শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একাত্তরের গেরিলা ও নারী

একটি পতাকার জন্য এ দেশের নারী-পুরুষ, আবাল বৃদ্ধ বণিতা সম্মিলিতভাবে লড়েছিল ১৯৭১ সালে এবং দেশকে মুক্ত করেছিল। ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ, সংবাদ আদান-প্রদান, সাংস্কৃতিক প্রণোদনা, অর্থ-ওষুধ-খাদ্য-বস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসা ও সেবাকার্য, খাদ্য ও আশ্রয়দান ইত্যাদি সব কাজই মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য অর্জনে ভূমিকা রেখেছে নারী
উমামা তাসনিম
  ২১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারী তার সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেছিল স্বাধীনতার মতো একটি বড় অর্জনে। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীর অবদান সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। নারীর ভূমিকা কেবল নির্যাতনের শিকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীকে মূলধারায় না আনার একটি কারণ, এ যুদ্ধে ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছিল নিম্নবর্গের নারীরা। নারীর ইতিহাস সুশীল সমাজের কাছে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গৃহীত হতে শুরু করে স্বাধীনতার তিন দশক পর। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ বিষয়ে গবেষণা পর্যায়ে কিছুটা কাজ হয়েছে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষিতজন এবং নিরক্ষর অধিকাংশ মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে প্রচার পায়নি। নারীযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে গুটি কয়েক নারী। যুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে নারীর ধর্ষণের ঘটনা প্রচার লাভ করেছে অনেক বেশি। যে কারণে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষিতরা অবলীলায় বলে যান, ৩০ লাখ শহিদ এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা।

প্রকৃতপক্ষে নারীরা মুক্তিযুদ্ধে অনেক বড় সহায়কশক্তি ছিল। নারী সক্রিয় ছিল কখনো সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে, কখনো বা যুদ্ধক্ষেত্রের আড়ালে। যেভাবেই হোক, মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাদের বিশ্বাস ছিল অবিচল, সাহস ছিল কঠিন। তারামন বিবির মতো বহু মুক্তিযোদ্ধা আছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন এমন নারীর সংখ্যাও অসংখ্য। অজানা-অচেনা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষা করেছেন বহু নারী নিজের শ্রম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে। অনাহারী, অর্ধাহারী, ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কখনো মমতাময়ী মায়ের মতো, কখনো বা বোনের মতো। নিজেরা খেয়ে না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রান্না করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। চরম দুঃসময়ে পাকিস্তানি হানাদারের হাত থেকে রক্ষা করতে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের।

পুরুষের পাশাপাশি নারীর বুদ্ধি-বিচক্ষণতা, আন্তরিকতা ও সাহসের ফল স্বাধীনতা। স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে শত্রম্নর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন অনেক নারী। যেমন কাঁকন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা, রওশন আরা প্রমুখ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গোবরা ক্যাম্পে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অনেক নারী। জানা যায়, নারীযোদ্ধাদের জন্য অনুরূপ আরও তিনটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে। 'গোবরা ক্যাম্প'-এ মেয়েদের দেওয়া হতো তিন রকম ট্রেনিং- ১. সিভিল ডিফেন্স, ২. নার্সিং, ৩. অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমণ।

ভারতে শরণার্থী শিবিরে ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অসংখ্য নারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সেবা করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে অংশ নিয়েছেন অনেক নারী শিল্পী। নারী কবি, লেখক, সাংবাদিক ও শিল্পীরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে। তাদের লেখায় এবং শিল্পীদের গানেও রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা। শুধু তা-ই নয়, পথে-প্রান্তরে অলিগলিতে গান গেয়ে অনেকে অর্থ সংগ্রহ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহায়তার জন্য। দুর্ভাগ্যজনক, মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য নারীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিশেষ কোনো স্বীকৃতি পাননি। অনেক নারীযোদ্ধাই হারিয়ে গেছেন। পাকিস্তানি শাসকদের কাছ থেকে তথা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশমাতৃকাকে উদ্ধার করার জন্য, জাতির অধিকার আদায়ের জন্য, সর্বোপরি একটি পতাকার জন্য এ দেশের নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সম্মিলিতভাবে লড়েছিল ১৯৭১ সালে এবং দেশকে মুক্ত করেছিল। ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। কেবল প্রত্যক্ষ যুদ্ধই নয়, পাকিস্তানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে নারী কর্তৃক জনগণকে সংগঠিত করা ও সব শ্রেণিকে উদ্বুদ্ধ করা, বোমা তৈরিসহ গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ, সংবাদ আদান-প্রদান, সাংস্কৃতিক প্রণোদনা, অর্থ-ওষুধ-খাদ্য-বস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসা ও সেবাকার্য, খাদ্য ও আশ্রয়দান ইত্যাদি সব কাজই মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য অর্জনে ভূমিকা রেখেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<80724 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1