শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পৃথিবীতে যে নতুন শিশু

সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থা এবং পরিবারের এই চর্চা এর মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে কন্যাশিশুর মানসিকতা সংকুচিত হয়, শারীরিকভাবে দুর্বল হয় এবং তার চলাফেরা ও তাকে গড়ে তোলার সুযোগ সীমিত হওয়ার কারণে আস্তে আস্তে পুত্র এবং কন্যার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়, ফলে পুত্র হয়ে ওঠেন শক্তিশালী, পরাক্রমশালী ও কন্যা অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রকৃতির...
সোরিয়া রওনক
  ১০ জুন ২০১৯, ০০:০০

আমাদের পরিবারে যখন দুটি শিশুর জন্ম হয়, সেই শিশু দুটির ওজন, চেহারা, ভিন্নতা এবং তাদের শক্তি, চিন্তা, কান্না, হাসি কোনো কিছুই পার্থক্য থাকে না; কিন্তু দেখা যায়, সেই শিশুটি যখন আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে তার আশপাশের যে পরিবেশ, পরিবার, সমাজ আস্তে আস্তে মনে করিয়ে দেয় যে তুমি কন্যাশিশু, তোমার জন্য একটি নির্দিষ্ট এরিয়া আছে এবং তুমি জোরে হাসতে পার না, জোরে কাঁদতে পার না, তোমার চাহিদার একটা সীমানা থাকবে। কিন্তু ছেলে শিশুটিকে অবাধ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় এবং তাকে তার যত ধরনের বিনোদন বা তার উচ্ছলতা প্রকাশ করার সুযোগ, তার চলাফেরা বা তার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করার সুযোগের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সীমা নির্ধারণ করা হয় না। এ ছাড়া খাবার-দাবারের বৈষম্যের কারণে পুষ্টির দিক থেকে মেয়েশিশুটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে থাকে। যখন একটি কন্যাশিশু গর্ভে থাকে তখনো যদি আলট্রাসনোগ্রাফ বা অন্য কোনো মাধ্যমে জানতে পারা যায় যে কন্যাশিশু জন্ম হবে সেই ক্ষেত্রে মায়ের ওপর কন্যাশিশুর ভ্রূণ অবস্থা থেকেই নির্যাতন শুরু হয় এবং কন্যাশিশুটির যখন জন্ম হয় জন্মের সময়ও তাদের যে স্বাগত জানানো হয় সেই একটি পুত্রশিশুকে যেভাবে স্বাগত জানানো হয় সে ক্ষেত্রে কন্যাশিশুকে সেভাবে জানানো হয় না। পুত্রশিশুকে আড়ম্বরভাবে এবং কন্যাশিশুকে অনাড়ম্বরভাবে স্বাগত জানানো হয়।

সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থা এবং পরিবারের এই চর্চা এর মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে কন্যাশিশুর মানসিকতা সংকুচিত হয়, শারীরিকভাবে দুর্বল হয় এবং তার চলাফেরা ও তাকে গড়ে তোলার সুযোগ সীমিত হওয়ার কারণে আস্তে আস্তে পুত্র এবং কন্যার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয় ফলে পুত্র হয়ে ওঠেন শক্তিশালী, পরাক্রমশালী ও কন্যা অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রকৃতির। পুত্রশিশুর চলাফেরা গন্ডি অনেক বড় হওয়ার কারণে সামাজিক, সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের জন্য যোগ্য করে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। কন্যাশিশুর সেই ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে থাকে এর মাধ্যমে পুত্র-কন্যা বা ছেলেমেয়ের মধ্যে পার্থক্য শুরু হয়। পরবর্তিতে সংসার জীবনে সবই আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি একটি মেয়ে যখন জন্ম হলো সেসবকে ভালো রাখার জন্য, সবকে খুশি রাখার জন্য বা সবাইকে সেবা-শুশ্রূষা করবে, সে সহযোগী হিসেবে কাজ করবে এবং পুত্র সে নেতৃত্ব করবে সংসারের হাল ধরবে, সম্পত্তি রক্ষা করবে এবং শেষ বয়সে বাবা-মাকে দেখবে কিন্তু বাস্তবে আজ তার উল্টো চিত্রও দেখতে পাই এখন মেয়েরা উপার্জন করছে, সংসার পরিচালনায় অর্থের জোগান দিচ্ছে, বাবা-মায়ের ভরণপোষণসহ নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করেছে। এই যে বৈষম্য পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে তৈরি হয় এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নারী ভোগের বস্তু, নারী একটু দুর্বল, নারী মমতাময়ী এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে কন্যা এবং পুত্রশিশুরাও, তাদের মধ্যেও এই মানসিকতা আস্তে আস্তে দৃঢ় হতে থাকে, মেয়েশিশুটির মধ্যেও দুর্বলতা আস্তে আস্তে ঢুকিয়ে দেয়া হয় এবং মেয়েটিকে অর্ধেক ও দুর্বল মানুষে পরিণত করে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ যখন '৭০-এর দশকে পথচলা শুরু করে পরে বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের কাজ শুরু করে এবং ২০০২ সাল থেকে যখন স্কুল, কলেজে সিদ্ধেশ্বরী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে প্রথম তরুণীদের সঙ্গে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয়ে মতবিনিময়ের কাজ শুরু করা হয়। সেখানে যখন নারী নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয়ে কথা বলতে যাই তখন মেয়েরা কান্নায় ভেঙে পড়ে তারা বলে আমাদের কেন বলছেন আমাদের বাবা-মাকে বলেন, আমাদের শিক্ষকদের বলেন, রং নাম্বারে ফোন আসলে আমাদের বকাঝকা করা হয়। তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে আমরা যৌন নিপীড়ন বিষয়ে শব্দটার সঙ্গে আবার আরেকভাবে পরিচিত হলাম এবং পরে যৌন নিপীড়ন বিষয়ে সারাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী তরুণ-তরুণী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিবাবকদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে সুপারিশ পাওয়া যায়। প্রাপ্ত সুপারিশমালা ল' কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রশাসন বরাবর ধারাবাহিকভাবে দেয়া হয়। মহিলা পরিষদের বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা বা আপনার আশপাশে যদি তাকাই এই উত্ত্যক্তের ঘটনাগুলো কেন ঘটে? পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং পরিবারে বেড়ে ওঠায় নিরাপত্তার অভাব, অনেক সময় কন্যাশিশুকে কোলে নিয়ে আস্তে করে গায়ে হাত দেয়া হয়, যেমন মামা, চাচা, কাজিন দ্বারা শিশুরা নিপীড়নের শিকার হয়। ছোট শিশু নির্যাতন বুঝতে পারে না- সে বুঝতে পারে না কি তার হচ্ছে কিন্তু মানসিকভাবে সংকুচিত হয়, সেটা অভিভাবকরাও বুঝতে পারেন না। ছোট কন্যাশিশুটি আস্তে আস্তে যখন বড় হয় রাস্তায় যায় বা বাসে উঠে আস্তে করে বাসের হেলপার গায়ে হাত দিয়ে উঠিয়ে দেয় বা রিকশা থেকে নামার সময় রিকশাওয়ালা কটূক্তি করে। সেই ক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের কারণ আমরা যেগুলো দেখেছি যে সন্তানের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পিতা-মাতার একটা উদাসীনতা ছিল, তাদের সচেতন করা হয়নি, ছেলেমেয়ের মধ্যে বৈষম্য, পিতা-মাতার মধ্যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক এবং পরিবারে নারীর প্রতি যদি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গি না থাকে, মাদকাসক্তের কারণে বা দারিদ্র্যতার কারণে, নিরাপত্তাহীনতার কারণ থাকে, রাজনীতির কারণে এবং নারীর প্রতি সমতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির অভাব উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানি যে অপরাধ সেটারও প্রচারণার অভাব। এ ছাড়া এটা যে একটা অপরাধ এটাও মানুষ জানে না সে কারণেও অনেক সময় এ ধরনের নিপীড়নের ঘটনা ঘটায়।

স্কুল, কলেজ, কর্মস্থলে বখাটেদের উৎপাত বন্ধ করা এই প্রতিষ্ঠানের ভেতরে যদি কোনো বখাটেদের উৎপাত হয় এটিও বন্ধ করার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের। তরুণ-তরুণীদের মনে রাখতে হবে যারা উত্ত্যক্ত করছেন তারাই অপরাধী আমরা যারা উত্ত্যক্তের শিকার হচ্ছি তারা কোনো অপরাধ করিনি। কেউ আবেগপ্রবণ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে না নিই। প্রতিবাদ করি আমরা, সংগঠিত হই এবং সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করি। প্রথমেই কোনো বড় ঘটনা ঘটে না, প্রথমে একটু স্পর্শ করে বা ইঙ্গিত করে তখনই যদি আমরা প্রতিরোধ করতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় হাইকোর্টের রায়ের আলোকে অভিযোগ কমিটি গঠন করা হবে এবং সেই সঙ্গে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। যা নিপীড়ন ও উত্ত্যক্তকরণ বন্ধে প্রতিরোধের নীতিমালা, সে নীতিমালাটি অবশ্যই প্রণয়ন করতে হবে এবং নীতিমালার আলোকেই কমিটি কাজ করবে এবং কমিটি পরে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগের নিষ্পত্তিতে তদন্ত করবে, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণসহ প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<52840 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1