আদিম গুহাবাসী মানুষ যেদিন কোনো পূবর্ পরিকল্পনা ছাড়াই পাথরে পাথর ঘষতে আচমকা আগুন জ্বলে ওঠে মূলত সেদিন থেকেই সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়। সেদিন আগুনের সংহার রূপ দেখে মানুষ যেমন ভীত হয় তেমনি আগুনকে বশীভ‚ত করার জন্য তার কাছে অবনত হয়। এই অবনত হওয়া থেকেই উপাসনা ও পূজার সূচনা। তাই প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম মানুষ সমুদ্র, পবর্ত, সূযর্, চন্দ্র এসবকেও বিশাল শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে পূজা দিতে শুরু করে। মাথা নত করে এদের সম্মুখে। অগ্নি, বায়ু, বৃষ্টি, জল, নদী এসবও তাদের উপাস্যের বিষয় ছিল। কিন্তু কালক্রমে মানুষ এসব প্রাকৃতিক শক্তির ওপর দেবত্ব আরোপ করে মানুষরূপ প্রদান করে কাউকে বরুণদেব, কাউকে জলদেব, কাউকে পবনদেব বানিয়ে এক ধরনের আত্মতুষ্টির উপায় আবিষ্কার করে। বন্ধুরা এতক্ষণ নিশ্চয়ই ভাবছেন এই কথাগুলো কেন বলছি আমি, আমার মা আর বোন আজ কলকাতা ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনে বের হয়েছি সেই ঐতিহাসিক কুমোরটুলি দেখতে। সনাতন ধমার্বলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধমীর্য় অনুষ্ঠান দুগার্পূজা আর কয়েক দিন পরে। তাই আজকে আমাদের গন্তব্য উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি। সকাল থেকেই শরতের আকাশে মেঘের আনাগোনা ছিল তাই আমরা একটু দেরি করেই বের হই। আগে থেকেই আমাদের চার চাকার বাহনের কতর্ধার টুকাই দা এসে উপস্থিত। আমাদের আজকের যাত্রা শুরু হলো সিঁথির মোড় থেকে গাড়িতে বাজছে পুরনো দিনের হিন্দি গান। পথে আমাদের সঙ্গে ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে যুক্ত হলো রোশনির বর শুভদ্বীপ সঙ্গে এক গাদা খাবার। আমি বললাম আমরা তো খেয়ে এসেছি ও বলল খাবার খেয়েছ তো কি হয়েছে আমাদের এখানের হলদিরামের মিষ্টি একবার খেয়েই দেখো বারবার খেতে ইচ্ছা করবে। আমি আর লোভ সামলাতে পারলাম না সঙ্গে সঙ্গে চেখে দেখলাম। আসলেই অসাধারণ স্বাদ। আমরা এগিয়ে চলছি আমি রোশনির বর শুভদ্বীপের কাছে কুমোরটুলির ইতিহাস জানতে চাইলাম ও বলল ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করে। গোবিন্দপুর গ্রামে কোম্পানি ফোটর্ উইলিয়াম দুগর্ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সুতানুটি অঞ্চলে। গোবিন্দপুরের ধনিক সম্প্রদায় পাথুরিয়াঘাটা ও জোড়াসঁাকো অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। এর পাশাপাশি গড়ে ওঠে অন্যান্য কয়েকটি অঞ্চলও। কোম্পানির ডিরেক্টরদের আদেশানুসারে জন জেফানিয়া হলওয়েল ‘কোম্পানির মজুরদের জন্য পৃথক পৃথক অঞ্চল’ বণ্টন করেন। এভাবে কলকাতার দেশীয়দের অঞ্চলগুলো বিভিন্ন পেশাভিত্তিক পাড়ায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এভাবেই শুঁড়িপাড়া, কলুটোলা, ছুতারপাড়া, আহিরীটোলা ও কুমারটুলি প্রভৃতি অঞ্চলের উৎপত্তি ঘটে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বড়বাজার অঞ্চলের আগ্রাসনের শিকার হয়ে উত্তর কলকাতার মৃৎশিল্পীরা শহর ছেড়ে চলে যান। কিন্তু কুমারটুলির পটুয়ারা, যারা গঙ্গামাটি সংগ্রহ করে মাটির পাত্র ইত্যাদি তৈরি করে সুতানুটি বাজারে (অধুনা বড়বাজার) বিক্রি করতেন, তারা টিকে যান। পরে তারা ধনী সম্প্রদায়ের বাড়ির পূজার নিমিত্ত দেবদেবীর প্রতিমা নিমার্ণ করতে শুরু করেন। কলকাতা ও বাইরে বারোয়ারি বা সাবর্জনীন পূজার প্রচলন হলে পূজাকমিটিগুলো কুমারটুলি থেকে প্রতিমা সংগ্রহ করতে থাকেন। দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌঁছলাম কুমোরটুলিতে। গাড়ি থেকে নেমেই চোখে পড়ল সবাই কাজে ব্যস্ত সেই বিশাল আকৃতির প্রতিমা বানানোর কাজ চলছে আমরা খুব সাবধানে ভেতরে প্রবেশ করে প্রতিমা শিল্পীদের কাজ দেখতে শুরু করি আর আমি আমার ক্যামেরা নিয়ে একের পর এক ছবি তুলতে থাকি। এঁটেল মাটির কাজ চলছে তাই কোথায় কোথায় শুধু কাদা তাই খুব সাবধানে পা বাড়াতে হবে। কথা হলো মৃৎশিল্পী সজীব পালের সঙ্গে তিনি বললেন কুমোরটুলিতে কলকাতার অধিকাংশ দুগার্প্রতিমা তৈরি হয়। কলকাতায় দুগার্প্রতিমা নিমার্ণ ও দুগার্পূজার প্রস্তুতির সঙ্গে কুমোরটুলি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। কুমোরটুলির শিল্পীদের দুগার্প্রতিমার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। বতর্মানকালে কুমোরটুলির দুগার্প্রতিমা আমেরিকা, ইউরোপ ও আফ্রিকায় প্রবাসী বাঙালিদের কাছে সরবরাহ করা হয়। ১৯৮৯ সালে প্রথম অমরনাথ ঘোষের তৈরি করা শোলার দুগার্প্রতিমা সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও নাইজেরিয়ায় পাঠানো হয়। মাত্র তিন কিলোগ্রামের এই প্রতিমাগুলো বিমানযোগে প্রেরণের ক্ষেত্রে আদশর্ ছিল। ২০০৬ সালে কুমোরটুলি থেকে ১২,৩০০টি দুগার্প্রতিমা সরবরাহ করা হয়। প্রতি বছর বিশ্বের ৯৩টি রাষ্ট্রে কলকাতার এই পটুয়াপাড়া থেকে প্রতিমা প্রেরণ করা হয়ে থাকে। এই সংখ্যা বতর্মানে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও কুমোরটুলির প্রতিমাশিল্পীরা অনেকেই দারিদ্র্যের মধ্যে দিনযাপন করেন। কুমোরটুলির প্রতিমাশিল্পীদের মধ্যে সবাির্ধক জনপ্রিয় হলেন মোহনবঁাশী রুদ্র পাল ও তার দুই পুত্র সনাতন রুদ্রপাল ও প্রদীপ রুদ্র পাল, রাখাল পাল, গণেশ পাল, অলোক সেন, কাতির্ক পাল, কেনা পাল প্রমুখ। বতর্মান যুগে ‘থিম শিল্পী’দের রমরমা সত্তে¡ও সনাতন প্রতিমার গুণগ্রাহী আজও কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের দিয়ে প্রতিমা নিমার্ণ করান। আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি কুমোরটুলির পথে পথে দেখা মিলল বেশ কয়েকজন ফটোগ্রাফারের তারা আলাপ করছিলেন একটু একটু করে বছরের সেই দিন কটা এগিয়ে আসছে, যার জন্য আমরা প্রায় সবাই কম-বেশি অপেক্ষা করে থাকি। দুগার্পুজোর আমেজ সময়ের সঙ্গে যতই বদলাক না কেন, একটা জায়গা গত অনেক বছরেও এতটুকু বদলায়নি। তা হলো কুমোরটুলি। সেই জন্য প্রতি বছর পুজোর আগে দলে দলে ফটোগ্রাফাররা ভিড় জমান এখানে। শিল্পীদের হাতের কাজের এক একটি পযার্য় নতুন করে তুলে ধরতে ক্যামেরায়Ñ সব দিক থেকেই যা অনবদ্য।
যাবেন কীভাবেÑ হাওড়া থেকে বাসে করে বাগবাজারের পর অটো বা টানা রিকশা করে কুমোরটুলি। অথবা ট্যাক্সি করে যেতে পারবেন কুমোরটুলিতে।