শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কন্যাশিশুরা আগামীর দক্ষ মানবসম্পদ

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুলস্নাহ
  ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ভারতীয় কবি পাওনি মাথুরের ভাষায়- 'ঝযব ধিং :যব শববঢ়বৎ ড়ভ :যব যড়ঁংব, নঁঃ :যব যড়ঁংব ধিং হড়ঃ যবৎ শববঢ়বৎ.' কন্যাশিশুদের নিয়ে এমনই উদ্বিগ্নতার কথা আরও পাওয়া যায় অসংখ্য কবির কবিতায়। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব নির্বিশেষে আমাদের সমাজে এমনকি নিজেদের পরিবারেও আমরা লক্ষ্য করে থাকি, মেয়ে শিশুর প্রতি অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈষম্যমূলক আচরণ। ফলে অনেকাংশেই দারিদ্র্যের প্রথম শিকার হয় আমাদের কন্যাশিশুরা।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক ও শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠলেও আমাদের কন্যারা পিছিয়ে রয়েছে অবজ্ঞা, বঞ্চনা ও বৈষম্যমূলক মনোভাবের ফলে। কন্যাসন্তান হওয়ার ক্ষেত্রে একজন নারীর কোনো ভূমিকা নেই- এই প্রমাণিত সত্যটি শিক্ষিত পুরুষ জানার পরও মানসিকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই এ দায় চাপিয়ে দেন নারীর ওপরই। ফলে কোনো অন্যায় না করে আমাদের দেশে হাজার হাজার নারী কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার অভিযোগে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেন। কিছু সামাজিক কথিত নীতির ফলে শিশুকাল থেকেই কন্যাশিশুদের এমনভাবে গড়ে তোলা হয়, যেন তারা আগামীর কিছু হতে না শেখে। তাদের প্রতি করা বৈষম্যমূলক আচরণকে অন্যায় হিসেবে না দেখে সহজাত ও সমঝোতার সঙ্গে গ্রহণ করতে শেখানো হয়। যা পরে নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার পথটিকে প্রশস্ত করতে সাহায্য করে।

কন্যাশিশুর প্রতি মূল্যবোধ, সামাজিক অবস্থান সৃষ্টি, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, যৌন হয়রানি বন্ধ, প্রতিহিংসা দূরীকরণ, অধিক বয়সের ব্যবধানে বিয়ে করে দাম্পত্যে অশান্তি সৃষ্টি রোধসহ বিভিন্ন উন্নয়ন ইসু্যতে কাজ করার লক্ষ্যে প্রতিবছর ৩০ সেপ্টেম্বর কন্যাশিশু দিবস পালন করা হয়; কিন্তু হতাশার বিষয় হলো- এর সফলতা এখনো আশানুরূপ নয়। কন্যাশিশুদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যদিও ২০০০ সাল থেকে জাতীয়ভাবে এ দিবসটি পালনের অনুমোদন দেয় নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়; কিন্তু সেভাবে কন্যাশিশুর যথাযথ শিক্ষা, পুষ্টি, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ তথা সুষ্ঠু বিকাশ হচ্ছে না- বেড়েই চলেছে ইভ টিজিং, এসিড সহিংসতা এবং যৌন নির্যাতনসহ কন্যাশিশুর প্রতি যাবতীয় হয়রানি, নির্যাতন। সর্বত্র এখন কন্যাশিশুরা বিভিন্ন দিক দিয়ে বৈষম্যের শিকার। এর সর্বশেষ এবং করুণ উদাহরণ 'আদুরী'। যে দু'মুঠো খাবার সংস্থানের জন্য কাজ করতে গিয়ে ডাস্টবিনে পড়েছিল।

বাংলাদেশ নয় কেবল, বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও কন্যাশিশু হত্যাসহ তাদের বৈষম্যের ইতিহাস কয়েক শতক ধরে চলে আসা এক চলমান ইতিহাস। দারিদ্র্য, যৌতুকব্যবস্থা, আজন্ম অবিবাহিত থাকা, বিকৃত দেহ, দুর্ভিক্ষ, অভাব, শিক্ষায় অসমর্থন, প্রসবজনিত অসুস্থতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে সময়ে সঠিক যত্ন বা সেবা না পাওয়া, এসব কারণই বিষয়টি অনুধাবনে যথেষ্ট। কন্যাশিশু সুরক্ষা, অবমাননা বা হত্যা ভারতবর্ষে একটি গর্হিত অপরাধ এ ব্যাপারে কঠোর নিয়মনীতি থাকলেও আইনের প্রয়োগ বা এ বিষয়ে রুজু হওয়া রিপোর্টের সংখ্যা খুবই কম। ২০১০ সালে পেশ করা এক রিপোর্টের ভিত্তিতে জানা যায়, ভারতে এমন হত্যার সংখ্যা মাত্র ১০০ জন,?যা দেশের জনসংখ্যা হিসেবে লাখে ১ জন?(যেটি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়)।?অথচ ভারতীয় সমাজে বিচার করে দেখা যায়, এখানে লিঙ্গ-নির্ধারক পরীক্ষার মাধ্যমে অনেক কন্যাশিশুর হত্যা তার জন্মের আগে সম্পাদিত হয়। এর জন্য অবশ্য সমাজব্যবস্থাই দায়ী। ১৯৯১ সালে ভারতীয় জনসংখ্যা গণনায় প্রকাশ পায় এমনই তথ্য, যা এখনো বর্তমান।?

প্রতি বছর কন্যাশিশু দিবস পালিত হলেও, বাস্তবতা এই যে আজও এর তেমন কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। কোথাও এ নিয়ে কারোর তেমন কোনো মাথাব্যথাও নেই। যেখানে তেল আছে, সেখানেই তেল ঢালা হচ্ছে কেবল?মধ্যখানে অসহায় নির্যাতিতা কন্যাশিশু ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ না করে খামোখা দিবস পালনে কতটুকুন সফলতা! বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু এবং এদের মধ্যে ৪৮ শতাংশই কন্যাশিশু। শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হলেও আজও দেশের অধিকাংশ কন্যাশিশুর বিয়ে হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্কা হওয়ার আগেই। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০০৭-এর তথ্যানুযায়ী দেশে এখনো পূর্ণ বয়স্কা হওয়ার আগেই ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে এবং দু-দশক ধরে এ হারের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। তেমন কিছু বুঝে ওঠার আগেই গর্ভবতী হচ্ছে ৬৬ শতাংশের এক শতাংশ।

বাংলাদেশে নারীর গড় বিয়ের বয়স ১৫ বছর ৩ মাস, ইউনিসেফের তথ্যমতে শিশুবিবাহের হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। গত ৩০ বছরে শিশুবিবাহ আনুপাতিক হারে হ্রাস পেলেও গ্রামাঞ্চলে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমস্যাটা প্রকট। আইসিডিডিআরবি এবং পস্ন্যান বাংলাদেশের যৌথ জরিপ ২০১৩ মতে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত শতকরা ২৬ জনের বিয়ে হয়েছে পূর্ণ বয়স্কা হওয়ার আগেই এবং নিরক্ষর নারীদের ক্ষেত্রে এই হার শতকরা ৮৬, ইউনিয়ন পরিষদের স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলো কার্যকর করা হলে শিশুবিবাহের মাত্রা অনেকাংশে কমে যাবে বলে মনে করেন বোদ্ধামহল। এটি প্রতিরোধে করণীয় এবং শাস্তি সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের বিলবোর্ড, পোস্টার প্রকাশ এবং তৃণমূলে তা ছড়িয়ে দেয়া জরুরি। সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শিশুবিবাহ বন্ধ করতে পরিবার থেকেই এ প্রক্রিয়া শুরু করা প্রয়োজন। কন্যাশিশু ও নারীকে অবজ্ঞা, বঞ্চনা ও বৈষম্যে রেখে কখনোই একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত এবং আদর্শ দেশ ও সমাজ গড়ে উঠতে পারে না। এই বাস্তবতায় নারী ও কন্যাশিশুর শিক্ষার বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষা কন্যাশিশুর উন্নয়ন, বাল্যবিবাহ রোধ এবং শিশু মৃতু্যর হার কমানোর নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। সেটি কন্যাশিশুর জন্য সর্বোচ্চ বিনিয়োগের মধ্যদিয়ে শুরু করা চাই। পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে তাদের জন্য সমসুযোগ ও সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার। তাদের ব্যাপারে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।

পাশাপাশি সরকারকেও পালন করতে হবে দায়িত্বশীল ভূমিকা। তাহলেই কন্যাশিশুর অধিকার রক্ষায় আমাদের অঙ্গীকার এবং প্রত্যাশা পূরণ হবে। তাদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা চাই। আর এই মানবসম্পদ গড়ার প্রক্রিয়াটি শুরু করতে হবে কন্যাশিশুর জন্মলগ্ন থেকেই। মনে রাখতে হবে, আজকের শিশুকন্যা আগামীর একজন মহীয়সী নারী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<67615 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1