বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
বে ড়া নো

হলুদ-সবুজের বুক চিরে

সুমন্ত গুপ্ত
  ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০
সেকালে গোলাবাড়ির চত্বরে বারুণীর মেলা বসত

হলুদ-সবুজের বুক চিরে আমরা চলছি গন্তব্য বালিয়াটি জমিদার বাড়ি। আমাদের জায়গাটির খেঁাজ দেন প্রকৃতি বাংলাদেশের সুজন সেনগুপ্ত। টানা কমর্ব্যস্ততা আর যান্ত্রিক শহরের বিষণœতায় মন চাইছিল কোথাও ছুট লাগাতে। কিন্তু সময়ের অভাবে হয়ে উঠছিল না। এ ক্ষেত্রে ছোট্ট এক ভ্রমণও হয়ে উঠতে পারে আপনার একঘেয়েমি দূরের সেরা টনিক। মনের অবসাদ দূর করতে ভ্রমণ বা বিনোদনের কোনো বিকল্প নেই। আর তা যদি হয় প্রাচীন পুরাকীতির্ বা রাজাদের বাড়ি তবে তো কথাই নেই। যান্ত্রিক জীবনে শত ব্যস্ততার বাইরে ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য আদশর্ ভ্রমণ স্থান হতে পারে রাজধানীর অদূরে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি প্রাসাদ। যা বালিয়াটি জমিদারবাড়ি নামে বেশি পরিচিত। চারটি প্রবেশমুখসহ প্রাচীর ঘেরা অসম্ভব সুন্দর দালান। প্রবেশতোরণ দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই পাশাপাশি চারটি দালান, পাশেই নাট্যমঞ্চ। ঢাকা থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে এবং মানিকগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পূবর্ দিকে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দঁাড়িয়ে আছে বেশকিছু সুরম্য প্রাচীন স্থাপনা। সময়ের ব্যবধানে ভবনগুলো ধ্বংসের প্রহর গুনলেও আজও ঠায় দঁাড়িয়ে জানান দেয় বালিয়াটির জমিদারদের সেকালের সেই বিত্তবৈভবের কথা। আঠারো শতকের প্রথম ভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথমভাগ। প্রায় দুইশ বছরের এই দীঘর্ সময়ে বালিয়াটির জমিদারদের সুখ্যাতি ছিল। প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তরের সাইনবোডর্ আর সমরেন্দু সাহা লাহোরের লেখা বালিয়াটির যত কথা বই থেকে জানা যায়, আঠারো শতকের মধ্যভাগে জনৈক লবণ ব্যবসায়ী জমিদার গোবিন্দরাম সাহা বালিয়াটি জমিদারবাড়ি নিমার্ণ করেন। আর ক্রমান্বয়ে তার উত্তরাধিকারীরা এখানে নিমার্ণ করেন আরও বেশ কিছু স্থাপনা। মোট সাতটি স্থাপনা নিয়ে এই জমিদার বাড়িটি অবস্থিত। এই বাড়ির উত্তর-পশ্চিম অংশে লবণের একটা বড় গোলাবাড়ি ছিল। এই কারণে এই বাড়ির নাম রাখা হয়েছিল গোলাবাড়ি। সেকালে গোলাবাড়ির চত্বরে বারুণীর মেলা বসত এবং এর পশ্চিম দিকে তাল পুকুরের ধারে আয়োজন করা হতো রথ উৎসব। এখানে বসত রথের মেলা। পযার্প্ত জায়গার অভাবে বতর্মানে এই স্থানে রথের মেলা হয় না। এই রথ উৎসব এখনো হয় বালিয়াটি গ্রামের পুরান বাজারের কালী মন্দিরের পাশে। তার বংশের উত্তরাধিকারদের কেউ একজন জমিদারি লাভ করেন। এরাই পরে এই বাড়ি নিমার্ণ করেনÑ গোবিন্দ রামের পরবতীর্ বংশধর দাধী রাম, পÐিত রাম, আনন্দ রাম ও গোলাপ রাম। এই পরিবারে স্মরণীয় অন্য ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেনÑ নিত্যানন্দ রায় চৌধুরী, বৃন্দাবন চন্দ্র, জগন্নাথ রায়, কানাইলাল, কিশোরীলাল, যশোধর্লাল, হীরালাল রায় চৌধুরী, ঈশ্বর চন্দ্র রায় চৌধুরী, হরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী প্রমুখ। ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এদেরই বংশধর বাবু কিশোরীলাল রায়।

পূবির্দকের একটি অংশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেলেও বাকি চারটি টিকে আছে এখনো। মূল ভবনগুলোর সামনের দেয়ালজুড়ে নানারকম কারুকাজ আর মূতির্ এখনো রয়েছে। ১৯৮৭ সালে প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তর বালিয়াটি প্রাসাদকে সংরক্ষিত পুরাকীতির্ ঘোষণা করে। সামনের চার দালানের প্রতিটি স্তম্ভই কারুকাজ করা। সৌম্য শান্ত একটা ভাব আছে। বারান্দায় লোহার রেলিং, কাঠের মেঝে ইত্যাদি সবই মনে করিয়ে দেয় উনিশ শতকের কথা। একটি দালানের ‘রংমহল’ এখন জাদুঘর। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে শব্দ করে উঠতে হলো রংমহলে। সিঁড়িটাও ২০০ বছরের পুরনো। দোতলায় সাজানো আছে এ প্রাসাদের মালিকদের কিছু জিনিসপত্র। টাকা রাখার বড় বড় সিন্দুক অনেক। লণ্ঠন, হ্যাজাকবাতি, পিদিম, পানির পাত্র রাখার কাঠের পাদস্তম্ভ, গ্রামোফোন যন্ত্র থরে থরে সাজানো। বিস্ময় লাগে বড় বড় আয়না দেখে। বয়স ২০০, প্রতিবিম্ব একেবারেই স্ফটিক স্বচ্ছ। যা এ যুগের আয়নাগুলো ১০ বছর বয়স হলেই আর দেখতে পারে না। কাঠের কারুকাজ করা চেয়ার, পালঙ্ক সবকিছুই নিয়ে যায় সেই সময়ে।

মজার ব্যাপার হলো, সামনের চারটি দালান পুরনো হলেও প্রতিটির সব তলাতেই ওঠা যায়। সিঁড়িগুলো এখনো কাযর্কর। তবে দশর্নাথীর্রা শুধু জাদুঘর পযর্ন্ত উঠতে পারে। চার দালানের পর পেছনে আরও তিনটি দালান। মোট ২০০ ঘর এই প্রাসাদ কমপ্লেক্সে। পেছনের দালানগুলো সব ইটের। সিংহ দরজা পেরিয়ে বাইরে বেরুলেই দীঘর্ পুকুর। পুকুরের জলে বালিয়াটি প্রাসাদের প্রতিচ্ছবি আজও মন ভরিয়ে দেয়। প্রতিটি প্রাসাদের সামনে টানা বারান্দা লোহার কারুকাজ শোভিত। তবে ক্ষয়ে ও নষ্ট হয়ে অনেক নকশা ও আর শৈলী এখন ঠিকমতো বোঝা যায় না।

মূল ভবনের দেয়ালগুলো প্রায় ২০ ইঞ্চি পুরু। এসব দেয়াল চুন-সুড়কি ও শক্তিশালী কাদা-মাটির মিশেলে তৈরি। বাড়ির ছাদে লোহার রডের পরিবতের্ ব্যবহার করা হয়েছে বেশ শক্তিশালী লোহার পাত। অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা না এলে বোঝা যাবে না। আমাদের ঘুরতে ঘুরতে ৫টা বেজে গেল। এদিকে সূযর্ পশ্চিমে হেলে পড়ছে, সাদা দালানে পড়ছে সোনালি আভা, গতিময় জীবন থেকে কীভাবে যে পঁাচটি ঘণ্টা চলে গেল আমরা টেরই পেলাম না আমরা ফিরে চললাম সেই চিরচেনা যান্ত্রিক জীবনে।

কীভাবে যাবেন

রাজধানী থেকে দিনে দিনেই ঘুরে আসা যায় বালিয়াটি জমিদার বাড়ি থেকে। ঢাকার গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি সাটুরিয়া যায় ‘জনসেবা’ বাস। ভাড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকা।

এ ছাড়া দেশের যে কোনো স্থান থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের কালামপুর স্টেশনে পৌঁছে সেখান থেকেও লোকাল বাসে সাটুরিয়া যাওয়া যায়।

সাটুরিয়া স্টেশন থেকে বালিয়াটি জমিদারবাড়ির রিকশা ভাড়া ৩০ থেকে ৪০ টাকা। নিজস্ব গাড়ি নিয়ে সরাসরি জমিদার বাড়ির সামনেই যাওয়া যায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<14993 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1