের সামনে ডিপ টিউবওয়েলে হাত ধুয়ে বসে পড়লাম খেতে। চালের গুঁড়ার রুটি আর সঙ্গে মুরগির মাংস। প্রথমে একটু খারাপ লাগছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা নিয়ে পরে খাবার মুখে দিয়ে সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। অসাধারণ স্বাদ। দেশি মুরগির মাংস আর এতে ব্যবহার করা হয়েছে বাটা মসলা আমরা সাধারণত যারা শহুরে সবাই গুঁড়ো মসলার ওপর নির্ভরশীল কবে যে বাটা মসলার রান্না করা খাবার খেয়েছিলাম তা মনেই করতে পারব না। নাদিম ভাই প্রথমে নাক সিটকিয়ে ছিলেন পরে নিজেই যেচে রুটি আর মাংস নিয়ে খেলেন। আমাদের সকালের নাশতা শেষ করে আমরা রওনা দিলাম আমাদের গন্তব্যের দিকে। পথঘাট পেরিয়ে আমরা পৌঁছালাম সারিঘাট। সারিঘাটে এসে সবার মনোযোগ নদীর মনোলোভা দৃশ্য দেখতে। তপন দাদা বললেন, আমাদের এখন এক ঘণ্টার নৌকা ভ্রমণ আছে সবাই খুব খুশি শুধু পান্না আপা ছাড়া পান্না আপার আবার নদী ভীতি আছে যাই হোক অনেক বুঝিয়ে ওনাকে নৌকায় তোলা হলো। আমরা ভাসিয়ে দিলাম আমাদের তরী লালাখালের নীল জলে। আকাশ কিন্তু তখন কেঁদে চলেছে ঝিরিঝিরি। সারি নদী ও দুই ধারের রূপ-সৌন্দর্য দেখার জন্য আমরা নৌকার ছইয়ের ওপর উঠে বসলাম। এখন চারদিকে শুধু দু'চোখ ভরে দেখার পালা। চোখে পড়ছে দূরে মেঘালয়ের পাহাড়গুলো। সারি নদীর পান্না সবুজ পানি, বালু বোঝাই নৌকা, মাঝেমধ্যে গ্রামীণ মানুষের কর্মব্যস্ততা, নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবনযাত্রা সবই উপভোগ্য হবে লালাখাল যাত্রায়। নয়নাভিরাম এই জায়গাটি যে কারও মন ভরিয়ে দেবে। স্বচ্ছ রঙিন জলরাশি আর দুধারের অপরূপ সৌন্দর্য, নৌকা ভ্রমণ যে কোনো পর্যটকের কাছে আর্কষণীয়। তেমনি এক নির্জন মনকাড়া স্থান লালাখাল। কিছুদূর যাওয়ার ঘটল বিপত্তি আমাদের ইঞ্জিন নৌকার নষ্ট হয়ে গেল। সবাই ভয়ে অস্থির তপন দাদা সবাইকে অভয় দিলেন কিছু হবে না নৌকার মাঝি অনেক কষ্ট করে পাড়ে নিলেন নৌকা। আমরা নৌকা থেকে নেমে গেলাম আর মাঝি নৌকা ঠিক করতে লাগলেন। আমরা নদীর পাড়ের মানুষের জীবনধারা দেখতে লাগলাম। এটি আবার লালাখাল চা বাগানের একটি অংশ। এখানকার মানুষের জীবন খুব সাধারণ নাগরিকতার নষ্ট ছোঁয়া তাদের স্পর্শ করে নাই তাই তো আমাদের দেখেই তারা এগিয়ে এলো, বসতে দিল, চা খাওয়ালো তাও আবার মুড়ির মোয়া দিয়ে। আমাদের নৌকা ঠিক হওয়ার পর আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। প্রথমেই আমাদের নিয়ে নৌকা চলে এলো জিরো পয়েন্টে, যেখানে রয়েছে ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত চৌকি। একটা পাথর দেখিয়ে আমাদের নৌকার মাঝি বলল এটা সীমান্ত। আমরা নৌকা থেকে নেমে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু সীমান্ত আসলে ডানে, বামে না সোজা কোথায় শেষ হয়েছে বুঝতে পারি নাই আমরা। আমাদের একজন সোজা ছবি তুলতে তুলতে এগিয়ে গেল সামনে এবং সীমানা ক্রস করে ফেলল। আমরা তখনো বুঝি নাই, হঠাৎ দেখি ডান পাশের এক বাঁশঝাড় থেকে চারজন বিজিবি সদস্য এগিয়ে আসছে। এসে তো মহা ঝাড়ি, আমরা কারা, এখানে কেন এসেছি, পরিচয়পত্র দেখা ইত্যাদি হট্টগোল শুরু হলো। সব শেষে তারা বুঝতে পারল আমরা টুরিস্ট এবং না বুঝে সেখান পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। এরপর বিজিবি অফিসাররা আমাদের আশপাশে ঘুরিয়ে দেখালেন। আমরা ১৩০০ নাম্বার পিলারের দেখা পেলাম। সেখানে ছবি তুলে আমরা এলাম পরবর্তী গন্তব্য লালাখাল চা-বাগান। এই সেই সীমানা পাথর, বলেন এটা দেখে কীভাবে কেউ বুঝবে এটা দুই দেশের সীমান্ত চিহ্নিত করার পাথর তাই তো আমার ভ্রমণসঙ্গী ভদ্রলোক দেশ-কালের সীমানা অতিক্রম করে পাড়ি দিতে মগ্ন ওই দূরের মায়াবী পাহাড়ের পানে। তার ডান দিকে ছিল সেই বাঁশঝাড়। ওই ভদ্রলোকের আর কি দোষ বলেন? চোখের সামনে এমন মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি থাকলে কার বা হিতাহিত জ্ঞান থাকে বলেন? শতবর্ষী এই চা-বাগানের নিজস্ব একটা সৌন্দর্য রয়েছে। এর কাঁচা মাটির পথ ধরে ছোট-বড় টিলা আর তার মাঝে মেঘেদের ভেলায় ভেসে বেড়ানো যে কোনো সৌন্দর্যপিপাসুর জন্য স্পেশাল কিছু।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<66739 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1