এ যেন শাপলার রাজ্য। লতা-পাতা গুল্মে ভরা বিলের পানিতে শত সহস্র লাল শাপলা হার মানিয়েছে সূযের্র আভাকেও। বিলের জল প্রায় দেখাই যায় না। সবুজ পাতার আচ্ছাদনে ঢাকা পড়েছে বিস্তীণর্ জলরাশি। লাল শাপলার হঁাসি যে কোনো মানুষকেই তার মনের বন্ধ দুয়ার খুলে দেয়। বন্ধুরা আমি বলছিÑ সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার উত্তর-পূবর্ দিকে অবস্থিত পাশাপাশি চারটি বিলের কথা সেখানে দেখা মিলবে চোখজুড়ানো এমন দৃশ্যের। বিলগুলো এ রকম অপরূপ সাজে সেজে রয়েছে। স্থানীয়দের কাছে এই বিল পরিচিতি পেয়েছে, ‘ডিবি বিল’ নামে। বিলগুলোর নাম হচ্ছে ডিবি বিল, কেন্দ্রী বিল, হরফকাটা বিল ও ইয়াম বিল। চারটি বিলের অবস্থান বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবতীর্ মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে। প্রথমে এই বিলের খবর পাই ফটো সাংবাদিক আনিস মাহামুদের কাছ থেকে এখনো ওই স্থানটি ভ্রমণপিপাসুদের চোখে পড়েনি।
আমি আর আমার ভ্রমণ সঙ্গী আমার মা, সিলেট শহর থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই বিল। আগে থেকে বলে রাখা ভালো বিলের আসল সৌন্দযর্ দেখতে হলে পড়ন্ত রোদ পড়ার আগে যেতে হবে। আমাদের পৌঁছাতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। যাত্রা পথে প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনার মন কেড়ে নেবে। গন্তব্য স্থলে পৌঁছে দেখা পেলাম এক অপরূপ দৃশের। দূর থেকে দেখলে সবুজের মধ্যে অসংখ্য ক্ষুদ্র লাল লাল বৃত্ত দেখে ঠাহর করা দুরূহ জিনিসগুলো আসলে কি? দূরত্ব কমার সঙ্গে সঙ্গে একসময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে ফুলের অস্তিত্ব। আগাছা আর লতা-পাতা গুল্মে ভরা বিলের পানিতে শত সহস্র লাল শাপলা। পুব আকাশে সূযের্র লাল আভা যেন হার মেনেছে রক্তিম শাপলার কাছে। প্রকৃতির বুকে অঁাকা এ যেন এক নকশিকঁাথা। আগাছা আর লতা-পাতায়, বিলের হাজারো শাপলা, চোখ জুড়ায় পথচারীদের। বিলের যত ভেতরে যাওয়া যায়, ততই বাড়তে থাকে লালের আধিক্য। এ যেন এক শাপলার রাজ্য। বিলে যারা থাকেন তাদের জীবন আর জীবিকা বেশ ভিন্ন। তাদের এই বিলের ওপর নিভর্র করে জীবনপ্রবাহ করে। বিলে পৌঁছে দেখা পেলাম এক মহিলা শাপলা তুলছেন। তাকে অনুরোধ করায় তিনিই রাজি হলেন ডিবির বিলের আশপাশে ঘুরে দেখানোর জন্য। তার নাম জিজ্ঞেস করায় বললেন সুচিত্রা দেবী। তিনি বললেন, এ বিলে ঠিক কবে থেকে, শাপলা জন্মাতে শুরু করেছে তা নিয়ে নেই সঠিক কোনো তথ্য। তবে, স্থানীয় বয়স্কদের কাছ থেকে জানা যায় জন্মের পর থেকেই, এভাবে শাপলা ফুটতে দেখেছেন তারা। প্রায় ৭০০ একর জায়গায় বিস্তৃত চারটি বিল। পুরো বিল ঢাকা পড়েছে শাপলায়। প্রস্ফুটিত শাপলা ফুল দেখতে অনেকটা আলোকরশ্মি বিচ্চুরিত নক্ষত্রের মতো। শাপলা ফুটে রাতের স্নিগ্ধতায় আর দিনের আলোয় আস্তে আস্তে বুজে যায়। একটি শাপলার স্থায়িত্ব এক নাগাড়ে সাতদিন পযর্ন্ত হয়ে থাকে। শাপলা ‘নিমফিয়েসি’ গোত্রের দ্বিবীজ পত্রী উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম- ঘুসঢ়যধপধধব. ইংরেজি নাম-ডধঃবৎ খরষর. উদ্ভিদ বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে শাপলাকে পৃথিবীর সবচেয়ে আদিম দ্বিবীজ পত্রী হিসেবে গণ্য করা হয়। ‘শাপলা’ শুধুই যে সৌন্দযের্র প্রতীক তা কিন্তু নয়। এর ঔষধি গুণসম্পন্ন উপকারিতাও রয়েছে। এর বাইরের পাপড়িগুলো অত্যন্ত কোমল। পুকুরে বা বিলে যখন আলো করে শাপলা ফুটে থাকে তখন সেই রূপের সঙ্গে পৃথিবীর আর কোনো ফুলের সৌন্দযের্ক তুলনা করা যায় না। সত্যিই এই শাপলার হাসি অতুলনীয়।
একদিকে লাল শাপলার সমারোহ অন্য দিকে মেঘালয় কন্যার অপরূপ রূপ যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। সুচিত্রা দেবী জানালেন যে বাংলাদেশের ওপারে ভারতের মেঘালয়ের মুক্তাপুর থানা অবস্থিত। এরপর আমরা গেলাম বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের কাছে এখানকার অধিবাসীরা বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজির লাগিয়েছেন ওপার প্রান্তে দেখা যায় ভারতের খাসিয়া অধিবাসীদের সুপারি এবং কমলার বাগান তবে বলে রাখা ভালো ভুলেও কেউ সাহস দেখিয়ে ওদিকে পা বাড়াবেন না।
এরপর গেলাম ডিবির হাওরে নৌকা করে ঘুরতে। হাওরের ভেতর নৌকা করে ঘোরার মজাই আলাদা। আমরা দেখা পেলাম একমাত্র মাঝি শ্রীদাম বিশ্বাসের। তিনিই ডিবির বিল ঘুরিয়ে দেখালেন। এর পর আমরা গেলাম বিল অঞ্চলের মানুষের জীবনধারা দেখতে। সুচিত্রা দিদি নিয়ে গেলেন তাদের বস্তিতে। এখানকার সব মহিলারা হাতের কাজ করেন। বঁাশের টুকরি, ডালা, কুলা সব ধরনের বঁাশের কাজ করেন। আর এই বঁাশগুলো বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের কাছে পাওয়া যায়। বিলবাসী মানুষের জীবনধারণ বিচিত্র, ডিবি হাওর এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ পেঁৗছায় নাই কিছু বাসায় সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা আর খাবার পানি বলতে সুগভীর ইন্দিরার উপর নিভর্রশীল ওই এলাকার মানুষ। সময় পার হতে হতে কীভাবে যে মিশে গিয়েছিলাম জনপদের মানুষের সঙ্গে। তাদের আতিথিয়তা আমাদের অবাক করে দেয়। আমাদের শহরজীবনে এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর যে সারা দিনই এক অচেনা ভ্রমণপিপাসুর পিছনে ব্যয় করেন। দিনের শেষে গোধূলি লগ্নে আমরা চললাম আমাদের শহুরে গন্তব্যে।
যাবেন কীভাবে : সিলেট শহরের বন্দর বাজার পয়েন্ট থেকে জৈন্তাপুর বাজারের পর কিছুদূর গেলে দেখা যাবে বডার্র গাডর্ বাংলাদেশের ডিবির হাওর বিশেষ ক্যাম্প ওই পথ ধরে কিছু দূর গেলে দেখা মিলবে বিলের। বাস/ সিএনজি/ প্রাইভেট গাড়ি করে সময় লাগবে এক ঘণ্টার মতো অথবা পুরো দিনের জন্য ভাড়া নিলে ১০০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা।
কিছু গুরুত্বপূণর্ তথ্য : বিলের আসল সৌন্দযর্ দেখতে হলে রোদের তিব্রতা বাড়ার আগে যাওয়াউ উচিত। সঙ্গে হালকা খাবার ও পানি নিয়ে যাওয়া ভালো। রোদের তিব্রতা থেকে বঁাচার জন্য ছাতা নেয়া যেতে পারে। তবে চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল যেখানে-সেখানে ফেলে বিলের পরিবেশ নষ্ট করবেন না। আরও একটা জরুরি কথা কেউ ভুলেও ভারত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেখার চেষ্টা করবেন না।