শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নারীবৈষম্য এবং তাদের আথর্সামাজিক মুক্তি

রিমা লিমা
  ০৮ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

একটি মেয়ে শিশু জন্মের পর প্রথম বৈষম্যের শিকার হয় তার পরিবারে। জন্মের পর তার জন্ম নিয়ে শুরু হয় নানা জল্পনা-কল্পনা। আহা! মেয়ে সন্তান! যদি দ্বিতীয় সন্তানও মেয়ে হয় তবে তো কথাই নেই। এই যেমনÑ এবারও মেয়ে। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছিÑ আমার নানুর সাতটি মেয়ে সন্তান। আর আমার মায়ের প্রথম সন্তান আমি। তবুও আমার মাকে পাড়া প্রতিবেশীরা শুনিয়েছিল এর মায়েরই সাত মেয়ে, এর তো সবে শুরু। পাড়া প্রতিবেশীদের বেশরভাগই ছিল মহিলা। অথচ আমার বাবা ছিলেন খুব খুশি।

মা-বাবার দুই সন্তানের একটি ছেলে আর একটি মেয়ে হলে তাদের জন্য থাকে ভিন্নতা সব আয়োজনে। কারণ মেয়ে সন্তান তো পরের ঘরে চলে যাবে। আর ছেলে নাকি হাতের লাঠি। ভবিষ্যৎ জীবনে তাদের ভরসার হাত হয়ে দঁাড়াবে। বাস্তবতা যদিও অন্য ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু এটা বুঝাবে কে? আমাদের দেশের সম্পত্তি বণ্টন আইন এই চাওয়া কে ভালোভাবেই উস্কে দেয়। আমার পরিচিত এক শিক্ষিত দম্পতিকে দেখেছি ফুটফুটে দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়ার পরও তারা আবার সন্তান নিচ্ছেন পুত্র সন্তানের আশায়।

মা বাবা খুব ছোটবেলা থেকেই তাদের বিভিন্ন আচরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেন ছেলে আর মেয়ের পাথর্ক্য। মেয়ে শিশুর খাবার মেনুর সঙ্গে ছেলে শিশুর মেনুর বিস্তর তফাৎ থাকে। মাছের মাথা মুরগির রান সব ছেলে সন্তানের জন্য থাকে। ভালো নামিদামি স্কুলে ছেলে সন্তান যায়। মেয়েটি হয়তো পাড়ার কোনো অখ্যাত স্কুলে যায়। এখানে নিরাপত্তার পাশাপাশি অন্য আরেকটি মনোভাব কাজ করে, তা হলো মেয়েটি বিয়ের পর অন্য বাড়ি চলে যাবে। মেয়ে চাকরি করলে তার ইনকামের ওপর বাবার বাড়ির অধিকার থাকবে না।

বাস্তবে আমি অনেক পরিবারে উল্টো দেখেছি। ছেলে বা তার স্ত্রী বৃদ্ধ বাবা মা বা শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পকর্ রাখে না। এই অসহায় পরিবারের পাশে মেয়েটি দঁাড়ায়। যতটুকু পারে সেই এগিয়ে আসে মা বাবার পাশে।

একটি মেয়ে সন্তান জন্মদানের পর চরম পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। এরপর যদি চাকরিজীবী হন তো কথাই নেই। বাচ্চার যে কোনো সমস্যা বা অসঙ্গতির পেছনে মাকে দায়ী করা হয়।

বাচ্চার স্বাস্থ্য ভালো নয় বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম ওই যে মা চাকরি করে। আবার বাচ্চার স্কুলের রেজাল্ট ভালো নয় একই কথা মা থাকে সারাদিন বাইরে তো এমনি তো হবে। পতি দিব্যি অফিস করে বাসায় এসে পায়ের ওপর পা দিয়ে আয়েশ করেন, যা একজন কমর্জীবী মায়ের জন্য অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি সংসার সামলান, বাচ্চাকে সামলান পাশাপাশি চাকরি সামলান। অনেক বাবা বাচ্চা রেজাল্ট খারাপ করলে স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন তোমার মেয়ে বা তোমার ছেলে এত খারাপ করে কেন? এক্ষেত্রে এসে সন্তান একা মায়ের হয়ে যায়। বাবা তার সন্তানের সব কৃতিত্ব একা নিতে রাজি বা নিয়ে নেয় শুধু খারাপ কিছু হলেই তার দায়ভার মায়ের হয়ে যায়।

কোনো মেয়ে স্বামী পরিত্যক্ত হলে মেয়েরাই সবার আগে হামলে পড়ে নানা সমালোচনায় মুখর হয়। যদি এই মেয়েটি হয় গৃহিণী তবে তো কথাই নেই। বাবার বাড়িতে গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। ভাই আর ভাবির অত্যাচারে সে হয় কোণঠাসা। এক পযাের্য় মা বাবারও বোঝা হয়ে যায়। যদি স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কোনো মেয়ে মা বাবার শরণাপন্ন হয় তাকে প্রতিবাদ করতে না শিখিয়ে বা তার পাশে না দঁাড়িয়ে বলা হয় মানিয়ে নিতে শেখ। আর সে তোমার স্বামী। আর অপরপক্ষে স্বামীকে উল্টো মদদ দিয়ে বলা হয় ভুল করেছে তাকে মাফ করে ঘরে তুলে নাও বাবা। এমন স্বামী এতে হন আরও বেশি অত্যাচারী আর মেয়েটি সারাজীবন ভিকটিম হয়ে জীবন পার করে দেয়।

যদি কেউ দুভার্গ্যক্রমে অকাল বৈধব্য বরণ করে তবে তাকে সরাসরি অপয়া বলা হয়। শ্বশুরবাড়ির লোক তাকে শুনিয়ে বলে আমার ছেলে বা ভাইকে তো তুমি খেয়েছ আর কিছু ধ্বংস করার আগে কেটে পড়তো বাপু। আর যদি কন্যা সন্তান থাকে তবে ষোলকলা কারণ খুব সহজেই তাদের শ্বশুড়বাড়ির সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায় তখন। ভাবুন তো এমন মেয়ে কতটা অসহায়।

আমি বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে দেখেছি বিধবাদের অশুচি ও অপয়া ধরা হয়। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে বিধবাদের নাকি হলুদ ছেঁায়ার অধিকার নেই। কারণ তার ছেঁায়া হলুদে নবদম্পতির জীবনে দুগির্ত নেমে আসতে পারে বলে কুসংস্কার আছে। একটা মেয়ের ওপর এসব নিয়ম দেখিয়ে আরও ১০টা মেয়ে চড়াও হয়। বিধবা মানে রংহীন। তার জীবনের সব রং মুছে গেছে। তার সাজতে মানা। যদি সে হাসিখুশি থাকে বা পরিপাটি থাকে তবে বাইরে মা শাশুড়ি বা পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে শুনতে হবে কানাঘুষা। তাই তো এত রং উনার মনে আসে কোথা থেকে। নিশ্চয়ই তার বাইরে আফেয়ার আছে। আর পুরুষ মহল ভাববে আরওএকটু সুযোগ নিয়েই দেখি না! কি আর করা হেনতেন বুঝিয়ে ভোগ করা গেলে ক্ষতি কী?

একমাত্র মুক্তি মেয়েরা নিজের পায়ে যখন দঁাড়াতে শিখবে। ছোটবেলা থেকে মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় মেয়েদের সব প্রস্তুতি বিয়েকেন্দ্রিক। মা বাবা থেকে শুরু করে সবার এক কথা বড় হয়ে বিয়ে করবে তাই সুন্দর হও রূপচচার্ কর নিজেকে পণ্যের মতো তৈরি কর তবেই না ভালো পাত্র জুটবে। এখনও অনেক শিক্ষিত বাবা-মা মনে করে মেয়ের পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে কক্ষনো নয়। মেয়েদের উপযুক্ত সময় নাকি কলেজের পরই কারণ সম্মান বা স্নাতকোত্তর শেষ করতে গেলে মেয়ের বয়স নাকি বেড়ে যাবে। আর বয়স্ক মেয়ের বিয়ে দেয়া কঠিন। অনেকেই বলতে শুনেছি পাত্রী পড়াশোনা শেষ মানে স্নাতকোত্তর শেষ এ মেয়েতো বেশি বুঝবে তাই বাগে আনা মুশকিল হবে। তার চেয়ে কম বয়সী কলেজপড়ুয়া ভালো তাকে আয়ত্তে আনা সহজ হবে।

মেয়েদের চাকরির বিপক্ষে অনেকেই। চাকরি করলে নাকি সন্তান উচ্ছন্নে যায়। অথচ হিসাব কিন্তু সহজ। একটা বাচ্চা স্কুলে থাকে ছয় ঘণ্টা তারপর বাসায় এসে গোছল খাওয়া তার বিশ্রাম মিলে ঘণ্টা তিন। তাহলে আপনার সন্তান আপনাকে কতটুকুই মিস করল? শুধু খেয়াল রাখতে হবে আপনার সন্তান যেন শুধু গৃহকমীর্র কাছে না থাকে। এ ক্ষেত্রে নানি বা দাদির বিকল্প নেই।

একটা মেয়ে যেদিন বুঝতে পারবে তার জন্য পড়াশোনা এবং সবোর্পরি নিজের পায়ে দঁাড়ানোর বিকল্প নেই। যেদিন কঁাধে কঁাধ মিলিয়ে স্বামীর পাশে দঁাড়াতে পারবে সেদিন বুঝতে পারবে এই সমাজে তার ভ‚মিকা কতটুকু।

এভাবে যুগে যুগে ছেলে-মেয়েকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে। আমরা মেয়েরা সেই আবতের্ই ঘুরছি। নিজের ভালো মন্দ আমি যদি না বুঝি বা প্রতিবাদী না হই, তবে এই অবস্থার পরিবতর্ন হবে না। খুব কষ্ট হয় যখন দেখি একজন উচ্চ শিক্ষিত মেয়েও সংসারজীবনে প্রবেশ করার জন্য তার চাকরি জীবনের ইস্তফা দিয়ে দেয়। সে তখন দিব্যি শাড়ি, গহনা, পালার্র আর বাচ্চা সামলাতেই জীবনপাত করে। বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি আমার দেখা এক দম্পতি আছে, যারা একটি মাল্টি ন্যাশনাল ব্যাংকে চাকরি করত। বিবাহ করলে একজনকে চাকরি ছাড়তে হবে তাই বেশি যোগ্য স্টাফ হয়েও মেয়েটি চাকরি ছেড়ে দেয়। পরে শুনেছি শ্বশুরবাড়ি মূলত স্বামী চান না তাই মেয়েটি এখন কোনো স্কুলে চাকরির চেষ্টা করছে। অথচ এমন যদি হতো দুজনই একসাথে চেষ্টা করে একজন অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যেত তারপর না হয় বিয়ের সিদ্ধান্ত নিত। একটা মেয়ে তার সংসারের প্রতি যে মায়া দেখায় বা যে বন্ধন থাকে, তা একটি ছেলের থাকে না।

সেই দিন কবে আসবে যেদিন অন্ততপক্ষে প্রতিটি শিক্ষিত মেয়ে কমর্জীবী হবে নিজের পরিচয়ে বঁাচতে শিখবে! সেইদিন মেয়েদের জীবনে যেমন আসবে সামাজিক মুক্তি তেমনি অথৈর্নতিক মুক্তি। যেখানে একজন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত গৃহিণী শুধু পালার্র, সংসার কিংবা নতুন রেসিপি নিয়ে বা জা, ননদ, ভাইয়ের বউ বা শাশুড়ি নিয়ে গল্পে মশগুল দেখে করুণা হয় তেমনি পাশাপাশি একজন অশিক্ষিত/কমশিক্ষিত গামের্ন্টস কমীের্ক দেখলে মনটা ভরে যায়। কত প্রতিক‚লতা বাধা তাদের পথে তবুও তারা নিজের পরিচয়ে বঁাচতে চায়। জীবন সংগ্রামে লড়ে যেতে চায় দৃঢ়প্রত্যয়ে!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<16278 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1