শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শতাব্দীর একাল-সেকাল

নতুনধারা
  ১৩ মে ২০১৯, ০০:০০

মুশফিকা মোশাররফ শিলু

আমরা একবিংশ শতাব্দীতে জীবনযাপন করছি। সীমাহীন প্রযুক্তির পুরোটাই আকণ্ঠ গলধঃকরণ করছি। নাহ্‌, বরঞ্চ বলতে পারি প্রযুক্তিই আমাদের গিলে খাচ্ছে!

আগে মানুষ জমি কিনতো, ধীরে ধীরে পয়সা জমিয়ে, অথবা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে নিজের পছন্দের বাড়ি বানাতো। এখন? এখন আমরা কোটি কোটি টাকা দিয়ে ইট, বালি, সিমেন্ট, কিছু নক্সা করা লোহা, পস্নাস্টিকের দরজা-জানালা কিনি; তাও আবার সেগুলো শূন্যে ভাসতে থাকে। জমিনে আর থাকা হয় না আমাদের, কারণ জমিনটা থাকে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য। তার পর থেকে শুরু হয় মানুষের বসবাস! তাহলে? মানুষ তো শূন্যেই বাস করছে তাই না?

আগে আমাদের বাবা-মা বকাবকি করে ভালোমন্দের ফারাক বোঝাতেন, সমাজে কী করতে হবে, কী করা উচিত নয় তা নরমে-গরমে বোঝাতেন। এ রকম পারিবারিক গঠনেই আমরা বড় হয়েছি, মানুষ হয়েছি। আর আজ? আজ আমরা আমাদের বাচ্চাদের কিছুই বলতে পারি না। বকাবকি? সেতো অনেক দূরের ব্যাপার! বুঝিয়ে বলতে গেলেই বিজ্ঞের মতো থামিয়ে দিয়ে বলে, 'আম্মু-বাবা, এ বিষয়ে গুগলে বলা আছে, জেনে নেব।' মানে বাবা মা বা গুরুজনের থেকে কিছু শিখতে চায় না ওরা। গুগলই তাদের সব কিছু! এই হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর বাচ্চা! এখন শিশুদের 'না' বলা যায় না; ওদের বেড়ে ওঠার সময় 'না' শব্দটির অস্তিত্ব থাকবে না; শিশুরাও বড়দের মতো করে পরিকল্পনা করবে, পছন্দ করবে, সিদ্ধান্ত নেবে। আঠারো বছর পেরোলেই ওরা যা ভালো মনে করবে, তাই করতে দিতে হবে। সত্যিই কি তাতে শিশুরা পূর্ণ বিকাশ পায়? আমার তো মনে হয় না। ওরা এই অবাধ স্বাধীনতায় বড় হতে হতে কোনো মঙ্গলময় জীবনবোধ পায় না। যা ইচ্ছে তাই করার স্বাধীনতা মানুষকে জীবনবোধ থেকে অনেক দূরে রাখে। মূল্যবোধ তৈরিই হয় না।

আমরা বাবা-মা, নানা-নানি, খালা-মামা, চাচা-ফুপু, ভাবী-বোন, দাদা-দাদির থেকে গল্প শুনে সমাজকে চিনেছি। কোথায় বিপদ আছে, কোথায় সমাধান আছে- সেগুলোও এই মুরব্বিদের (গুরুজন) থেকে শিখেছি। এখন ঠাকুমার ঝুলি টিভি চ্যানেলে প্রচার হয়। রাক্ষস-খোক্ষসের গল্পও এখন টিভি চ্যানেলেই বন্দি। ভূতের গল্প শুনতে পাওয়া যায় এফএম রেডিওতে! দুই কানের ভেতর ইয়ারফোন লাগিয়ে একা একা ভূতের গল্প শোনে আর ভয় পাওয়ার ভান করে রাত পার করে। রাত ভোর হলে ওই ভূতের গল্প অন্য কাউকে বলতে পারে না, কারণ ভূতের গল্প ভুলে যায়। কেন ভুলে যায়? কারণ, ভূতের গল্প শেষে রাতের বাকি অংশে ইউটিউবে আরো অন্য আবেদনময় বিনোদনে ডুবে থাকে। অনেকের কাছে রাত জাগা একটা বাহাদুরির বিষয়! এর পর ভোরের দিকে চোখের পাতা এক হয়ে আসে আর দুপুর পর্যন্ত বিভোর ঘুম! এ প্রজন্মের কাছে দিন রাতের কোনো সীমা নেই, মনটাও কোনো কিছুতেই স্থির থাকে না ফলে আগের রাতে শোনা ভূতের গল্প মনে রাখা আর সম্ভব হয় না আর এর জন্য কোনো আপসোসও থাকে না ওদের।

একবিংশ শতাব্দীর এই জীবনে গুরুজনদের কোনো প্রয়োজন নেই, জ্ঞান দেয়ার জন্য গুগল মামার থেকে বিশ্বস্ত আর কেউ নেই। গুরুজনদের ফেলে আসা জীবনের কাহিনী শোনার কোনো আগ্রহ নেই এ শতাব্দীর মানুষের। গুরুজনদের আমরা এখন সিনিয়র সিটিজেন বলি, ওদেরকে মেকি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি। বৃদ্ধাশ্রম বানাই, সেখানে তাদের একা একা ফেলে রাখি নিজেদের ব্যস্ত সময়ের অজুহাত দিয়ে। পরিবারগুলো এতটাই অনুপরিবার (নিউক্লিয়ার) হয়ে গেছে যে, ঘরে দাদা-দাদি, নানা-নানির থাকার জায়গা হয় না। একবিংশ শতাব্দী বলে কথা! কত প্রযুক্তি, বিনোদনের হরেক উৎস এত আনন্দের ভীরে গুরুজনরা বাড়তি ঝামেলা। বিজ্ঞের মতো মতামত দেয়, 'কি হলো গড় আয়ু বেড়ে গিয়ে ষাটোর্ধ একজন মানুষ সমাজকে কি দিতে পারে? অন্যের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকার কি মানে?" পাঠক এইরকম কথা শুনে আমাদের (যারা আমরা এই শতাব্দীর নই) মেজাজ কি ভালো থাকে? কিন্তু প্রযুক্তির দাপটে এই ভাবনাও নীরবে হজম করে যাচ্ছি।

আগে আমরা ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে একখানা আবেগময় চিঠির জন্য লম্বা সময় অপেক্ষা করতাম। রঙিন খামে ভরা, গোলাপের বা বেলী ফুলের পাপড়ি ছড়ানো আবেগঘন প্রেমিকের বা প্রেমিকার চিঠি পড়ে কত স্বপ্নই না বুনতাম! প্রেমে ব্যর্থ হয়ে জীবনের মানে হারিয়ে ফেলতাম। উত্তম-সুচিত্রার 'পথে হলো দেরি' সিনেমা দেখে ব্যর্থ মনকে সান্ত্বনা দিতাম; ক'ফোঁটা চোখের জল ফেললে ভালোবাসা সার্থক হবে সে নিয়ে কত সময় কাটাতাম! আজ মোবাইলের যুগে, এসএমএসের মাধ্যমে মুহূর্তেই পেয়ে যাই ভালোবাসার মানুষকে, মোবাইল ফোনেই প্রতিদিন প্রেমিক-প্রেমিকা আদর-সোহাগে ভেসে যায়, আবার মোবাইলেই রাগারাগি এবং ব্রেকআপ! ব্রেকআপের পর এক মুহূর্তও আর পুরনো প্রেমিক বা প্রেমিকার জন্য চোখে জল নেই, ফিরে পাওয়ার অপেক্ষা নেই, আবেগঘন স্মৃতি রোমন্থন নেই, অন্য একজন এসে শূন্যস্থান পূরণ করে নেয়। এভাবেই পরম্পরায় চলতে থাকে একবিংশ শতাব্দীর প্রেম, ভালোবাসা। চলবে...

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<49158 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1