বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

গণমাধ্যমে নারী

বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকদের ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন এবং আফ্রিকার মতো যুদ্ধপ্রভাবিত দেশগুলোর সাংবাদিকদের মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় না। আমাদের দেশের নারী সাংবাদিকরা কেবল স্থানীয় এবং জাতীয় সংবাদ সংগ্রহ করে থাকেন। সারা বিশ্বের সংবাদ সংগ্রহের প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে মানুষ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এক সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ের সংবাদ পেতে আগ্রহী। এ কারণেই আমি মনে করি, বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে হলে গণমাধ্যমে নারীদের অবশ্যই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে।
নতুনধারা
  ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

নারীরা সাংবাদিক হিসেবে আমাদের দেশের পাশাপাশি অন্যত্রও উলেস্নখযোগ্য কাজ করে চলেছেন। তবে আমাদের দেশে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক উভয় মিডিয়ায় তাদের সংখ্যা প্রত্যাশার চেয়ে কম। এ জন্য আমাদের দরকার বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া এবং নারীদের সুযোগগুলো খুঁজতে উৎসাহিত করা।

আমেরিকান সাংবাদিক মেরি টেম্পল বায়ার্ড নারীদের সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে তার নিবন্ধে লিখেছেন, 'সংবাদপত্র জনসাধারণের শিক্ষকস্বরূপ। যে সব পুরুষ ও নারী সংবাদপত্রে লেখালেখি করেন, তারা জনমত গঠনে সর্বোত্তম সুযোগ পান। তারা জানেন, তাদের সহকর্মীরা সমালোচিত হন, সর্বদা সহানুভূতিশীল নয়; উভয় লিঙ্গের জন্য বিশেষত প্রস্তুতকৃত বা মসৃণ কোনো রাজকীয় পথ নেই। সাংবাদিকতায় নারীদের জন্য একটি সূক্ষ্ণ ক্ষেত্র এবং কোনো অনুগ্রহ অবশ্যই যথেষ্ট নয়। যে সাংবাদিকরা সাংবাদিকতায় সফল হয়েছেন, তারা সাংবাদিক হিসেবেই সফল হয়েছেন, নারী হওয়ার কারণে নয় এবং একই পথে পুরুষরাও সফল হয়েছেন।'

সম্প্রতি আমাদের দেশের নারী সাংবাদিক আয়োজিত একটি কর্মশালায় বক্তারা বলেছিলেন, 'অন্যায় আচরণ নারীদের সাংবাদিকতায় নিরুৎসাহিত করে। নারী সাংবাদিকদের পেশা বহাল রাখতে, উৎসাহিত করতে তাদের কাজের স্বীকৃতি এবং সম্মানজনক বেতনের প্রয়োজন।' বিশেষজ্ঞরা বলছেন, 'ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট উভয় মিডিয়ায় সাংবাদিকতায় নারীদের অংশগ্রহণের হার গত কয়েক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন সমস্যার কারণে এই পেশাটি ছেড়ে দিচ্ছেন।'

নারী সাংবাদিকদের প্রতি সংকীর্ণ মনোভাব, অন্যায় আচরণ, পুরুষ সহকর্মীদের দ্বারা হয়রানি এবং চাকরির নিরাপত্তাহীনতাকে পেশা ত্যাগের প্ররোচিত কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপিকা ড. গীতিয়ারা নাসরিন বলেছেন, 'সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণগুলো সাংবাদিকতায় নারীদের প্রবেশাধিকার বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গত কয়েক বছরে নারী সাংবাদিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সাংবাদিকতার মূল ধারায় মাত্র ৪ শতাংশ নারী রয়েছেন।'

কর্মশালায় বক্তারা উলেস্নখ করেছিলেন, 'অনেক গণমাধ্যম অফিসে পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় নারীদের কম বেতন দেয়া হয় এবং তারা প্রচুর সামাজিক চাপ এবং গতিশীলতার সমস্যার মধ্যেও কাজ করে থাকেন।' অংশগ্রহণকারীরা গণমাধ্যমে লিঙ্গ ভারসাম্যহীনতা অপসারণের আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, 'পুরুষদের মতো নারীদের সমান সুযোগ উপভোগ করতে দেয়া প্রয়োজন। পুরুষ সাংবাদিকদের মতো নারীদের কঠোর পরিশ্রম করতে উৎসাহিত করা উচিত।'

একটি রেডিও চ্যানেলের সাংবাদিক শান্তা মারিয়া আমাকে বলেছিলেন, 'অনেক পুরুষ সহকর্মীই নারীদের তুচ্ছ করে দেখেন না এবং অনেক মিডিয়া হাউসে নারীদের খেলাধুলা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয় না। নারীদের ঢাকার বাইরে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয় না। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া প্রিন্ট মিডিয়ার চেয়ে এই ধরনের ইসু্যতে কিছুটা উদার।' শান্তা মারিয়া আরও বলেন, 'সাংবাদিকতায় নারীদের সুযোগ আছে এবং তারা বৈষম্যগুলো কাটিয়ে উঠছে এবং ভালো করছে। তবে তাদের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে পার হতে হচ্ছে।'

নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের (সেন্টার ফর ওমেন জার্নালিস্ট) সভাপতি নাসিমুন আরা হক একবার আমাকে ফিচার রাইটিং কর্মশালায় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি পর্যবেক্ষণ করেছিলাম, নারীরা গণমাধ্যমে কাজ করতে আগ্রহী ছিল। তাদের প্রতিভা রয়েছে এবং তারা পুরুষদের মতো কঠোর পরিশ্রম করতে সক্ষম। দেশব্যাপী আরও সাংবাদিক এবং লেখক পেতে নারী লেখকদের নিয়ে একটি ফোরাম গঠনের পরামর্শ দিয়েছিলাম আমি। তিনি সম্মত হন এবং সেই অনুযায়ী ফোরাম গঠন করেন। তার এমন উদ্যোগ গ্রহণ ও নারীদের সাংবাদিকতায় যোগদানের উপায় অনুসন্ধানের জন্য আমি তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম।

সাংবাদিক সুলতানা রহমান একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়া হাউসে কাজ করেন। তিনি বলেছিলেন, 'নারীরা কাজের প্রতি দায়বদ্ধ এবং আন্তরিক। আমি একজন নারী হিসেবে যে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থার কাছ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করার সুযোগ-সুবিধা পাই। সুতরাং, আমি দায়িত্ব নেই এবং আমার নির্ধারিত কাজটি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে করি, যাতে কেউ আমার সংজ্ঞা দিতে না পারে 'নারী রিপোর্র্টার' হিসেবে। লিঙ্গ বিবেচনা না করে একজন সাংবাদিক হিসেবে আমাকে অবশ্যই স্বীকৃতি পেতে হবে। নারীদের সাংবাদিকতায় যোগ দিতে এবং বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো গ্রহণ করতে আমি উৎসাহিত করি। কারণ আমি বিশ্বাস করি, সাংবাদিকতা নারীদের জন্যও একটি পেশা।'

সাংবাদিক ফারহানা মিলি প্রিন্ট মিডিয়া কাজ করেন। নারীদের সাংবাদিকতাকে তিনি পেশা হিসেবে দেখছেন বলে আশাবাদী, যদিও এখনকার মতো দশ বছর আগে এমন ছিল না। মিলি বলেন, 'সংবাদপত্রগুলোর উচিত একই কাজের জন্য পুরুষ সাংবাদিকদের মতো নারী সাংবাদিকদের একই বেতন দেয়া।'

বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকদের ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন এবং আফ্রিকার মতো যুদ্ধপ্রভাবিত দেশগুলোর সাংবাদিকদের মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় না। আমাদের দেশের নারী সাংবাদিকরা কেবল স্থানীয় এবং জাতীয় সংবাদ সংগ্রহ করে থাকেন। সারা বিশ্বের সংবাদ সংগ্রহের প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে মানুষ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এক সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ের সংবাদ পেতে আগ্রহী। এ কারণেই আমি মনে করি, বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে হলে গণমাধ্যমে নারীদের অবশ্যই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে।

সাংবাদিকতায় নারীদের অংশগ্রহণ এবং তাদের নানাবিধ অর্জন থাকা সত্ত্বেও অনেক সমস্যা রয়েছে, যা জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ইউনিয়ন দ্বারা সমাধান করতে হবে। নীতি নির্ধারণ এবং পরিচালনা কমিটিতে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে তাদের নিজস্ব কাঠামোয় সংস্কার করতে হবে।

বেশিরভাগ দেশে নারী সাংবাদিকের সংখ্যা বাড়ছে। ফিনল্যান্ড, থাইল্যান্ড বা মেক্সিকোতে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নারীদের হার শতকরা প্রায় ৫০ শতাংশ। শ্রীলঙ্কা বা টোগোতে এর চেয়ে প্রায় ৬ শতাংশের কম। নারী সাংবাদিকদের গড় হার ৩৮ শতাংশ। দশ বছর আগে একটি আইএফজে জরিপে গড়ে ২৭ শতাংশ নারী সাংবাদিক পাওয়া গিয়েছিল। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা এখনও মর্মান্তিকভাবে কম। যদিও বিশ্বজুড়ে শ্রমজীবী সাংবাদিকদের এক তৃতীয়াংশের বেশি প্রতিনিধিত্ব করেন, তবুও নারী সম্পাদক, বিভাগীয় প্রধান কিংবা গণমাধ্যম মালিকের হার মাত্র ০.৬ শতাংশ।

১৯৫১ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ১০০তম পারিশ্রমিক কনভেনশন আয়োজন করেছিল। এটি অন্যতম মূল মৌলিক আইএলও কনভেনশন। আইএলও সম্মেলন হলো আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং একবার কোনো দেশ কোনো সম্মেলনের অনুমোদনের পরে এটি জাতীয় আইন ও অনুশীলনে প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়। কনভেনশনটি নির্ধারণ করেছে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ছাড়াই পুরুষ এবং নারী কর্মীদের কাজ করার জন্য সমান পারিশ্রমিক দিতে হবে। এটি সদস্য রাষ্ট্রকে জাতীয় আইন বা সম্মিলিত চুক্তির মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করে। একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং লেখক রেবেকা ওয়েস্ট বলেছেন, 'সাংবাদিকতা হলো জায়গা পূরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার ক্ষমতা।'

অনুবাদক: মোহাম্মদ অংকন, শিশুসাহিত্যিক

মূল লেখক: পারভেজ বাবুল, কবি ও সাংবাদিক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<66864 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1