মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রতিভা সাংমা

গারোদের বাতিঘর

মো. নজরুল ইসলাম
  ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

টাঙ্গাইলের মধুপুরে গারোদের বাতিঘর চিরকুমারী প্রতিভা সাংমা। যিনি পাহাড়ি সংস্কৃতির আবহে বেড়ে ওঠা গারো সমাজে একজন সাহসী নারী। যিনি শত প্রতিক‚লতা ঠেলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

আদিবাসী গারো অধ্যুষিত ইদিলপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন প্রতিমা সাংমা। বাবা মৃত সনাতন মৃ। মাতা মৃত বংগবালা চাম্বুগং। বাংলাদেশের প্রায় অধর্শত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে মধুপুর বনাঞ্চলের গারোরা অন্যতম। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার দরুন অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তুলনায় গারোদের জীবন ব্যবস্থা অনেকটা বৈচিত্র্যময় ও বণার্ঢ্য। ওরা মান্দি নামেও পরিচিত।

গারো ভাষার নাম আচিক। লেখ্যরূপ নেই। মুখে মুখেই চলেছে পুরুষানুুক্রমে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে মিশনারি কাযর্ক্রমে গারোরা ধমার্ন্তরিত হতে থাকে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা সম্পত্তির মালিক।

পাহাড়ি মধুপুরের লালমাটির টিলা, নিচুু বাইদ, সারি সারি কঁাঠাল, আনারস আর লিচু বাগান নিয়ে গড়া জনপদ ইদিলপুর। কাকরাইদ- গারোবাজার সড়কে দুই কিলোমিটার এগোলেই ইদিলপুর বাজার। বাজারে নেমে লালমাটির রাস্তা ধরে এগোলেই গারোপাড়া। ইদিলপুর হাইস্কুল, খ্রিস্ট চাচর্, খ্রিস্ট অরফানেজ ও মিশনারি স্কুল পাড়ি দিয়ে ডানে দেড়শ গজ সামনে পেরুলে হাতের ডানে গাছগাছালিতে ছাওয়া নিজর্ন বাড়ি। মাটির দেয়ালে ঘেরা ছনে ছাওয়া দুটি ঘর। পরিচ্ছন্ন বাড়ির সামনে পেছনে আনারস বাগান। ফলফুলে সাজানো চকচকে আঙ্গিনা। দেখলেই দুদÐ বসতে ইচ্ছে করে। এ বাড়ির যিনি কত্রীর্ তার নামই প্রতিভা সাংমা। কৈশোর স্মৃতির বণর্না দিয়ে বলেন, ‘ঘন গজারি বনে ঢাকা ছিল গ্রাম। থাকতো চিতা বাঘ, বন্যশূকর, মহিষ, ময়ূর, বন মুরগি, বানর-হনুমানসহ নানা প্রজাতির পশুপাখি। সন্ধ্যা হলেই বাঘের গজের্ন পাহাড়ি টিলা কেঁপে উঠত। মা বংগবালা ছিলেন আদিবাসি সংস্কৃতির সমঝদার। মায়ের হাত ধরেই পড়ালেখা শুরু। ১৯৩৮ সালে ময়মনসিংহ শহরের বিদ্যাময়ী স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভতির্। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা। ১৯৪৯ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিকুলেশন। ৫১ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছা থাকলেও মায়ের নিদেের্শ ১৯৫২ সালে প্রথমে ময়মনসিংহ শহরের হলিফ্যামিলি এবং পরে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার সেন্টমেরি মিশনারি হাইস্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দেন।

মধুপুর বনাঞ্চলের গারোরা সে সময় শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে ছিল। নিজ সম্প্রদায়ের কথা ভেবে ১৯৬৫ সালে হালুয়াঘাটের সেন্টমেরি মিশনারি হাইস্কুলের চাকরি ইস্তফা দিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন। ভুটিয়া প্রাইমারি স্কুলে বিনা বেতনে শিক্ষকতা নেন। ছিলেন আশপাশের দুটি মিশন স্কুলেরও অতিথি শিক্ষক। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও যাতে স্কুলে আসে এ জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে গারো মহিলাদের উদ্বুদ্ধ করতেন। তার ভাষায়, ‘আমি অনেক গারো বাড়িতে গিয়েছি। মা-বোনদের বলেছি, তোমরা জেগে ওঠো, সন্তানদের স্কুলে পাঠাও। শিক্ষিত না হলে তোমাদের অভাব যাবে না, নিজেরা টিকে থাকতে পারবে না।’

এ অঞ্চলের গারোরা নিজ সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ভুলে খ্রিস্টান হচ্ছেন। তিনি ধমার্ন্তরিত গারোদের উপদেশ দেন, ‘তোমরা ধমীর্য়ভাবে খ্রিস্টান হলেও নৃতাত্তি¡কভাবে গারো। গারো পরিচয় সব সময় গবের্র। গারো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ভুললে পথ হারাবে। শেকড়কে অঁাকড়ে ধরো। তাহলেই সাফল্য ধরা দেবে। সংস্কৃতি চচার্র প্রতি তার আগ্রহ দেখে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সরকার আদিবাসী কোটায় গালর্স গাইডের নেত্রী হিসেবে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পাকিস্তানের পেশোয়ারে পাঠিয়েছিলেন।

৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মধুপুর বনাঞ্চলের গারোরাও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। একাত্তরের মাচের্ মেজর জেনারেল সফিউল্লাহর নেতৃত্বে সেকেন্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে মধুপুর জঙ্গলে অবস্থান নিলে গারোরা নানাভাবে সহযোগিতা করেন। স্বাধীনতার পর শিক্ষকতায় ফিরে যান। ৭২ সালে মধুপুর গালর্স হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন। এখান থেকেই ৯১ সালে অবসর নেন।

এ বয়সেও প্রতিভা যথেষ্ট মানসিক শক্তির অধিকারী তিনি। চশমা ছাড়াই পড়াশোনা করেন। ভোরে উঠে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে গারো শিশুদের লেখাপড়ার খেঁাজ নেন। ২০০১ সালে অগ্নিকাÐে ১০ ভরি স্বণার্লংকারসহ পারিবারিক পাঠাগার পুড়ে ছঁাই হয়ে যায়। বাড়িঘর পুড়ে যাওয়ার কষ্ট ভুলে গেলেও মূল্যবান ও দু®প্রাপ্য গ্রন্থের পাঠাগারটি বিনষ্টের কষ্ট ভুলতে পারেননি। সারা জীবন অন্যের ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে নিজের ঘর বঁাধা হয়নি। আজীবন কুমারীই রয়ে গেছেন। আদিবাসী সমাজেও কুমারী হয়ে জীবন কাটানো কঠিন। নিজে মা হতে না পারলেও দুঃখ নেই। গ্রামের সব শিশুরাই তার সন্তান। প্রতিভা জানান, নিকটাত্মীয়দের সবাইকেই লেখাপড়া শিখিয়েছেন। নিজ খরচে বিয়ে-থা দিয়েছেন। সম্পত্তি বণ্টন করে দিয়েছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<36096 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1