বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামীণ সভ্যতার উন্নয়নে নারী

প্রাচীনকালে নারীরাই প্রথম কৃষি কাজ শুরু করেন। নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষি, নবায়ন, মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। ফসলের প্রাক বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াজাতকরণ এমনকি বিপণন পর্যন্ত অনেক নারী এককভাবেই করে। বলা চলে কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে নারী। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে কৃতজ্ঞচিত্তে নারীর এ উপস্থিতির কোনো হিসাবে স্বীকৃতি নেই। এখনো গ্রামীণ সমাজে কৃষি ও চাষের কাজকে নারীর প্রাত্যহিক কাজের অংশ বলে বিবেচনা করা হয়। সেখানে মুজুরি প্রদানের বিষয়টি অবান্তর।
নতুনধারা
  ১২ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

মনিরা মিতা

'জ্ঞানের লক্ষ্ণী, গানের লক্ষ্ণী, শস্য লক্ষ্ণী নারী,

সুষমা লক্ষ্ণী নারীই ফিরিছে রূপে সঞ্চরী...'

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই নারী বন্ধনা শুধু কবিতায় নয়- বাস্তবজীবনেও শাশ্বত।

প্রাচীনকাল থেকেই সভ্যতা বিকাশে নারীর ভূমিকা অপরিসীম। নারী কখনো নদী, কখনো প্রকৃতি, কখনো কোমলতার, কখনো সৌন্দর্যের প্রতীক।

বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৭০০ কোটি লোকের অর্ধেক নারী, সমাজ ও সভ্যতার উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে নারীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। জাতীকে যেমন সাইকেল হিসেবে বিবেচনা করে একদিকে পুরুষ অন্যদিকে নারী যেভাবে গোটা দেশটাকে সাইকেল হিসাবে চিন্তা করলে একদিকে শহর অন্য দিকে গ্রাম। একথা অনস্বীকার্য, বর্তমান সভ্যতার অস্তিত্বের ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীর অবদান বিশাল। গ্রামীণ নারীদের কথা একটাই সূর্য ওঠার আগে থেকে মাঝরাত অবধি কাজ করতে হবে। সন্তান-সংসার সামলাতে হবে। একদিন কাজ না করলে পরিবার নিয়ে দুবেলা দুমুঠো মুখে দিতে হিমশিম খেতে হবে।

গ্রামীণ নারীদের অবদান পুরুষশাসিত সমাজ মূলহীন। তবে এ দেশের পারিবারিক ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার পিছনে মূল অবদান গ্রামীণ নারীদের। গ্রামীণ নারীরা অনেক কষ্ট করে, শত ত্যাগ স্বীকার করেও পরিবারিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখেন। প্রতিটি পরিবারের সুশৃঙ্খল গাঁথুনির পিছনে মূল ভূমিকা নারীরই। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও গ্রামীণ নারীদের আজও মেলেনি শ্রমের স্বীকৃতি। ঘরে-বাইরে নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। সংসারে তো বটেই বাইরে পরিশ্রম করেও নারী বলে হতে হচ্ছে অবমূল্যায়িত। পরিশ্রমের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। গ্রামীণ নারীশ্রমিকরা অশিক্ষা আর অসচেতনতার কারণেই সবক্ষেত্রে অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশে বারো হাত শাড়ির আঁচল জড়ানো নারীরা এখনো অবহেলিত।

সুবিধা বঞ্চিত এই নারীরা কুটিরশিল্প, বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ, সেলাই প্রভৃতির মাধ্যমে অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। গ্রামীণ নারীরা সংসারের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার পরও বাড়তি আয়-উপার্জনের জন্য, আর্থিক সচ্ছলতার জন্য, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ মেটানোর জন্য বিভিন্ন কুটিরশিল্পের কাজ করে থাকে, যেমন : বাঁশ ও বেতের কাজ, মৃৎশিল্প, আঙিনায় শাক-সবজি চাষ, গবাদিপুশ পালন, সূচিকর্ম ইত্যাদি।

প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি নারীরা স্বভাববসত যে কাজটা করে তা হলো সূচিকর্ম। নারীরা ঘরে বসে অবসর সময়ে বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে নকশিকাঁথা, তোষক ইত্যাদি তৈরি করে। নকশিকাঁথার মধ্যে নারীরা বিভিন্ন ফুল, পাতা, পাখি, পহেলা বৈশাখ, বিভিন্ন উৎসব, গ্রামীণ নারীজীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, পাওয়া না পাওয়া ইত্যাদি মনের মাধুরী মিশিয়ে আপনমনে কারুকার্য ফুটিয়ে তোলে নান্দনিক সূচিকর্মের মাধ্যমে।

নারী কৃষির অগ্রদূত। প্রাচীনকালে নারীরাই প্রথম কৃষি কাজ শুরু করেন। নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষি, নবায়ন, মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। ফসলের প্রাক বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াজাতকরণ এমনকি বিপণন পর্যন্ত অনেক নারী এককভাবেই করে। বলা চলে কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে নারী। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে কৃতজ্ঞচিত্তে নারীর এ উপস্থিতির কোনো হিসাবে স্বীকৃতি নেই। এখনো গ্রামীণ সমাজে কৃষি ও চাষের কাজকে নারীর প্রাত্যহিক কাজের অংশ বলে বিবেচনা করা হয়। সেখানে মুজুরি প্রদানের বিষয়টি অবান্তর।

এখন সময় এসেছে বদলানোর। আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। পুষ্টিতে-তুষ্টিতে-যুক্তিতে নারীর পাওনা অধিকারকে সমানভাবে প্রাপ্যতা অনুযায়ী সুনিশ্চিত করতে হবে। নারীকে শিক্ষা প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও দক্ষ করে তুলতে হবে। নারী বলে কোনো রকম বৈষম্য অবহেলা করা চলবে না। জাতীয়পর্যায়ে যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন তাদের শিকড় কোনো না কোনো গ্রামে। আর সেই শিকড় গড়ে উঠেছে কোনো মমতাময়ী নারীর যত্নশীল ছোঁয়ায়। কখনো মা হিসেবে, কখনো বউ হিসেবে, আবার কখনো বোন হিসেবে নারীই সমাজের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। নারীকে তাই মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। নারী মমতাময়ী বলেই মাটির মতো মায়ের মতো ও ধরণিতে কেবল প্রশান্তির জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছে আজীবন আমরণ। নারীর উৎসর্গীপনা জীবন জীবনান্তে স্বর্ণ অক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়।

আমরাও আমাদের জাতীয় কবির সফঙ্গ একমত হয়ে বলি 'সেদিন সুদূর নয়-যেদিন ধরণি পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<70668 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1