শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
৯৯তম জন্মবর্ষে

ড. নীলিমা ইব্রাহিম আমৃতু্য যার কল্যাণ মানস

নতুনধারা
  ১২ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০
আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী ইতিহাসে ড. নীলিমা ইব্রাহিমের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে

শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিবিদ, সংস্কৃতিসেবী, নারী সংগঠক ও মুক্তবুদ্ধির চিন্তক, একটা পরিচয় ছাপিয়ে আরেকটা পরিচয়, তার ক্ষেত্রে কোনোটাই কোনোটার চেয়ে কম নয়। সত্য ও ন্যায়ের প্রতি স্থির ও অবিচল থেকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে সম্বল করেছিলেন যিনি; এ দেশ, জাতি, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি যাবতীয় ধারণাকে নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করেছিলেন যিনি; নিজের কণ্ঠের স্বতন্ত্র উচ্চারণে কোটি কণ্ঠকে জাগিয়েছিলেন যিনি; তিনিই মহীয়সী ড. নীলিমা ইব্রাহিম।

তাকে আমরা নীলিমা ইব্রাহিম নামে চিনলেও আগে তার নাম ছিল নীলিমা রায় চৌধুরী। আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী ইতিহাসে তার কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা। মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেকেই দেশ গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাদের সঙ্গে তিনিও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযুদ্ধে হানাদার কর্তৃক নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন ও তাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগাতে যিনি নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নিজ উদ্যোগে অনেক বীরাঙ্গনা নারীকে সদ্য স্বাধীন দেশে সম্মানের সঙ্গে বসবাসের জন্য প্রতিষ্ঠিত করেন। মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ও শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ যার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফসল। নির্যাতিতা নারীদের নিয়ে লিখেছেন তার জীবনের অন্যতম কালজয়ী গ্রন্থ 'আমি বীরাঙ্গনা বলছি'।

বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামের এক জমিদার পরিবারে ১৯২১ সালের ১১ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন নীলিমা রায় চৌধুরী। পিতা প্রফুলস্নকুমার রায় চৌধুরী এবং মাতা কুসুমকুমারী দেবী। মেয়েবেলায় খুব দুরন্ত ও চঞ্চল প্রকৃতির হলেও লেখাপড়ায় বরাবরই মেধাবী ছাত্রী হিসেবে ছিলেন নীলিমা রায় চৌধুরী। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে। খুলনা করোনেশন গার্লস? স্কুল থেকে ১৯৩৫ সালে ক্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করে ভর্তি হন কলকাতার বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনে। সেখান থেকেই ১৯৩৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক ও ১৯৩৯ সালে অর্থনীতিতে অনার্স সম্পন্ন করেন। অর্থনীতিতে এমএ পড়া শুরু করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু মায়ের অসুস্থতার জন্য সে বছর আর এমএ করা হয়ে ওঠেনি। অতঃপর স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিটি সম্পন্ন করেন। মনে মনে এমএ পাসের অদম্য ইচ্ছাটা রয়েই যায়। বিটি করার পর এমএ করার জন্য আবার ভর্তি হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায়, এখানে থেকেই ১৯৪৩ সালে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৫ সালে তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম 'বিহারীলাল মিত্র গবেষণা' বৃত্তি লাভ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের পর উনসত্তরের গণঅভু্যত্থান থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন নীলিমা ইব্রাহিম। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই ছিলেন। নিজ চোখে দেখেছেন পাকিস্তানি নরঘাতক সেনাদের তান্ডব। ২৭ তারিখ ক্যাম্পাস ছেড়ে নারিন্দায় গেলেন, ৩০ মার্চ ঢাকা ছাড়েন। আবার আগস্টে ফিরে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ, প্রচারপত্র বিলিসহ ছাত্রছাত্রীদের সংঘবদ্ধ করে মুক্তিসংগ্রামে প্রেরণের জন্য কাজ করেছেন। অবশ্য এজন্য তাকে তৎকালীন সামরিক শাষক টিক্কা খানের বিরাগভাজন হতে হয়েছে। তাকে টিক্কা খান তার অন্তর্ঘাতী কর্মকান্ডের জন্য কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে সতর্কপত্র দেন যা জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নীলিমা ইব্রাহিম আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যান। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে নীলিমা ইব্রাহিম নারী পুনর্বাসন বোর্ডের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে ঘুরে বেড়িয়েছেন, বীরাঙ্গনাদের বেঁচে থাকতে উৎসাহ দিয়েছেন অবিরাম। এভাবেই তার সুযোগ হয়েছিল বীরাঙ্গনা নারীদের সঙ্গে কথা বলার। তিনি বিভিন্ন সময়ে অনেক বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন তাদের নির্যাতনের ইতিহাস। কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজ একাত্তরের অমর আর অজেয় বীরাঙ্গনাদের অবদান অস্বীকার করেছে। শুধু সমাজ নয়- বীরাঙ্গনাদের পরিবারও তাদের গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। অস্বীকার করেছে বাবা, অস্বীকার করেছে স্বামী। 'আমি বীরাঙ্গনা বলছি' যেখানে ফুটে উঠেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরাঙ্গনাদের ওপর ঘটে যাওয়া নারকীয় বর্বরতার বাস্তব কাহিনী। কতটা নিষ্ঠুর ও অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তারা। তিনি এসব বীরাঙ্গনাদের মাত্র কয়েকজনের ঘটনা সংকলন করেছেন 'আমি বীরাঙ্গনা বলছি' নামক স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে।

১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে বাংলা একাডেমির দায়িত্ব নেয়ার জন্য সরাসরি প্রস্তাব দেন, শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে বললে তিনি সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। অবশেষে তাকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে জোর করে নিয়োগ দেয়া হয়। একই সঙ্গে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষর দায়িত্বও দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি অধ্যাপক নুরুল মোমেন, আসকার ইবনে শাইখ, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার সঙ্গে নীলিমা ইব্রাহিম যুক্ত হয়ে পড়েন নাট্যচর্চায়। এই নাট্যচর্চার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে নবগঠিত বুলবুল একাডেমিতে ক্লাস নিতেন নাটকের ওপর। এক সময় নাটকও লিখেছেন তিনি। তার লেখা প্রথম নাটক 'মনোনীতা' যা মঞ্চস্থ হয় বুলবুল একাডেমির ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। ১৯৬২-৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন 'রঙ্গম' নামের একটি নাট্যসংস্থা। এ সময় তিনি রেডিও টেলিভিশনের জন্য ও প্রচুর নাটক লিখেছেন।

এই মহীয়সী নারী ২০০২ সালের ১৮ জুন ঢাকায় নিজ বাস-ভবনে মৃতু্যবরণ করেন। মৃতু্যর পর তাকে শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। মুক্তবুদ্ধি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও উদার মানবিকতা ছিল তার জীবনদর্শন। নীলিমা ইব্রাহিম বেঁচে থাকতে যেমন মানুষের শুভ ও কল্যাণ চেতনায় আস্থাশীল ছিলেন।

রহিমা আক্তার মৌ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<70670 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1