শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
বেড়ানো

অতিথির আলয় ...

ইউরোপ, দূরপ্রাচ্য (যেমন সাইবেরিয়া) থেকেও এসব পাখি আসে। এরা কিছু সময় পর আবার ফিরে যায় নিজ দেশে।
সুমন্ত গুপ্ত
  ০৬ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

বিখ্যাত ইংরেজ কবি জিএল গৌল্ড ওয়ান্ডার থাস্টর্ কবিতায় বলেছেন, ফিরে আসব কোনদিন, কিন্তু যেতে আমাকে হবেই; আর যদি লোকে জিজ্ঞাসা করে কেন যাব, এসবের জন্য দোষ দিও তারাদের, সূযের্ক আর সাদা রাস্তা আর সুনীল আকাশকে। কবির মতো আমিও ডাক শুনি ঐ সুনীল আকাশে ঘুরে বেড়ানো ডানা মেলা পাখির। তাই বারবার তাদের ডাকে সাড়া দিতে ঘুরে বেড়াই দেশের আনাচে-কানাচে।

আমাদের আজকের গন্তব্য সিলেট শহরের খুব কাছে দক্ষিণ সুরমা নামক এলাকায়। উদ্দেশ্য শহরের ছায়াতে অতিথি পাখি দেখা। এই জায়গাটির সন্ধান দেন আমাদের ফটো সাংবাদিক বন্ধু ইউসুফ ভাইয়ের কাছ থেকে। ইউসুফ ভাইয়ের কথা অনুযায়ী সূযোর্দয় এর পরে হালকা নাশতা খেয়ে বেরিয়ে পড়ি সফর সঙ্গী আমার সব সময়ের বন্ধু আমার মা। ইতিপূবের্ অতিথি পাখি দেখেছি কিন্তু একদম শহুরে পরিবেশে অতিথি পাখি কখনো দেখিনি। তাই রওনা হলাম অতিথি পাখি দেখার জন্য। অতিথি পাখির অবস্থান থাকে সাধারণত বিলের দিকে কিন্তু প্রথমে কোনো বিলের দেখা পেলাম না তাই সেখানে একটি পাখিও নজরে পড়ল না। দীঘর্ সময় ধরে ঘুরলাম কিন্তু পাখির তো দেখা পাই না। আকাশে সূযের্র দেখা নেই আর আমাদের আকাশের বুকে অঁাধার নেমে আসছে, আর সম্ভব হলো না অতিথি পাখির সঙ্গে মোলাকাতের। আমরা মন খারাপ করে ঘুরে আসব ঠিক সেই সময় একটা ঝিলের দেখা পেলাম আর একটু সামনে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম উনিই রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। আমরা সামনে এগিয়ে পেলাম নথর্ ইস্ট মেডিকেল কলেজ। এরপর কলেজে ঢুকে পাখির কিচিরমিচির শুনছি কিন্তু পাখি তো দেখছি না পরে হঠাৎ দেখি অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে অতিথি পাখির ঝঁাক, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। অনেক সময় দঁাড়িয়ে রইলাম কাছে আসে কিনা। কিন্তু না কাছে আসা তো দূরের কথা আরও দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যেতে লাগল। সামনে এগিয়ে যেতেই পেলাম আমাদের শহুরে পরিবেশে সেই সুদূরের অতিথি পাখিদের। অতিথি পাখিদের মনমুগ্ধকর ডাক যে কারোরই মন ভরিয়ে দিতে পারে। বলে রাখা ভালো শীতকালে শীতের হাত থেকে বঁাচতে যে সব পাখি ওদের নিজ দেশের চেয়ে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলে চলে আসে, তাদের বলা হয় অতিথি পাখি বা পরিযায়ী পাখি। প্রতিবছর শীতকালে আমাদের দেশেও কিন্তু এরকম কিছু অতিথি পাখি আসে। ওরা আসে মূলত হিমালয়ের পাদদেশ আর রাশিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে। এই পাখিগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনই সুন্দর এদের গায়ের বাহারি রং। ওদের দেখলেই মন ভরে যায়। আমাদের দেশে মোট পাখি আছে প্রায় ৬২৮ প্রজাতির। এর মধ্যে ২৪৪ প্রজাতির পাখিই স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বাস করে না।

এরা আমাদের দেশের

পরিযায়ী পাখি বা অতিথি পাখি। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে এরা আমাদের দেশে আসতে শুরু করে। আর তারপর মাচর্ থেকে এপ্রিলের দিকে ওদের দেশে বরফ গলতে শুরু করলে ফিরে যেতে থাকে নিজেদের দেশে। আমাদের দেশে অতিথি পাখিরা অতটা পথ পাড়ি না দিলেও তারাও অনেক দূর থেকেই আসে। বরফ শুভ্র হিমালয় এবং হিমালয়ের ওপাশ থেকেই বেশির ভাগ অতিথি পাখির আগমন ঘটে। এসব পাখিরা হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত তিব্বতের লাদাখ থেকে সেন্ট্রাল এশিয়ান ইন্ডিয়ান ফ্লাইওয়ে দিয়ে প্রবেশ করে। এ ছাড়া ইউরোপ, দূরপ্রাচ্য (যেমন সাইবেরিয়া) থেকেও এসব পাখি আসে। এরা কিছু সময় পর আবার ফিরে যায় নিজ দেশে।

এ সব পাখির মধ্যে বাংলাদেশের অতি পরিচিতি অতিথি পাখি নদার্ন পিনটেইল। এ ছাড়া স্বচ্ছ পানির বালিহঁাস, খয়রা চকাচকি, কালির্উ, বুনোহঁাস, ছোট সারস পাখি, বড় সারস পাখি, হেরণ, নিশাচর হেরণ, ডুবুরি পাখি, কাদাখেঁাচা, গায়ক রেন পাখি, রাজসরালি, পাতিকুট, গ্যাডওয়াল, পিনটেইল, নরদাম সুবেলার, কমন পোচাডর্, বিলুপ্ত প্রায় প্যালাস ফিস ঈগল (বুলুয়া) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া নানা রং আর কণ্ঠ বৈচিত্র্যের পাখিদের মধ্যে রয়েছে ধূসর ও গোলাপি রাজহঁাস, বালিহঁাস, লেঞ্জা, চিতি, সরালি, পাতিহঁাস, বুটিহঁাস, বৈকাল, নীলশীর পিয়াং, চীনা, পান্তামুখি, রাঙামুড়ি, কালোহঁাস, রাজহঁাস, পেড়িভ‚তি, গিরিয়া, খঞ্জনা, পাতারি, জলপিপি, পানি মুরগি, নথর্ গিরিয়া, পাতিবাটান, কমনচিল, কটনচিল প্রভৃতি।

এবার প্রশ্ন আসতে পারে অতিথি পাখি কেন আসে কেন যায়Ñ

এর উত্তর খুব সহজেই দেওয়া যায়, শীত এলে এরা সহ্য করতে না পেরে অন্য দেশে যেখানে শীত অপেক্ষাকৃত কম সেখানে চলে যায়। তাছাড়া এ সময়টাতে শীতপ্রধান এলাকায় খাবারেও দেখা যায় প্রচÐ অভাব। কারণ শীতপ্রধান এলাকায় এ সময় তাপমাত্রা থাকে অধিকাংশ সময় শূন্যেরও বেশ নিচে। সেই সাথে রয়েছে তুষারপাত। তাই কোনো গাছপালা জন্মাতেও পারে না। তাই শীত এলেই উত্তর মেরু, সাইবেরিয়া, ইউরোপ, এশিয়ার কিছু অঞ্চল, হিমালয়ের আশপাশের কিছু অঞ্চলের পাখিরা ঝঁাকে ঝঁাকে চলে আসে কম ঠাÐা অঞ্চলের দিকে। শীতের শুরুতেই ওদের পাখনার ঝাপটায় সৃষ্ট নান্দনিক ছন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলার প্রত্যন্ত জনপদে নদনদী, খাল-বিল, হাওর, ঝিল, জলাশয় ও বিস্তীণর্ চরাঞ্চল, অতিথি পাখির গুঞ্জনে- কুঞ্জনে সবুজ-বনানী পরিবেষ্টিত রূপসী বাংলার নিজর্ন প্রান্তর তখন সেজে ওঠে নতুন সাজে নবরূপা। এসব অতিথি পাখিরা কেবল নিজেদের প্রশান্তির জন্যই আমাদের দেশে আসে না। আমাদের দেশে অতিথি হয়ে আসা এসব পাখি সেই সাথে বিভিন্নভাবে আমাদের উপকার করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অতিথি পাখিরা সাধারণত ছোট ছোট মাছ, শামুক, ব্যাঙাচি, পোকামাকড়, জল ও শেওলা ইত্যাদি খেয়ে বেঁচে থাকে। কীটপতঙ্গ খেয়ে অতিথি পাখিরা যেমন জীববৈচিত্র্যে ভারসাম্য রক্ষা করে, তেমনি ফুল ও শস্যের পরাগায়নেও এদের ভ‚মিকা গুরুত্বপূণর্। এরা ইঁদুর খেয়ে ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে। অতিথি পাখিরা যেহেতু সারের কাজ করে, সেহেতু পাখির মলে জমি পায় উবর্রতা।

বসন্তের সময় মানে মাচর্-এপ্রিলের দিকে শীতপ্রধান অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করে, কিছু কিছু গাছপালা জন্মাতে শুরু করে। ঘুম ভাঙতে শুরু করে পুরো শীতকালে ঘুমিয়ে থাকা অনেক প্রাণীদের। ঠিক এ রকম এক সময়ে অতিথি পাখিরা নিজ বাড়িতে ফিরে যায় দলবলসহ। আবার এখানে বেশ মজার একটা ব্যাপার আছে। তারা ফিরে গিয়ে ঠিক তাদের বাড়ি চিনে নেয়। অদ্ভুত এক ব্যাপার। গবেষকরা বলছেন, সমুদ্রের নাবিক যেমন কম্পাস ব্যবহার করে পথ চলে এই পাখিদের দেহে সেরকম কিছু একটা জন্মগতভাবেই আছে। যা তাদের পথ চলার সময় দিক চিনতে সাহায্য করে। তাছাড়া তারা সূযর্ ও তারার অবস্থানের উপরই নিভর্র করে। পরিষ্কার মেঘমুক্ত রাতে যখন আকাশে নক্ষত্র দেখা যায় তখন পাখিরা নিবিের্ঘœ পথ চলতে পারে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

তবে আমাদের দেশে সারা বছর না থাকলে কি হবে, আমাদের দেশের মানুষ কিন্তু ওদের কম ভালোবাসে না।

পথের ঠিকানা : ঢাকার যে কোনো স্থান থেকে আপনাকে প্রথমে যেতে হবে যাত্রাবাড়ী বা কমলাপুর। এখান থেকে বাসে অথবা ট্রেনে করে সিলেট। সিলেটের রেলস্টেশন/ বাস টামির্নাল থেকে দক্ষিণ সুরমা চÐীর পুল নথর্ ইস্ট মেডিকেল কলেজ এ পৌঁছালেই দেখা মিলবে অতিথি পাখির ভাড়া পড়বে ৩০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা ট্রেন অথবা বাস পরে স্টেশন/ টামির্নাল থেকে রিকশা ভাড়া ৩০ টাকার বেশি নয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<30674 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1