বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সমাজ পরিবতের্নর দায়িত্ব নারী-পুরুষ সবারই

সোরিয়া রওনক
  ২২ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

আমাদের সমাজ বৈষম্যমূলক। এ সমাজে মেয়েরা দফায় দফায় বৈষম্যের শিকার হয়। প্রথম বৈষম্য শ্রেণিগত, দ্বিতীয় বৈষম্য নারী-পুরুষের। নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র ঘরের মেয়েদের তো কথাই নেই। বিত্তবান পরিবারেও মেয়েদের প্রতি আচরণ বৈষম্যমূলক। অথবা মেয়েদের সঙ্গে শত্রæতা করে গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। সমাজে যখন সামন্তবাদী ব্যবস্থা ছিল, তখনো নারী ওই ব্যবস্থার দ্বারা নিযাির্তত হতো। এখন যখন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আমরা পেঁৗছে গেছি, তখনো নারী নিযাির্তত হচ্ছে। শাশুড়ি ও গৃহবধূ উভয়ই এ ব্যবস্থার শিকার। কিন্তু বিক্ষোভব্যবস্থার বিরুদ্ধে না নিয়ে চলে যাচ্ছে পরস্পরের বিরুদ্ধে। নাটকের সংলাপ ও কথোপকথনে আমরা উল্লেখ পাই, নারীর শত্রæ নারী নিজে। এ ধারণার সামাজিক ভিত্তি আছে। তা হলো, মেয়েদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া দেখা যায়। শাশুড়ি ঘরের বউয়ের প্রতি বিরূপ আচরণ করে। ঘরের বউও শাশুড়িকে পছন্দ করে না। কমের্ক্ষত্রে মেয়েরা একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে কথা বলে। বোনে-বোনে ঝগড়া হয়। কিন্তু এই যে ধারণা, তা অবশ্যই ভ্রমাত্মক। ভ্রান্তÑএর কারণ এবং আরও যা আপত্তিকর তা হলো আসল শত্রæকে আড়ালে রাখা। নিমর্ম সত্য হলো, পরিসংখ্যান বলে, শতকরা ৮০ জন মেয়ে নিযাির্তত হচ্ছে। এ নিযার্তন গৃহে, কমের্ক্ষত্রে, পথে-ঘাটেÑসবর্ত্রই ঘটে। যেখানে সরাসরি নিযার্তন নেই, সেখানেও বৈষম্য আছে।

মেয়েদের উপস্থিতি সবর্ত্রই লক্ষ করার মতো। কিন্তু বেতন ও মজুরির ব্যাপারে নারী-পুরুষের পাথর্ক্য বেশ স্পষ্ট। তার পরও একজন কমির্নযুক্ত মেয়েকে পারিবারিক কাজ করতে হয়। পুরুষের তুলনায় এ কাজের পরিমাণ অধিক। কিন্তু এ গৃহকমের্ক যতই আদশাির্য়ত করা হোক না কেন, এটা ভয়ানকভাবে একঘেয়ে ও ক্লান্তিকর। কিন্তু এই যে প্রতিদিনের কাজ, এর কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। অধিক মূল্যায়নের তো প্রশ্নই ওঠে না; পারিবারিক ও সামজিক মূল্যায়নও নেই।

নারীরা বিশেষভাবে নিরাপত্তাহীনতাই ভোগে। প্রতারণা, যৌন হয়রানি, লাঞ্ছনা ইত্যাদি বাধা। পথেঘাটে বখাটে যুবকরা উৎপাত করে। নারী ধষর্ণ আগেও ছিল, কিন্তু এখন তা মাত্রায় অনেক বেড়েছে। গণধষর্ণ আমাদের দেশে অপরিচিত ছিল। তাও চলছে। মেয়েরা পাচার হয়ে যাচ্ছে। নারী নিযার্তনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও অভিযুক্ত হচ্ছে। অসহায় মেয়েরা আত্মহত্যা করছে। ধমীর্য় মৌলবাদীরা নারীর মানবিক অধিকারগুলোকে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠা প্রকাশ করে। যৌতুকের জন্য নিপীড়ন এখনো চলছে। মেয়েরা যে এখন হেজাব ও বোরকা পরিধান করছে, তার পেছনে একটি বড় কারণ নিরাপত্তাহীনতা। গোটা ব্যবস্থাই মেয়েদের দুবর্ল করে রেখেছে; যদিও মেয়েরা যোগ্যতা ও কমর্দক্ষতায় অথর্নীতিতে অবদান রাখছে, কিন্তু সবকিছু সত্তে¡ও তাদের কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে।

সবল দুবের্লর ওপর অত্যাচার করবে, এটাই যেন নিয়ম হয়ে দঁাড়িয়েছে। নারী মোটেই দুবর্ল নয়। তাকে দুবর্ল করে রাখা হয়। সন্তানের জন্মদান ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রে মেয়েদের যে ভ‚মিকা, তা পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সেবা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে মেয়েরা সব সময় দক্ষতা প্রদশর্ন করে আসছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে তারা পুরুষের সঙ্গে কেবল প্রতিযোগিতা করে, তা-ই নয়, অনেক ক্ষেত্রে তারা পুুরুষের চেয়ে ভালো ফল করে। অনেক কঠিন কাজ মেয়েরা করছে। তারা কারখানায় আছে, পোশাকশিল্পে মেয়েরাই অধিক। সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগে তারা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। কিন্তু তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়। সামাজিকভাবেও হেয় বিবেচনা করার দীঘর্ ঐতিহ্য রয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজ নিজেকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে। কিন্তু এ ব্যবস্থা পুরোপুরি পিতৃতান্ত্রিক। নারীকে সে যতটা পারে দুবর্ল করে রাখতে চায়। এটাই তার স্বভাব।

সব মিলিয়ে সত্য এই যে, সমাজ ও রাষ্ট্রই আসলে শত্রæ। নারীমুক্তির আন্দোলন আসলে এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন। এ ক্ষেত্রে সংস্কার, নতুন আইন প্রণয়ন, আইনের প্রয়োগÑ অনেক কিছুর কথাই ভাবা হয়। এদের উপযোগিতা অবশ্যই আছে। কিন্তু সংস্কারের মধ্য দিয়ে এ ব্যবস্থাকে পরিবতর্ন করা যাবে না। নিমর্ম হলেও সত্য, সংস্কারব্যবস্থাকে দীঘর্স্থায়ী করতে সাহায্য করে। আমরা অবশ্যই সংস্কার চাইব। কিন্তু এ সত্যকে ভুললে চলবে না, বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে বদলাতে না পারলে নারীমুক্তি অসম্ভব। আন্দোলনের লক্ষ্যও তাই গোটা ব্যবস্থা পরিবতের্নর। এ ব্যবস্থা পরিবতের্নর স্বপ্ন আমরা দীঘর্কাল দেখেছি, এখনো দেখছি। কিন্তু ব্যবস্থা বদলায়নি। অন্যায় ও অমানবিক এ ব্যবস্থার প্রকোপে বাংলাদেশের সব মানুষ আজ নিতান্ত দুদর্শাগ্রস্ত ও হতাশায় আক্রান্ত। এ ব্যবস্থাকে বদলানোর কাজ কেবল মেয়েদের নয়, নারী-পুরুষ সবারই। নারীমুক্তি আন্দোলনকে সমাজ পরিবতের্নর স্বপ্ন হিসেবে দেখতে হবে। না দেখলে তা দূরদশীর্ হবে না এবং লক্ষ্য অজের্নর দিকেও এগোতে পারবে না। আবারও বলি, সমাজ পরিবতের্নর দায়িত্ব নারী-পুরুষ সবারই এবং আন্দোলন ছাড়া পরিবতর্ন সাধনের অন্য কোনো উপায় নেই। যে কোনো আন্দোলনেরই সাফল্য নিভর্র করে শত্রæকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করার ওপর। নারীমুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রেও পুঁজিবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রকে মূল শত্রæ হিসেবে চিহ্নিত করতে আমরা যেন ভুল না করি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<18723 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1