শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঘুরে এলাম গর্ত বসতি অঞ্চলে

মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম
  ১৮ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

বহু দিন ধরে যাই যাই করেও যাওয়া হয়নি অনেক কাল। অথচ এর পাশের গ্রাম বটেশ্বর থেকেও লটকন মৌসুমে ঘুরে এসেছি। যানজটে দেরি হওয়ার কারণে সেবারও মিস। তবে এবার সুযোগ মিলে যাওয়ায় আর হাতছাড়া করিনি। মোক্ষম সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসতেই দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের চার বন্ধু ছুটি নরসিংদীর বেলাব উপজেলায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘর প্রতিষ্ঠাস্থল উয়ারী-বটেশ্বর গ্রাম। গাড়ি চলছে, খোশগল্পে সবাই মেতে আছি। চলতি পথে মাধবদির এক রেস্টুরেন্টে গরুভুনা আর মুগডাল দিয়ে উদরপূর্তি চলে। খাওয়া শেষে ঢু মারি ঐতিহ্যবাহী শেখেরচর হাটে। কি নেই এই হাটে। দেশের নানান প্রান্ত থেকে পসরা কিনতে আসা মানুষের মিলনমেলাও বেশ উপভোগ্য। যাপিতজীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনও ভ্রমণের অন্যতম অনুষঙ্গ। যাই এবার গরম গরম মিষ্টি খাই। খাওয়া শেষে চলছি সিলেট মহাসড়ক ধরে। মরজাল এসে মহাসড়ক ছেড়ে সরু পথে ঢুকে কিছুটা দূর যেতেই মনে হলো আমরা যেন যাচ্ছি অবারিত প্রকৃতির মায়াবীকূলে। মরজাল থেকে উয়ারী বটেশ্বর যেতে পথের দুই ধারে অসাধারণ সব প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতে ঠিক মধ্য বিকালেই পৌঁছে যাই উয়ারী বটেশ্বর গ্রামে। গাড়ি ছেড়ে এবার মেঠো পথে হাঁটা। ঘিরে রাখা প্রত্নতত্ত্ব স্থানে যাওয়ার আগেই চোখে পড়বে নানান খনন কার্যক্রম। উয়ারী ও বটেশ্বর নামক দুটো গ্রাম নিয়ে বিসৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর প্রাপ্তি স্থান। প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা এটি এক সময় মাটির নিচের দুর্গনগরী ছিল। বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুসারে এগুলো প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের পুরনো নিদর্শন। তবে ২০০০ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত কিছু প্রত্ন নিদর্শনের কার্বন ১৪ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে, উয়ারীর বসতি খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দের, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একদা খুব প্রসিদ্ধ ছিল এই নগর। প্রাপ্ত নিদর্শনের মাধ্যমে আন্দাজ করা যায় উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামের শাসকদের সঙ্গে রোমান সাম্রাজ্যের যোগাযোগ ছিল। প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা সব একমত যে, উয়ারী-বটেশ্বর শুধু নগরই ছিল না- এটা এক সময় ব্রহ্মপুত্র নদের কারণে প্রসিদ্ধ বাণিজ্য ও নৌ-বন্দরও ছিল। অথচ আজ কোথায় সেই সব শৌর্য-বীর্য। চারপাশ শুধুই নীরব। নেই কোনো কোলাহল। প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন পাওয়া না গেলে কোনোদিন জানাই যেত না, এটা একসময় প্রসিদ্ধনগর ছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই হারিয়ে যাই নস্টালজিয়ায়। ১৯৩০ দশকে স্কুল শিক্ষক মোহাম্মদ হানিফ পাঠান প্রথম উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামের প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের গুরুত্ব জনসমক্ষে তুলে ধরেন। পরে তার পুত্র মোহাম্মদ হাবিবুলস্নাহ পাঠান ওই স্থানের প্রত্ন বস্তু সংগ্রহ ও গবেষণার কাজ শুরু করেন। দীর্ঘ বছর পর ১৯৯৬ সালে উয়ারী-বটেশ্বরে প্রত্নতত্ত্ব জরিপের কাজ সম্পন্ন হয়। অতঃপর ২০০০ সাল থেকে নিয়মিতভাবে উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যক্রম শুরু হয়। খনন কার্যক্রমের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে ৬০০ মিটার আয়তনের চারটি মাটির দুর্গ-প্রাচীর। সেই দুর্গ-প্রাচীরের কিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশ এখনো কালের সাক্ষী হয়ে টিকে রয়েছে। উয়ারী-বটেশ্বর দুর্গ-প্রাচীরের কারিগররা উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গেও পরিচিত ছিল। তারা ধাতু গলিয়ে মুদ্রা তৈরি করতে পারত। এ ছাড়া উন্নতমানের দৃষ্টিনন্দন অলঙ্কারও বানাতে জানত। এখানকার অধিবাসীরা কৃষিজীবী ছিল। তাদের উৎপাদিত ফসল দিয়ে নগরের ধনিক, বণিক, পুরোহিত, কারিগর ও দুর্গ কর্মচারীদের চাহিদা মিটতো। উয়ারী-বটেশ্বরের মতো অনুরূপ আরেকটি দুর্গ-প্রাচীরনগর চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে ভারতের ইমামগাঁওয়ে। নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনা। দুর্গের বাইরেও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ ঘিরে আরও পঞ্চাশটির মতো প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। বৃষ্টিবহুল বাংলার গর্ত বসতি কতটুকু সম্ভব এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও ধারণা করে নেয়া হয়েছে যে, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ বা তারও কিছু আগে এ মহাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক ছিল। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলে আমরাও পস্নাইসটোসিন যুগের আদি নগর উয়ারী-বটেশ্বর পিছনে ফেলে বাতাসে মাত্রারিক্ত সিসা থাকা বর্তমান আধুনিক যুগের মহানগর ঢাকার পথে ছুটি।

তথ্যসূত্র: বাংলা পিডিয়া

যাতায়াত: ঢাকার সায়েদাবাদ ও মহাখালী থেকে বিভিন্ন পরিবহনের বাস ভৈরবের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সে সব বাসে চড়ে নরসিংদীর মরজাল বাস স্টপিজে নামতে হবে। ভাড়া পরিবহনভেদে জনপ্রতি ৬০-৬৫ টাকা। মরজাল থেকে অটোতে যেতে হবে উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নতত্ত্বস্থল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<62707 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1