শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্মরণীয়া বরণীয়া

মোহাম্মদ আসাদ আলী
  ১৮ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

দীর্ঘ ২৩টি বছরের অবিচার, শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের পরিণতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আয়োজন যে কেবল বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ছিল না, এই যুদ্ধ যে অন্যায়-অবিচার-অপরাজনীতির বিরুদ্ধে দেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সংগ্রামী চেতনার চূড়ান্ত প্রকাশ ছিল, এই স্বাধীনতা যে এই দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের প্রাণের আকুতি ছিল তা পরিষ্কার বোঝা যায় মুক্তিযুদ্ধে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জাতির সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে। মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী ৯টি মাস যে যেভাবে পেরেছে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, কি নারী কি পুরুষ। যতই নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে, এই মাটির নিরীহ নিরপরাধ সন্তানদের বুকে রক্তপিপাসু পাকিস্তানি হায়েনারা গুলি চালিয়েছে, ততই যেন স্বাধীন বাংলায় নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য পুরো জাতি পাগলপারা হয়ে উঠেছে। সব জাতি ফুঁসে উঠেছে একসঙ্গে। পাকিস্তানের শাসকরা ও ধর্মগুরুরা চেয়েছিল ধর্মের নামে নারীদের গৃহবন্দি করে রাখতে। অথচ ধর্ম কখনই নারী-স্বাধীনতার অন্তরায় নয়। ক্ষুব্ধ নারীরা তাই রুখে দাঁড়াল নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। মুক্তির নেশায় তারাও ছুটে চলল 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর' এই স্স্নোগানকে বুকে ধরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারী এই 'সোনার মেয়ে'দের অমর কীর্তিগাঁথা কোনোদিন মুছে যাওয়ার নয়।

তবে বাঙালি মেয়েরা শুধু এ দেশ থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, প্রবাসী বাঙালি নারীরাও অনেক অবদান রেখেছেন এই স্বাধীনতা সংগ্রামে। দেশের মাটি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থান করেও জাতির প্রতি মমত্ববোধ, দেশের প্রতি ঐকান্তিকতা ফুটে উঠেছে তাদের আচার-আচরণে। প্রবাসে অনেক বিত্ত-বৈভবের মধ্যে দিন কাটলেও বাঙালি জাতির সার্বিক দুরবস্থা ও পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচার-নিপীড়ন দেখে তাদেরও মন কেঁদে ওঠে। এমনি একজন প্রবাসী বাঙালি নারী আমেনা পন্নী। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী পন্নী পরিবারের সন্তান তিনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধ না করেও মুক্তিযুদ্ধের একজন আন্তরিক কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাঙালির হৃদয়ে।

পাকসেনারা ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে একযোগে আক্রমণ চালাল। নিরীহ বাঙালিদের ওপর চালাল নির্যাতনের স্টিম রোলার। তারা নির্বিচারে নারী ও পুরুষদের হত্যা করতে লাগল। সারা দেশে রক্তগঙ্গা বয়ে গেল। এদিকে সাংবাদিকদের রাখা হলো নজরবন্দি করে। ফলে পৃথিবীর অনেক দেশই জানতে পারল না কী হচ্ছে এ দেশে। আমেনা পন্নী সেবার সবেমাত্র এমএ ডিগ্রি লাভ করেছেন। তিনি জানতে পারলেন ২৫ মার্চের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের কাহিনী। সংবাদ পাওয়ামাত্র তিনি সানফ্রান্সিসকো এবং আশপাশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তিনি মনে-মনে প্রতিরোধের পরিকল্পনা করলেন। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা চলল। ২৭ মার্চ গভীর রাত পর্যন্ত পরবর্তী কর্মপন্থা কী হবে তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হলো। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো পাকিস্তান কনসু্যলেট ভবনের সামনে তারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করবেন। শুধু বিক্ষোভই নয়, ওই ভবনে তারা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করবেন। দল বেঁধে পরদিন তারা পাকিস্তান কনসু্যলেট ভবনের সামনে বিক্ষোভ করলেন। তারা ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করলে পুলিশ প্রচন্ডভাবে বাধা দেয়। প্রচন্ড বাধার মুখে তারা কনসু্যলেট ভবনে ঢুকতে ব্যর্থ হন। উপায়ন্তর না দেখে তারা চরম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে সামনের পতাকাদন্ড থেকে পাকিস্তানি চাঁদতারা-খচিত-পতাকা নামিয়ে ফেলে সেখানে উড়িয়ে দেন বাংলাদেশের পতাকা।

এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই মহীয়সী নারী ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন শহরে ঘুরে এসব এলাকায় ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের জন্য ওষুধ জোগাড় করতেন এবং লন্ডন ও ভারত হয়ে সেই ওষুধগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এসে পৌঁছাত। শুধু তাই নয়, তিনি ইংল্যান্ড-আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট ও পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে প্রায় হাজার তিনেক চিঠি লিখেছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যার্থে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করেন। এসব অর্থ তিনি মুক্তিসংগ্রামে জড়িত ব্যক্তিদের কল্যাণে ব্যয় করেন। এভাবেই এই মহৎপ্রাণ নারী নিজের অমূল্য কীর্তিগাঁথা রচনা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্মরণীয় ও বরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে বাঙালির হৃদয়ে জায়গা করে নেন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<41405 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1