মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নারীর অগ্রযাত্রা

তাসলিমা হোসেন
  ১৪ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

ঊনিশ শতকে বাংলার নারী শিক্ষার প্রশ্নটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বারবার উত্থাপিত হয়। ভারতে নারীবাদী আন্দোলনের প্রধান বিষয়ও হয়ে ওঠে নারী শিক্ষা। শিক্ষা বিষয়টি রূপান্তরিত হয় নারীর গৃহ ও বিশ্বÑ এ দুইয়ের মধ্যে প্রথম মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। ঊনিশ শতকে, এমনকি বিংশ শতকের প্রারম্ভিক পবের্ ঔপনিবেশিক বাংলায় প্রাবন্ধিক, প্রকাশক ও সমাজ-সংস্কারক যারাই লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা প্রায় সবাই নারী শিক্ষার বিষয়টি অতি উৎসাহের সঙ্গে পযাের্লাচনা করেছেন। নারী শিক্ষা সম্পকির্ত এসব ভাবনা মোটা দাগে তিনটি ধারায় ভাগ করা যায়Ñ রক্ষণশীল, মধ্যপন্থী ও উদারনৈতিক। বাংলা অঞ্চলে সনাতনী শিক্ষা ব্যবস্থায়, ঊনিশ শতকে বিশেষত মুসলমান নারীরা শিক্ষার উপাদান গ্রহণ করেছিলেন অন্দর মহলের কঠোর বেড়াজালের মধ্যে। আতরাফ শ্রেণিতে নারী শিক্ষা নিতান্ত দু-একটি ধমীর্য় কাহিনী, কিছু হাদিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও আশরাফ শ্রেণির নারীদের কোরআন শিক্ষা, কিছু উদুর্ ও মৌলিক হিসেবে দক্ষতা অজের্নর জন্য নারী শিক্ষক পযর্ন্ত রাখা হতো। হিন্দু, খ্রিস্টান বা অন্য ধমার্বলম্বীদের নারীদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা, সেলাই, অ্যামব্রয়ডারি এবং কিছুটা সংগীত শিক্ষার ব্যবস্থাও গোচর করি। কিন্তু সব শ্রেণিতে নারী শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নারী যাতে পারিবারিক জীবনে মাতা-কন্যা-স্ত্রী হিসেবে যথোপযুক্ত দায়িত্ব পালনে যোগ্য হয়ে ওঠে।

বাংলা অঞ্চলে নারী শিক্ষায় খ্রিস্টান মিশনারিরা ছিলেন পথপ্রদশর্ক। ১৮৩০-১৮৭০ সালের আগে কলকাতা, ঢাকাসহ কয়েকটি এলাকায় নারী শিক্ষার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন মিশনারিরা। আশ্চযর্জনক হলেও সত্য, মিশনারিদের স্কুলে মুসলমান মেয়েদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল। মিস মেরি কাপের্ন্টার ও মিস এনেট একরয়েড নামের দুজন ইংরেজ নারী ১৮৬০ ও ১৮৭০-এর দশকে নারী শিক্ষায় অবদান রাখার আকাক্সক্ষা নিয়ে ভারতে এসেছিলেন। বাংলায় তারা সাধারণ স্কুলের পাশাপাশি নারীদের জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ও স্থাপন করে যান। যদিও মিশনারিরা ধমার্ন্তরিত করছেনÑ এই সন্দেহে স্কুলগুলো খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি।

পূবর্বঙ্গে নারী শিক্ষার ভিত্তিমূল রচনায় অন্যতম ভ‚মিকা পালন করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, সৈয়দ আমীর আলী, নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখ। ঊনিশ শতকের খ্যাতনামা সংস্কারবাদী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার পক্ষে প্রচুর লেখালেখি করেন। ১৮৫৭-১৮৫৮Ñ এই এক-দেড় বছরের মধ্যে তিনি প্রায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন হুগলি, বধর্মান, নদীয়া ও মেদিনীপুর অঞ্চলে। অনুদান ও স্থানীয় উদ্যোগের অভাবে বিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে গেলেও এর মাধ্যমে নারী শিক্ষার একটি শক্তিশালী ধারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। যখন নারী শিক্ষার বিভিন্ন প্রচেষ্টা বিক্ষিপ্তভাবে চলছে তখন একজন নারী কুমিল্লায় পদার্নশিন মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপনের দুঃসাহসিক পরিকল্পনা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। বাংলার নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এই পথিকৃৎ নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। যখন মুসলমানরা পশ্চিমা শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, ঠিক সেই সময়ে নবাব ফয়জুন্নেসা মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া নারীর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সে সময় নারী শিক্ষাকে যতটা গভীরভাবে নবাব ফয়জুন্নেসা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, সেভাবে স্যার সৈয়দ আহমদ খান কিংবা বাংলার আবদুল লতিফের মতো স্বনামধন্য চিন্তকরাও পারেননি। বাংলায় নারী শিক্ষা বিস্তারে আরেকজন শিক্ষাবিদ বেগম রোকেয়ার অবদান অনস্বীকাযর্। তিনি ছিলেন একাধারে বঙ্গ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান নারীবাদী লেখক ও সমাজ-সংস্কারক। নারী শিক্ষার প্রসার ও ধমীর্য় গেঁাড়ামির বিরুদ্ধে তিনি লিখে গেছেন শক্ত হাতে। মেয়েদের জন্য বেশ কিছু স্কুল স্থাপন করেছেন। অনেক দুভোর্গ সহ্য করতে হয়েছে এসব স্কুলে মেয়েদের নিয়ে আসার জন্য। দ্বারে দ্বারে ঘুরে অভিভাবকদের অনুরোধ করেছেন যাতে তারা মেয়েদের স্কুলে পাঠান। এমনকি মেয়েদের নিরাপত্তা ও পদার্র নিশ্চয়তা দিতে বেগম রোকেয়া ফিটন গাড়ি (ঘোড়ার গাড়ি), মোটর ও বাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। এ গাড়িগুলো সম্পূণর্ভাবে পদার্ দিয়ে ঢাকা থাকত। তার পরও রক্ষণশীলরা যখনই সুযোগ পেয়েছে, বেগম রোকেয়াকে আক্রমণ করতে ছাড়েনি। বেগম রোকেয়ার কাজ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন অনুজপ্রতিম শিক্ষক, সমাজকমীর্ এবং সংসদ সদস্য শামসুন্নাহার মাহমুদ। তার বাবা ফজলুল করিম সে সময় পূবর্ বাংলার মুসলানদের মধ্যে প্রথম স্নাতক। শামসুন্নাহারের ছোটবেলা কেটেছে চট্টগ্রামে। কঠোর পদার্ ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে একজন হিন্দু শিক্ষকের কাছে তিনি পড়তেন। মাত্র নয় বছর বয়সে পদার্র প্রশ্নে খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয় ত্যাগ করেন। সে সময় খাস্তগীর স্কুলে বিপ্লবী কল্পনা দত্তের বড় বোন, দেশপ্রিয় জিতেন্দ্র মোহনের বোনসহ অনেক বিখ্যাত পরিবারের মেয়ে লেখাপড়া করতেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<31976 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1