শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শতাব্দীর একাল-সেকাল

নতুনধারা
  ২০ মে ২০১৯, ০০:০০

মুশফিকা মোশাররফ শিলু

(পূর্ববর্তী সংখ্যার পর)

আগে আমরা বিয়ের দাওয়াত খেতে যেতাম; এখন আমরা 'ওয়েডিং পার্টি'তে যাই। আগে আমরা কারও জন্মদিনে, এক পিস ফ্রুট কেক, একটু চানাচুর, অর্ধেকটা সাগর কলা আর বড়জোর একটা রসগোলস্না খেতে পেতাম। এই রসগোলস্নাটা শুধু বিত্তবান পরিবাররা দিত! বিত্তবানরা কদাচিৎ ক্রিম ফ্রস্টিং কেকও দিত। এখন আমরা জন্মদিন, বিয়ে, মুসলমানি, বৌভাত কিছুই পার্থক্য করতে পারি না। কাচ্চি বিরিয়ানি, পোলাউ, কালিয়া, কাবাব, বোরহানি, কত ধরনের মোঘলাই খাবারের আয়োজন হয় জন্মদিনেও! সবতেই এত জাঁকজমক! চাকচিক্য! হারিয়ে যেতে হয় অজানায়। আরো কত যে পরিবর্তন হতে থাকবে এ সমাজে! তা বলে শেষ করা যাবে না। আরো একটা পরিবর্তন না বললেই নয়, আগে আমরা সাদা-কালো ছাপানো বই পড়তে ভালোবাসতাম। বইমেলায় গিয়ে পছন্দের অনেক অনেক বই ধার করে হলেও কিনতাম। প্রিয়জনকে এক খানা বই দিতে পারা যে আনন্দ সেটা কি আর কোনদিন অনুভব করতে পারব? এখন ল্যাপটপের স্ক্রিনে, অনলাইনে চোখে চশমা লাগিয়ে পড়তে ভালোবাসি। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের যে কোনো খবর অনায়াসেই ঘরের এক কোণে চেয়ারে বসেই পাওয়া যায়; ঘর হতে এক পাও বের হতে হয় না। কোনো বন্ধুমহল তৈরি হয় না আজকাল। আমরা আগে বন্ধুর আড্ডায় অনেক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতাম। রাত জেগে পড়াশোনা করে পরীক্ষা পাসের যে আনন্দ কুড়িয়েছি, তা আজকাল আর পাওয়া যায় না; কারণ, আজকাল অনলাইন কোর্স করেও বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করা যায়। আর কত বলব?

এবার একটু নদীর কথা বলি? আমরা তিন ভাইবোন আগে বছরে একবার দাদা বাড়ি, নানা বাড়ি যেতাম লঞ্চে চেপে। সে আনন্দ আর বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। ছয়-সাত ঘণ্টা জলের উপর দিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার আনন্দ এই প্রজন্ম থেকে পরবর্তী কোটি কোটি প্রজন্ম অনুভবই করতে পারবে না। নদীর ধারঘেঁষে দৌড়ে বেড়ানো, নদীর মাছের ঝোলে গাল ভরে ভাত খাওয়া, নৌকায় ভেসে বেড়ানো, শাপলা শালুক, ঢ্যাপ কুড়িয়ে খাওয়া! আহ এই আনন্দ আর কোনো দিনও পাওয়া যাবে না। গ্রামে গিয়ে, শাপলা তুলে তাতে তেঁতুল চটকে গুড় দিয়ে মেখে খাওয়া! সেই অমৃত স্বাদ এরা পাবে না, এরা অবশ্য পেতেও চায় না। গ্রামের সেই ঝিঁঝিঁ ডাকা সন্ধ্যের অনুভূতি হারিয়ে গেছে, কুপির আলোতে উঠোন পেরিয়ে টয়লেট যাওয়ার অভিজ্ঞতা আর হয় না, পুকুরে ডুব সাঁতার দেয়া যায় না; কারণ, পুকুর তো সব ভরাট হয়ে যাচ্ছে আর সেখানে বাড়ি হচ্ছে মানুষের থাকার জন্য। নতুন ধানের পিঠা পায়েস নেই! তার বদলে ঘটা করে মেকি পিঠা উৎসব আছে।

গাছের পাকা ফলমূলের স্বাদ হারিয়ে যাচ্ছে। এখনকার সময়ের একটা বিজ্ঞাপনে আমার চোখের জল বাঁধ মানেনি, একটু খেয়াল করলে আমার মতো আপনাদেরও অনেকের মন খারাপ হবে। বিজ্ঞাপনে দেখানো হচ্ছে, একটি ছোট্ট শিশু দশ কি বার বছরের; ছেলেটির মন খারাপ; কারণ তাদের বাগানের সব আম কোনো একটা ফ্যাক্টরির গাড়ি, বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপন দাতারা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটিকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, 'এখন থেকে সব আম সুদৃশ্য বোতলে প্যাক হয়ে আবার তোমার কাছেই ফিরে আসছে, সুতরাং মন খারাপের কোনো কারণ নেই' এই বাণী শেষে দেখা গেল গাছের ডালে ম্যাংগো জুসের বোতল ঝুলছে আর সুন্দরী নারী সেই বোতলে চুমুক দিয়ে তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। পাঠক মন খারাপ হলো কিনা বলেনতো! আম কেন? অনেক ফলই আমরা এখন ক্যানে করে পাই, চিনির জলে ডুবিয়ে জারক হিসেবেও পাই। গাছ থেকে পেড়ে কোচর ভর্তি করে ফল নিয়ে বাড়ি ফেরা, প্রকৃতি থেকে পাওয়া তাজা ফল খাওয়া আর কোনোদিন কি হবে?

সমাজ, রাষ্ট্র, দেশ পরিবর্তনের বিপক্ষে নই আমি। আমরা অবশ্যই বদলের ভেতর দিয়ে জীবনযাপন করব, তবে আমার অনুভূতি হলো এই যে, আমরা পরিবর্তনগুলো সে পর্যন্তই নেব, যে পর্যন্ত নিলে মানবজন্ম, সভ্যতা ক্রমশই একা হয়ে পড়বে না, মানব জীবন ক্রমশই একটা বিশাল গহীন অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকবে না।

পরিবর্তনের সমাজ গুরুজনবিহীন হয়ে পড়বে না। গুরুজনদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নামে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠবে না। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নামে নারী আরো সহিংসতার মুখোমুখি হবে না। শিশুদের কোমলমতিপনা দূর হয়ে শিশু বয়সেই বড়দের মতো মতামত দেবে না। পরিবর্তন হোক এমন যেন শিশুদের বেড়ে ওঠার প্রতিটি স্তর উপভোগ করা যায়, পরিবর্তন হোক এমন যেখানে গ্রামের পরিবেশ বজায় থাকবে আবার মানুষের জীবনযাপন সচ্ছন্দেরও হবে। গ্রামের স্বাদ, গ্রামের আবহ থাকলে শহর কি হেরে যাবে? না কি শহর থাকলে গ্রাম হেরে যাবে? গ্রাম ও শহর দুজনেই উইন-উইন হতে পারে না? পরিবর্তনের ধারা আমরাই তো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। (চলবে...)

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<50171 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1