মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

তাঁতিদের জীবন থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে হবে

তাঁত বাংলার ঐতিহ্য। আমাদের সংস্কৃতির পরতে পরতে মিশে আছে তাঁতশিল্পীর খটাং খট শব্দমন্ত্র। যে মন্ত্রে এক সময় প্রাচুর্য এসেছিল বাংলাদেশের বয়ন শিল্পে। কিন্তু কালক্রমে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও নানা কারণে এই শিল্প হয়েছে অবহেলিত ও ক্ষতির সম্মুখীন। সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছিলেন বিখ্যাত ডিজাইনার ও দশভূজার স্বত্বাধিকারী ডালিয়া মিত্র। তাঁত ও বয়নশিল্প নিয়ে কথা হলো তার সঙ্গে। আলাপচারিতায় উঠে এসেছে নারীদের কর্মযজ্ঞ ও তাদের ঘিরে ডালিয়া মিত্রের নানা পরিকল্পনার কথা। তার সঙ্গে চমৎকার আলাপচারিতার একাংশ নন্দিনীর পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন তাহমিনা সানি
নতুনধারা
  ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০
ডালিয়া ভট্টাচার্য মিত্র

আমার পুরো নাম কিন্তু ডালিয়া ভট্টাচার্য মিত্র। ভট্টাচার্য আমার বাবার দিককার টাইটেল, তবুও বিয়ের পরেও আমি সেটা রেখেছি। কেননা, আমি মনে করি, আগের পরিচয় চলে গেলে হবে না। ওটা আমাদের শেকড়। আর ওখান থেকেই কিছু শিখেছি বলে আজকে কিছু করতে পারছি। এই পরিপ্রেক্ষিতেই একটু বলি, আমি গ্র্যাজুয়েশন এবং হোটেল ম্যানেজমেন্টে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করেছি ভারতবর্ষের নামকরা ইনস্টিটিউট তারাতলা থেকে। তারপর আমি টিসিএসে জয়েন করি। টাটা কন্সালটেন্সি সার্ভিসে। এরপর অনেকটা দিন এভাবেই গড়ালো। আমার বিয়ে হলো। ছেলে হলো। তখন একটা ব্যাপারে আটকে গেলাম। আমি চাকরিটা করতে পারছিলাম না। তখন আমি হোটেল ম্যানেজমেন্টের ব্যবসা শুরু করি। ব্যবসাটা এ রকম- ভারতে যত বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আছে, যেমন- আইটিসি, হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়াম, ইন্ডাল, ফিলিপস ইত্যাদি কোম্পানির প্রপার্টিগুলো আমি গেস্ট হাউসের মতন বানিয়ে সেটা আমার কোম্পানি দিয়ে চালাতাম। আমার কোম্পানিতে ২৫ জন চাকরি করত এবং তারা সবাই প্রভিডেন্ট ফান্ড পেত, হেলথ ইনসু্যরেন্স ছিল, ১০ বছর চাকরি জীবনের পর তারা পেনশানও পেত। এই ব্যবসাটা আমি করেছি ২০ বছর। এই যে আমার ব্যবসা এটা চালানোর জন্য আমি যখন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতাম, তখন একটা ব্যাপার আমার নজরে আসে। সেটা হলো, যারা বুননশিল্পী অর্থাৎ তাঁতি তারা প্রচন্ডভাবে এক্সপেস্নায়ডেড। মধ্যস্বত্বভোগীরা তাদের উপার্জন অধিকার হরণ করে নিচ্ছে। তখন আমার মনে হলো, এদের সঙ্গে যদি আমি কাজ করি তাহলে হয়তো এদের কোনো উপকারে আমি আসতে পারব, কিছুটা হলেও তো পারব। আর সেই আইডিয়া থেকেই আমার এই বুটিক কনসেপ্টে আসা। একটা কথা না বললেই নয়, আমার বুটিকের নাম দশভূজা। এখানে আমি নারী শক্তির প্রাধান্যটা রাখতে চেয়েছি। নারীর দশহাতের শক্তিই এই দশভূজা নামের সার্থকতা। আগের ব্যবসাটায় পুরুষ কর্মী থাকলেও এখানে সব জায়গায় রেখেছি নারীর কর্মযজ্ঞের প্রাধান্য। ব্যাপারটা আরো ব্যাখ্যা করি, ভারতে আমার ১০ জন ফ্রাঞ্চাইজি, তারা সবাই মহিলা, আমার বুটিকে যারা কাজ করে তারাও মহিলা। বলতে পারেন এটা আমার দশভূজার মোটো।

দশভূজায় আমার কাজ পরিচালিত হতো মূলত ন্যাচারাল ফাইবার বা প্রাকৃতিক তন্তু নিয়ে। যেমন কটন, রেশম, জুট ইত্যাদি তন্তু দিয়ে। বছর দুয়েক আগে আমার একটা রিয়েলাইজেশন হলো- এই যে দারুণ সব ফ্যাশন শোগুলো হয় সেখানের্ যাম্প মডেল হিসেবে সাধারণত থাকেন এনলাইটেড, এডুকেটেড বা প্রেজেন্টেবল সব মডেলরা। কিন্তু একটা এনজিওর সঙ্গে মিলে আমি ডিসিশন নিলাম একটা ফ্যাশন শো করব। কি চমৎকার, সে ফ্যাশন শোতে অংশগ্রহণ করেছিলেন একেবারে স্বল্প আয়ের মহিলারা! কেউ চপ ভাজেন, কেউ সবজি বিক্রি করেন। তাদের আমরা ট্রেইনড আপ করেছিলাম। আর তাদের সঙ্গে একই মঞ্চে হেঁটেছিলেন সেরা নাচিয়ে, সেরা ডক্টর, বিভিন্ন সেলিবেট্রি। আমরা বুঝিয়েছিলাম সেলিব্রেটি মানেই যে তাকে টিভি বা মিডিয়ায় পরিচিত মুখ হতে হবে তা নয়, আমাদের প্রত্যেকের জীবনই সেলিব্রেশনের। এই শো-এর মাধ্যমে আমি দারুণ একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিলাম- যারা কোনোদিন ভাবেনি যে, তারা কোনদিনর্ যাম্পে হাঁটবে, অথচ তারাই বেশ কনফিডেন্স অর্জন করেছিল। একটা ইয়েস আমি ওদের চোখে দেখেছিলাম- ইয়েস উই ক্যান।

এই যে ভিন্ন কিছু করতে পারা এটা আরো সমৃদ্ধি পেয়েছে আমার আরেকটি আইডিয়ায়। তা হলো গাছের তন্তু থেকে বস্ত্র তন্তু তৈরি করা। আর এই কাজটায় আমার সঙ্গে আছে আদিত্য বিড়লা গ্রুপ। এর প্রক্রিয়াটা বলি, বড় বড় গাছ যেমন, ইউক্যালিপটাস, সিডর, পাইন এসব গাছের কান্ড থেকে যেমন পেপার পাল্প হয় তেমনি উড পাল্প তৈরি করা হচ্ছে। তারপর তা থেকে তৈরি করা হচ্ছে সুতা। মূলত পরিকল্পিতভাবেই গাছগুলোর পস্ন্যানটেশন করা হচ্ছে। গাছগুলো রোপা হচ্ছে মধ্যপ্রদেশের কাছাকাছি অঞ্চলে। তা ছাড়া গাছগুলোর বয়স আট বছর হলে তবেই কাটা হচ্ছে আর এক একটা গাছ কাটার বিপরীতে আটটা করে নতুন গাছ লাগানো হচ্ছে।

অনেকেই হয়তো জানেন, শাড়িতে দুটো ধারা থাকে। একটা টানা, একটা বানা। বানায় আমরা ওই সুতাটা ব্যবহার করছি যার কমার্শিয়াল নাম লিভা। আর টানায় দেয়া হচ্ছে সুতি সুতা। শীতকালে টানায় দেয়া হবে সিল্ক সুতা। এই তন্তুও তৈরি পোশাক অত্যন্ত ইকোফ্রেন্ডলি। প্রাকৃতিকভাবেই ডিসপোজেবল। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে বেশ পরিমাণে সিনথেটিক সুতা ব্যবহার করা হচ্ছে যা প্রাকৃতিকভাবে পচতে অনেক সময় নেয়। এসব কাপড়ের ফেলে দেয়া অংশ, ছিন্ন টুকরো প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করছে, নদী খাল নর্দমায় আটকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে। তা ছাড়া সবচেয়ে কষ্টের দিক যেটা, এসব কাপড় আধুনিক যন্ত্র এবং পাওয়ার লুমে তৈরি হচ্ছে। এতে কিন্তু তাঁতিরা মার খাচ্ছে। কিন্তু এই যে আমার প্রতিষ্ঠানের প্রাকৃতিক সুতার বুনোন এটা কিন্তু একদিক থেকে রিভাইবাল অব হ্যান্ডলুমসও! আমি চাই তাঁতিদের ওপর থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমে যাক। বিশেষ করে বাংলাদেশের তাঁতিরাও কিন্তু এ পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা অবহেলিত। তাই এই যে বাংলাদেশে এসেছি, এখন আমি তাদের নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনা করছি। বাংলাদেশের অনেক উদ্যোক্তা এবং ডিজাইনাররা উৎসাহ প্রকাশ করেছেন। ইচ্ছা আছে সবকিছু ঠিক ঠাক থাকলে সবাইকে নিয়ে আমার এই কর্মযজ্ঞ এগিয়ে যাবে এবং ঢাকাসহ বাংলাদেশের মার্কেটে পরিবেশবান্ধব এই তন্তুর পোশাক সবাই বাজেট ফ্রেন্ডলি ওয়েতেই কিনতে পারবে। বাংলার ঐতিহ্যবাহী তাঁত ও তাঁতি শিল্পীদের মধ্যে নতুন জাগরণ সৃষ্টি করতে পারলে সেটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<64973 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1