শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রণাঙ্গনের সূযৈর্সনিক

স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে আনতে যে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেখানে এ দেশের নারীদের ভ‚মিকা উল্লেখ করার মতো। মুক্তি সংগ্রামে শত শত নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সাথর্ক ফসল আমাদের বিজয়...
ফাবিহা মুশতারি
  ০৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

যুদ্ধে নারীর ভ‚মিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী তার সবার্ত্মক শক্তি নিয়োগ করেছিল স্বাধীনতার মতো একটি বড় অজের্ন। পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ ছিল তার জীবনবাজি রাখার ঘটনা। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীকে মূলধারায় স্থাপন না করার ফলে নারীর প্রকৃত ইতিহাস যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। নারী মুক্তিযুদ্ধে যে গৌরবগাথা রচনা করেছিল তা ধষির্ত এবং নিযাির্তত নারীর ভ‚মিকায় অদৃশ্য হয়ে আছে। প্রকৃত অবদান খুঁজে নারীকে মূলধারায় না আনার আরও একটি কারণ, নিম্নবগের্র নারীরাই ব্যাপকভাবে এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। নিম্নবগর্ নারীর ইতিহাস ক্ষমতাশীল সুশীল সমাজের কাছে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গৃহীত হতে শুরু করে স্বাধীনতার তিন দশক পরে।

বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাসের শেষ পবের্Ñ পাকবাহিনীর হাতে নিযাির্তত মেয়ে বেনু বলছে মুক্তিযোদ্ধা প্রেমিককে, ‘স্বাধীনতার জন্য তুমি দিয়েছ পা আর আমি জরায়ু। আমরা দুজনেই এখন নতুন করে ঘর বঁাধব।’ আসলে এ ঘর বঁাধা মানে ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নারী-পুরুষ মিলে গড়ে তোলা। কিন্তু বাস্তবে কী এটি হয়েছে? যুদ্ধের সময়ে আহত মুক্তিযোদ্ধারা পেলেন বীরের মযার্দা কিন্তু শারীরিকভাবে পাকবাহিনীর হাতে নিগৃহীত নারীদের কেউ আত্মহত্যা, কেউ পরিবার থেকে বিতাড়িত, কেউবা অপমানে আর বেদনায় ঠঁাই নিয়েছিলেন পতিতালয়ে এমনকি কেউ কেউ পাকসেনাদের সঙ্গী হয়ে নিরুদ্দেশের পথে। হায় নারীর শরীরই যেন আজন্ম পাপ! অথচ এদের শরীরই তো আহত হয়েছিলÑ তবে? যুগ যুগ ধরে লালিত শারীরিক সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি সমাজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে তাদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দিলেন পরম সম্মানে। কিন্তু এ শব্দটি উপশমের চেয়ে নারীত্বের ওপর আক্রমণ ও পাশবিক অত্যাচারের দ্যোতক হিসেবে রূপ নেয় যার ফলে সে শতকের শেষ সময় পযর্ন্ত নারীরা লজ্জায় অধোবদন হয়ে থাকতেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে আনতে যে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেখানে এ দেশের নারীদের ভ‚মিকা উল্লেখ করার মতো। মুক্তি সংগ্রামে শত শত নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সাথর্ক ফসল আমাদের বিজয়। অন্যদিকে এ দেশের লাখ লাখ গৃহবধূ, মা ও বোন মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে জীবন রক্ষা করেছেন, খাদ্য দিয়েছেন, ভালোবাসা দিয়েছেন, প্রেরণা দিয়েছেন সেই সঙ্গে পাক-হানাদার ও দোসরদের সন্ধান দিয়েছেনÑ তা স্বণার্ক্ষরে লেখা থাকবে।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হওয়া অনুষ্ঠানÑ ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’Ñ অতঃএব একজন সাহসী নারী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বেরিয়ে এলেন বিজয়ের পতাকা হাতেÑ এরপর ধীরে ধীরে আরও অনেকে। এরপর তারা কেবল বীরাঙ্গনা নন, পেলেন মুক্তিযোদ্ধার সম্মান।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেসব নারী পাকবাহিনীর বা তাদের দেশীয় দোসরের হাতে অপহৃত হয়ে নিখেঁাজ বা স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেন তারা সবাই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু ১৯৯৯ সালের আগ পযর্ন্ত নারী শহীদদের কোনো তালিকা প্রণীত হয়নি, বিচ্ছিন্নভাবে লেখা হয়েছে শুধু তাদের মৃত্যুর ইতিহাস। ২ মাচের্র কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী রওশন আরা বুকে মাইন বেঁধে ঝঁাপিয়ে পড়েন একটি পাকিস্তানি ট্যাঙ্কের সামনে। এতে ট্যাঙ্কটি ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রওশন আরাও শহীদ হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে লেখা হলোÑ ‘বীর রওশন আরা বেগম বুকে মাইন বেঁধে জল্লাদের ওপর ঝঁাপিয়ে পড়ে নিজের কিশোরী দেহের সঙ্গে একটা আস্ত পেট্রোল ট্যাঙ্ক ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।’ সংক্ষিপ্ত বিবরণে তার ইতিহাস শেষ! তাকে বীর বলা হলেও ‘শহীদ’ উপাধি থেকে বঞ্চিত হলেন।

স্বাধীনতাকামী জনগণের মনোবল দৃঢ় রাখার উদ্দেশ্যে কিনা করেছিল নারী। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক কমর্কাÐে ও বিভিন্ন আন্দোলনে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ হতে শুরু করে গেরিলাযুদ্ধে, চিকিৎসা ও সেবা ক্ষেত্রে নারী, সংগঠক হিসেবে, মুক্তিযোদ্ধাদের মায়ের ভ‚মিকায় কতভাবেই সাধারণ ভ‚মিকা পালন করেছে নারীরা। খবর পাঠ করে, কথিকা পড়ে, গান গেয়ে বেতারে অনবরত প্রচারের দায়িত্ব পালন করেছেন তারা। শিল্পীরা গঠন করেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ শিল্পী সংস্থা’। ভারতের বিভিন্ন স্থানে সংগীত পরিবেশন করে তারা সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। এ ছাড়া সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, গেরিলা যুদ্ধে শত্রæর অবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রেকির ভ‚মিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রন্ধনশালায়, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করে, হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের শুশ্রƒষায়, গ্রামে শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দান করে, শারীরিকভাবে নিযাির্তত হয়ে আবার অস্ত্র হাতে লড়াই করে, বিভিন্ন দূতাবাসে প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে, সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে জনযুদ্ধের সাফল্যকে নিশ্চিত করেছিল নারীরা।

বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে আনতে কত আত্মা নিজেকে উৎসগর্ করেছেন আমরা হয়তো তার সূচারু সাংখ্যিক হিসাব বলতে পারব না। কিন্তু আমরা নতুন প্রজন্ম যারা প্রতি বছর বিজয়ের আনন্দ অনুভব করার সময় সেই ক্ষণকেই অনুভব করি প্রতি পলে। বিশেষ করে আমরা নারীরা, বারবার অনুপ্রাণিত হই, সেইসব বীর নারীর জন্য, যারা নানাভাবে অবদান রেখেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে আর আমাদের উপহার দিয়েছেন এই বিজয়। এই স্বাধীনতা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<25154 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1