শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপদ হোক সন্তানের শৈশব

আপনার আশপাশে খোঁজ নিয়ে দেখুন কঠিন অনুশাসনে রাখা বাচ্চাদের তুলনায় প্রকৃতি, মানুষের কাছাকাছি ঘেঁষতে দেয়া বাচ্চাগুলোই ভালো মানুষ হয়। তারা স্থান, কাল, পাত্র বোঝে। কঠিন চাপের মুখে থাকতে থাকতে বাচ্চাগুলো একসময় সবকিছুর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ভয়ের মধ্যে হীনম্মন্যতায় বেড়ে ওঠে। 'এই বুঝি ভুল করে ফেললাম'- এরকম একটা ভাব। সবকিছুতে তটস্থ হয়ে দিন কাটায়। রেজাল্ট ভালো না করলে বাবা-মায়ের বকাবকি। খেলতে গেলে খবরদারি। বেড়াতে গেলে নজরদারি। বরং যেসব বাবা-মা সবকিছুর গুরুত্ব বুঝে সন্তানকে ওভাবে চালিত করে তারাই ভবিষ্যৎ জীবনে ফুল হয়ে ফোটে।
রুমানা নাওয়ার
  ১৯ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

সন্তান পড়াশোনা করে বড় চাকরি করবে, বংশের নাম করবে- এটাই বাঙালি পরিবারগুলোর সাধারণ চাহিদা। কিন্তু কিছু কিছু মা-বাবাকে দেখা যায় সারাক্ষণ সন্তানের পড়ালেখা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকতে। কোথাও গিয়ে দুদন্ড থাকার ফুরসত নেই তাদের। সামাজিক পারিবারিক শোকের সুখের কোনো অনুষ্ঠানে অবস্থান নিতে পারে না। সন্তানকে তটস্থতার মধ্যে রাখে সারাক্ষণ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শীতের ছুটি গ্রীষ্মের ছুটি বিভিন্ন উৎসব পালা-পার্বণে অনেক ছুটি রাখে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা। ছাত্রছাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একঘেয়েমি কাটার জন্য এ ছুটিগুলো রাখা। তার ওপর বিভিন্ন ঋতুগত ছুটিগুলোয় পরিবেশ প্রকৃতির ঋতুগত তারতম্য বোঝার জন্য আনন্দে ভাগিদার হওয়ার জন্য এ ছুটিগুলোর বিকল্প নেই। শীতকালে মাটির চুলায় ভাপা পিঠা খাওয়ার আয়েশ দাদু-নানুবাড়িতে যা পাওয়া যায়। আমাদের শহুরে জীবনে তা মেলে কই? গাছির খেজুর রস নিয়ে গাছ বেয়ে নামার দৃশ্য গ্রামেই দেখা যায়। স্বাদ ও তার অন্যরকম। গ্রীষ্মের ছুটিটা ঠিক সেরকম। আম-কাঁঠালের ধুম লাগা সময়। মাথার ওপর কানফাটা রোদ্দুর। ভাদ্রের তাল পাকানো রোদে নাভিশ্বাস চারদিকে। হাঁপিয়ে ওঠে প্রকৃতি, হাঁপিয়ে ওঠে মানুষ। একটু শান্তির জন্য গ্রীষ্মের অবকাশ খোঁজে ছোট-বড় সবাই। মধুমাসে মধু খেতে গ্রামের বাড়িতে ছোটে। অথবা কেউ সমুদ্রে যায় আর কেউবা পাহাড়ে।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এ ছুটিগুলোকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে কিছু কিছু অভিভাবক বাচ্চাদের বইয়ের ভিতর মুখ ঢুকিয়ে রাখে সারা বছর। এসব ছুটিকে থোড়ায় কেয়ার করে এসব মহাজ্ঞানী অভিবাবক। কিসের ছুটি কিসের কি। সারাবছর পড়াশুনোয় না থাকলে। সিলেবাস দশ-বিশবার শেষ করতে না পারলে ছেলে আমার গোল্ডন এ+থেকে পিছিয়ে যাবে যে। আত্মীয়-স্বজনে মুখ দেখাবো কি করে। ঘরে মেহমান অতিথি অ্যালাউ হয় না এসব ঘরে। বিনা আর্গুমেন্টে কেউ একবেলার বেশি অবস্থান নিতে পারে না। রাত কাটানো নাইওর করা তো দূরের কথা। সে যতই নিকটাত্মীয় হোক। রক্তের বাঁধন যতই তীব্র থেকে তীব্রতর হোক। কালেভদ্রে যদি কেউ থেকে থাকে তাহলে বাচ্চার কম মার্কস পাওয়ার জন্য ওই আত্মীয়কে দোষারোপ করতে পিছ পা হয় না।

বিভিন্ন উৎসব আনন্দে ও অংশগ্রহণটা তাদের বিরসবদনে। আহা কত ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে আমার ছেলেমেয়ের। একটা দিন মাটি করে ফেললাম মনে হয়। উৎসবের আমেজ না কাটতেই ভোঁ দৌড়। উৎসবটাকে এক থাল দুঃখে মাখে বাচ্চাকাচ্চাগুলো অশ্রম্ন বিসর্জনে। আহা আরও দুটো দিন থাকা যেত যদি। মা-বাবাকে কে বোঝাবে সে কথা। তারা তো ঘোড়দৌড়ে নেমেছে। শৈশব-কৈশোর দুরন্ত সময়টাকে আটকে রাখছে শাসন নিষেধের চাবি দিয়ে। ছুটির দিনগুলো ও কেমন রুটিনবাঁধা। হাউস টিউটর কোচিং এক্সামে মুখর। তার ওপর এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটিস তো আছেই। নাচ-গান, আবৃত্তি, তবলা, গিটার, ক্যারাটে, ক্রিকেট আরও কত কী? ছেলে আমার সর্ববিদ্যায় পারদর্শী হোক এটাই কাম্য। প্রতিযোগিতার বিশ্বে মেয়েটা আরও এগিয়ে যাক এটাই চায় ওসব বাবা-মা।

কিন্তু তারা এটা বোঝেনা যে, এ প্রতিযোগিতার রেইসে খেই হারিয়ে ফেলছে তার প্রিয় সন্তানটি। যান্ত্রিক দানবে পরিণত হচ্ছে দিনে দিনে। পরিবেশ প্রকৃতি রক্তের বাঁধনকে অস্বীকার করে কোনো মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে না। পারে না সুস্থ সুন্দর জীবনের অধিকারী হতে। আজীবন রোবট হয়ে দম দেয়া পুতুল হয়ে বাঁচবে। যখন যা করতে হবে তা করতে, না দিলে বাচ্চাদের মন-মানসিকতা একসময় বিগড়ে যায়। যখন ছোটকাল তখন হয়তো বাবা-মায়ের অবাধ্য হতে পারে না। কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালের সময়টায় বা তারও পরে নেগেটিভ মারমুখো আচরণ করে অভিভাবকের সঙ্গে। একটা বিতৃষ্ণা থেকে এটা চলে আসে। খেলার সময়টায় বেড়ানোর সময়টায় ওদের মতো করে দিতে হবে। এ সময়টায় ঘরে বন্দি করে রাখলে বইয়ের পাতায় চোখ আটকে রাখলে এটা হিতে বিপরীত হবেই। আপনার আশপাশে খোঁজ নিয়ে দেখুন কঠিন অনুশাসনে রাখা বাচ্চাদের তুলনায় প্রকৃতি, মানুষের কাছাকাছি ঘেঁষতে দেয়া বাচ্চাগুলোই ভালো মানুষ হয়। তারা স্থান, কাল, পাত্র বোঝে। কঠিন চাপের মুখে থাকতে থাকতে বাচ্চাগুলো একসময় সবকিছুর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ভয়ের মধ্যে হীনম্মন্যতায় বেড়ে ওঠে। 'এই বুঝি ভুল করে ফেললাম'- এরকম একটা ভাব। সবকিছুতে তটস্থ হয়ে দিন কাটায়। রেজাল্ট ভালো না করলে বাবা-মায়ের বকাবকি। খেলতে গেলে খবরদারি। বেড়াতে গেলে নজরদারি। তো এসব বাচ্চা বিগড়ে না গিয়ে কে বিগড়াবে বলুন।

বরং যেসব বাবা-মা সবকিছুর গুরুত্ব বুঝে সন্তানকে ওভাবে চালিত করে তারাই ভবিষ্যৎ জীবনে ফুল হয়ে ফোটে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্তের যে আবেদন, মনের রক্তের সম্পর্কের যে দ্যোতনা তা সন্তানের মধ্যে প্রবাহিত করুন। দেখবেন আপনার সন্তান ভালো মানুষ হবে। প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে। সহজ স্বাভাবিকতাকে মেনে নিন। যা অস্বাভাবিকতাকে পরিহার করুন। তবেই সন্তানের জীবন আমাদের জীবন সুখের হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<71668 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1