শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
গণপরিবহনে

নারীর ভোগান্তি

গণপরিবহনে প্রতিনিয়তই নানা অসুবিধা ও হয়রানির শিকার হয়ে চলেছে নারী যাত্রীরা। সরকারি-বেসরকারি বাসগুলোতে তাদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এ ছাড়া ছোট ছোট যে গণপরিবহন রয়েছে তাতে চড়তেও নারীদের পড়তে হয় বাড়তি বিড়ম্বনায়। বাসগুলোতে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য নয়টির মতো সিট বরাদ্দ থাকে, যা কি-না প্রয়োজনের চেয়েও অপ্রতুল...
মুহাম্মদ কামাল হোসেন
  ২৯ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

প্রতিটি সরকার নারী সুরক্ষা আর কল্যাণে বেশ আন্তরিক। বেশ সগর্ভে বিষয়টা তারা উচ্চারণও করে থাকেন। পুরোপুরিভাবে না হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীর জীবন মান উন্নয়নে ও অগ্রযাত্রায় তাদের আন্তরিকতার চেষ্টা চোখে পড়ার মতো। তথাপিও অযাচিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা লেগেই থাকে। ঘটতে চলেছে একের পর এক নারী নিগ্রহ ও ভোগান্তির ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে গণপরিবহনে নারীর যৌন হয়রানি ও হত্যা করার বিষয়টিও মিডিয়ায় রীতিমতো হুলস্থুল ফেলে দিয়েছে। গণপরিবহন আজ নারীদের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে। নারীরা এখন আর গৃহবন্দি নয়। নারীদের পথে-ঘাটে চলাফের করতে হয়। আর চলতে ফিরতে গেলেই বিপত্তি বাধে। গণপরিবহনে নিত্য নারীদের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। তবে নগরায়নেই সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি প্রকট। কেননা, মফস্বলের তুলনায় এখানকার জীবনযুদ্ধ অনেক বেশি বেগবান, অনেক বেশি সচেষ্ট। এ কারণে নারীকে সদা-সর্বদা বাহিরে চলাফেরা করতে হয়। বর্তমান বিশ্বে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণা অনেক বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে নারীদের প্রতি সহমর্মিতা এবং সহযোগিতাও। তারপরও নগরীতে বসবাসরত কয়েক লাখ নারীকে প্রতিদিন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কর্মস্থলে যাওয়া ও আসার পথে পড়তে হয় নানাপ্রকার ভোগান্তিতে। যার অন্যতম একটি নগরায়নের গণপরিবহন।

জানা গেছে, গণপরিবহনে প্রতিনিয়তই নানাবিধ অসুবিধা ও হয়রানির শিকার হয়ে চলেছে নারী যাত্রীরা। সরকারি-বেসরকারি বাসগুলোতে তাদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এ ছাড়া ছোট ছোট যে গণপরিবহন রয়েছে তাতে চড়তেও নারীদের পড়তে হয় বাড়তি বিড়ম্বনাতে। বাসগুলোতে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য নয়টির মতো সিট বরাদ্দ থাকে, যা কিনা প্রয়োজনের চেয়েও অপ্রতুল। এ ছাড়া ওই আসনগুলো আবার অনেকটাই গাড়ির ইঞ্জিনের কাছাকাছি থাকায় প্রচন্ড গরম ও ধোঁয়ায় আছন্ন থাকে বিধায় নারীদের শাসকষ্টসহ নানাবিধ অসুখ হয়ে থাকে। অনেক সময় এসব অস্বাস্থ্যকর সংরক্ষিত আসনগুলোও পুরুষ যাত্রীদের দখল থেকে উদ্ধার করতে নারীদের রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। আসন না থাকলে নারীদের বাসে না উঠাতে চালক ও চালকের সহকারীদের নির্দেশও দেন কোনো কোনো যাত্রীরা। সংরক্ষিত নয়টি আসন ছাড়া অন্য আসনে বসলেও অনেক পুরুষযাত্রী তর্ক-বিতর্ক, বিদ্রূপ শুরু করেন। যানবাহনে ওঠার ক্ষেত্রে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দেয়ার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে তা খুব একটা নজরে পড়ে না। এমনকি কখনো কখনো চালক আর সহকারীরা নারী আসন থাকলেও অনেক সময় তাদের বাসে উঠতে দিতে চায় না। বিশেষ করে ব্যস্ত কর্মঘণ্টাগুলোতে কর্মজীবী নারী ও শিক্ষার্থীদের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করে গণপরিবহনে জায়গা করে নিতে হয়। পুরুষদের পাশাপাশি ধাক্কাধাক্কি করে বাসে ওঠা, দাঁড়িয়ে বা বাসের পাদানিতে ঝুঁকি নিয়ে ঝুলে যাতায়াত করতে হচ্ছে নারীদের। পুরুষদের সঙ্গে পালস্না দিয়ে যানবাহনে উঠতে গিয়ে প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানিসহ নানারকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন নারীরা। বাসে ওঠা-নামার সময় শরীরের বিভিন্ন অংশে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃতভাবে লাগছে চালক সহকারীর হাত। কিছু পুরুষ যাত্রী ইচ্ছা করে নারী যাত্রীদের গায়ের ওপরে পড়ে যান কিংবা অপ্রয়োজনে গায়ে হাত দেন। বাসের পেছনে ফাঁকা থাকলেও সামনের দিকে নারী আসনগুলোর পাশে গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং চালক সহকারীরা পেছনে যেতে বললে তাদের বাজে ভাষায় গালাগালও করেন অনেকে। তবে ছোট পরিবহনগুলোতে নারী ভোগান্তির চিত্রটা একটু কম। তারা নারীদের সুবিধার কথা চিন্তা করেই বের হবার দরজার সঙ্গে তাদের বসার জায়গা করে দেয়। এতে ভেতরের দিকে বসা যাত্রীদের আগে নামতে হলে নারী যাত্রীদের ওপর দিয়ে নামা ছাড়া উপায় থাকে না। এই বোরিংটুকুই পোহাতে হয়।

মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারী যাত্রীর সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু বাসে নারীদের জন্য সিটসংখ্যা বাড়ছে না। নারী যাত্রীর জন্য বিআরটিসি কিছুদিন আগেও আটটি বাস চালু রেখেছিল; কিন্তু পর্যাপ্ত নারীযাত্রী নেই, তাই লস দিতে হচ্ছে- এমন অজুহাতে বাসগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও ওই আটটি বাসও নারীদের জন্য রাজধানীতে অপর্যাপ্ত ছিল। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানীর ৭৩টি মোড়ে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় ভিড় থাকে। এ ভিড়ের মধ্যে নারী যাত্রীদের পোহাতে হয় এসব সমস্যা। অপরাধী অপরিচিত হওয়ায়ও আমাদের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি না পাওয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীদের এসব ভোগান্তি মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া উপায় থাকে না।শুধু পুরুষ যাত্রী নয় বাসের চালক ও হেল্পারদের আচরণও নারীদের জন্য যথেষ্ট বিব্রতকর। নারীদের অসম্মান বা বিব্রত করার সস্তা একটা ধরন হলো, নারীদের উদ্দেশ্য করে বা তাদের সামনে অশ্লীল শব্দ, বাক্য ও অঙ্গভঙ্গি করা। এ বিষয়ে লোকাল বাসের ড্রাইভার ও হেল্পাররা বেশ পারদর্শী। এখনকার শিক্ষিত সচেতেন তরুণরা এ ব্যাপারে বেশ ভদ্র। তবে শ্রমিকশ্রেণির লোকেরা গায়েপড়ে নোংরামী করে। এটাকে যৌন হয়রানি ছাড়া অন্য কোনোভাবেই অভিযুক্ত করা যায় না। প্রতিনিয়ত নারীযাত্রীরা এভাবে হয়রানির শিকার হলেও নীরব প্রশাসন। নেই বিকল্প কোনো উদ্যোগ। গত ৬ মার্চ ২০১৮ জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত 'নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে জানানো হয়, গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনো সময় মৌখিক, শারীরিক ও অন্যান্য যৌন হয়রানির শিকার হয়। অনুষ্ঠানে আরও দৃঢ়তার সহিত বলা হয় মূলত ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষের দ্বারাই নারীরা বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এ হার ৬৬ শতাংশ। গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত গবেষণা করে এ তথ্য দেয়া হলো। এতে সংখ্যাগত ও গুণগত ভিত্তিতে ৪১৫ জন নারী অংশগ্রহণ করেন।নিম্ন ও নিম্ন মধ্য আয়ের পরিবারের নারীদের সড়ক ও গণপরিবহন ব্যবহারের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩৫ শতাংশ নারী যৌন হয়রানি এবং ৫৯ শতাংশ নারী ২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী পুরুষের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শারীরিক এবং যৌন হয়রানির মধ্যে রয়েছে ইচ্ছাকৃত স্পর্শ করা, চিমটি কাটা, গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ানো, ধাক্কা দেয়া, চুল স্পর্শ করা, হাত বুক বা শরীরের অন্যান্য অংশ দ্বারা নারীদের স্পর্শ করা। এসব ঘটনায় ৮১ শতাংশ নারী চুপ থাকে এবং ৭৯ শতাংশ নারী জায়গা থেকে সরে দাঁড়ায়। রাজধানীতে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী নারীদের জন্য গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ছে না। কর্মজীবী নারীদের জন্য রাজধানীর ৪টি রুটে বাস চলাচল করে। একটি ছাড়া সব কয়টির গন্তব্যই মতিঝিল। বাসগুলো সকাল ৭টায় ছাড়ে। মতিঝিল থেকে ফিরে বিকেল ৫টায়। গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা নেই বললে ভুল হবে না।এ সমস্যা সমাধানে সরকারিভাবে প্রতিটি স্তরে জোরালো মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে গণপরিবহনে নারীদের হেনস্তার হার অনেকাংশে কমবে। গণপরিবহনে উঠতে না দেয়া, নারী যাত্রীদের গণপরিবহনে যাতায়াতের ক্ষেত্রে আরও একটি বাধা নারীদের। সিট না থাকার অজুহাতে তাদের প্রায়শই গণপরিবহনে ওঠানো হয় না। নারী যাত্রীদের অভিযোগ, অধিকাংশ সময়ে রাতে নারী যাত্রীরা গণপরিবহনে স্থান পায় না। এক্ষেত্রে গণপরিবহণে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত ৯টি আসন খুবই অপর্যাপ্ত। এসব ক্ষেত্রে মেয়েদের শক্ত হয়ে কথা বলতে হবে। দৃঢ়চিত্তে অধিকার আদায়ের কথা উচ্চারণ করতে। নারীবাদী আন্দোলন আর প্রেস ব্রিফিং করে জনশ্রম্নতি বাড়ানো যায়, কিন্তু ক্ষতি পোষানো যায় না। এই হীনম্মন্যতার ক্ষতি পোষাতে হলে নারীদের আলাদা না করে অন্য যাত্রীদের মতো ভাবতে হবে। গণপরিবহনে নারীযাত্রীদের ভোগান্তি লাঘবে পুরুষরা যদি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে, নারীদের যাতায়াতের সমস্যা সমাধানে তা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ সংক্রান্ত সমস্যা লাঘব করা সম্ভব হবে। পুরুষ যাত্রীরা নারী যাত্রীদের নারী হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে গণ্য করলেই সমস্যার দ্রম্নত সমাধান হবে। তাই আসুন নিজেদের মানসিকতা বদলাই, বদলাতে সাহায্য করি আমাদের এই সমাজকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<47270 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1