শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চাই সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবতের্নর লড়াই

সাবরিনা জাহান
  ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

নারীমুক্তি নিয়ে চিন্তা, আলোচনা কিংবা নারীমুক্তির লড়াইয়ের সঙ্গে অনেক প্রশ্ন জড়িত। লিঙ্গীয় অবস্থানের কারণে অথবা কাজের বিবেচনায় সাবর্ক্ষণিক এ প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খায় এবং নিশ্চয়ই তার প্রতিফলন ঘটে কাজে। কোনো কাজ লড়াইয়ে পরিণত হয় তখন, যখন তা বাস্তবায়ন করতে গেলে বাধাপ্রাপ্ত হয়, কোনো প্রতিপক্ষ দঁাড়ায়। সহজভাবে সে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করেই মানুষ তার কাক্সিক্ষত জায়গায় পেঁৗছায়। কিন্তু মানুষ হিসেবে নারী, ব্যক্তি নারীর মযার্দা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পরিচালনা করতে গিয়েই এসব প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। পুরুষতন্ত্র নারীর সমঅধিকারের, নারীর মানবাধিকারের অথবা নারীমুক্তির প্রধান বাধা। কিন্তু পুরুষতন্ত্র কোন রূপে নারীর সামনে হাজির হয় এবং কী কারণে এ পুরুষতন্ত্রের উদ্ভব হলো, সেটাই হলো প্রশ্ন। কেননা নারী মানে শুধু একক নারী নয়, আবার সব নারী একই অবস্থানের নয়।

নারীর মধ্যে বহু সত্তা থাকে, সত্তা বিভাজন অথের্ নারীর ধমীর্য়, জাতিগত সত্তা থাকে, শ্রেণিগত সত্তা থাকে, সামাজিক-অথৈর্নতিক অবস্থান অনুযায়ী তার ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় থাকে। কাজেই জাতি হিসেবে অথার্ৎ লিঙ্গীয় অবস্থান হিসেবে এবং শ্রেণি হিসেবে দুই ভাবেই নারী নিপীড়িত হতে পারে। ধমীর্য় অবস্থানের কারণেও তা হতে পারে। অথার্ৎ ধমীর্য়ভাবে, রাজনৈতিকভাবে নারী নিপীড়িত হতে পারে এবং এসব প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নারীর লড়াই একটি সত্তা। আবার উচ্চবণের্র নারী কখনো হতে পারে অন্য নারীসত্তার নিপীড়নের উপাদান। সে লড়াইয়ে নারী আরেকটি সত্তা। এসব সত্তার ঐক্য-অনৈক্যের মধ্য দিয়ে অনেক প্রশ্ন, নারীমুক্তির লড়াইয়ে অগ্রাধিকারের প্রসঙ্গ।

কাজেই ধমীর্য় মৌলবাদ যখন নারীদের ঘরে প্রবেশ করায় পদার্র অনুশাসনে, তখন গৃহিণী নারী গৃহশ্রমের স্বীকৃতি, মযার্দা থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রবেশ করে কারখানায় মালিকের সস্তা শ্রমিক হিসেবে। সেখানে নারী সবচেয়ে সস্তায় তার শ্রম বিক্রি করে তখন আবার পুঁজিবাদের কাছে কাক্সিক্ষত উপাদান হিসেবে হাজির হয়। এখানে চলে নিপীড়ন, শ্রমবৈষম্য, মজুরিবৈষম্য, কম দামে বেশি নেয়ার প্রবণতা। সস্তা শ্রমের প্রয়োজনে পটুজি নারীকে ঘরের ক্ষুদ্র গÐি থেকে বের করে আনে বৃহত্তর উৎপাদন জগতে। আবার সমান মজুরির কথা, সম্পত্তির সমঅধিকারের কথা উঠলে নারীকে অধস্তন, নিভর্রশীল হিসেবে হাজির করে ধমীর্য় অনুশাসনের দ্বারা। নিজ স্বাথের্ তখন মৌলবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করে পুঁজি এবং প্রকারান্তরে পুঁজির পক্ষেই উদ্ভব হয়েছে সব মৌলবাদী শক্তি এবং রাষ্ট্র তখন ক্ষমতাকে নিঝর্ঞ্ঝাট করার দৃশ্যমান শক্তিরই পক্ষাবলম্বন করে এবং নারীকে বার বার ব্যবহার করে তার হাতিয়ার হিসেবে। সেখানেও নারী ক্ষমতা গ্রহণের জন্য, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূণর্ উপাদান হয়ে দঁাড়ায়, যা কখনো কখনো নারীর জীবনকে এতটাই অনিরাপদ করে তোলে যে নারীর মানবিক সত্তা বিকাশের পথই রুদ্ধ হয়ে যায়।

কাজেই নারীর চলার পথের এ লড়াই চলতে থাকা সমাজের সব স্তরে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধমীর্য় সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু, আদিবাসীÑ সব নারী কোনো না কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হয়, যে কোনো ক্ষেত্রে। তাই নারীমুক্তির লড়াই একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং যা একটি রাজনৈতিক লড়াইও বটে। কারণ সমাজে, রাষ্ট্রে নারীর অবস্থান কী হবে, তা নিভর্র করে সমাজের ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। সমাজ ও রাষ্ট্র কাজ করে তার রাজনৈতিক দশর্ন অনুযায়ী (বুজোর্য়া রাজনীতিতে দলগুলো কখনো কখনো তাদের কৌশলগত অবস্থানের কথাও বলে)। কাজেই নারীমুক্তির লড়াই একটি রাজনৈতিক মতাদশির্ক লড়াই, যার বুজোর্য়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণায় স্বাধীন নারী, ব্যক্তি নারী অথবা প্রগতিশীল নারী প্রতীয়মান হলেও তা আসলে নারীমুক্তির প্রকৃত লক্ষ্যের জন্য কাযর্কর হয়ে ওঠে না।

পুঁজিবাদী মতাদশের্ স্বাধীনতা সাধারণ অবাধ বিচরণকে বোঝায় এবং যার সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতার কোনো সম্পকর্ থাকে না। এখানে ব্যক্তি স্বাধীনতার ঘোড়দৌড় সমাজের অন্যান্য মানুষকে পশ্চাতে ফেলে ব্যক্তিকে উঁচুতে উৎসাহিত করে। বুজোর্য়া ‘ব্যক্তিক’ উন্নয়ন সমাজের সব মানুষের সমান মুক্ত বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে না। ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মিক দূরত্ব তৈরি হয়। অন্যকে দাবিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাওয়ার নানামুখী প্রবণতা দেখা দেয়। তাই কখনো কখনো বুজোর্য়া রাজনৈতিক দলে গুটিকয় নারী গুরুত্বপূণর্ উচ্চপদে আসীন হওয়ার পরও তা সমাজে নারীর সামগ্রিক অবস্থার পরিবতের্ন বিশেষ ভ‚মিকা রাখতে পারে না। কারণ ব্যক্তিগত পাওয়ায়ই তাকে আবিষ্ট করে রাখে, যা পুঁজির ধমর্। এবং তাকে ব্যবহার করা হয় সমাজের অন্য নারীদের অবদমিত করে রাখার জন্য। এখন সেই নারী পুরুষতন্ত্রের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। কাজেই একটি দলে বা গ্রæপে কতজন ব্যক্তি নারী আছেন বা গুরুত্বপূণর্ অবস্থানে আছেন, তার ওপর নারীর প্রকৃত অবস্থান পরিবতের্নর বিষয়টি নিভর্র করে না। নিভর্র করে তার দলের রাজনৈতিক এজেন্ডার ওপর। নারীবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির, নারী অধস্তনতার মূল কারণ অথার্ৎ ব্যক্তিগত সম্পত্তি উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে যে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম এই নারী-পুরুষের সম্পকর্ ভিন্ন মাত্রা বা রূপ ধারণ করেছে তা স্বীকার করে সমাজের বণ্টনব্যবস্থার আমূল পরিবতের্ন বিশ্বাসী হতে হবে। আর না হয় ক্রমে পুঁজিবাদের বৈষম্যকে টিকিয়ে রেখে সমাজের কোনো অংশেরই প্রকৃত মুক্তি আসতে পারে না। কারণ নারী অধস্তনতার প্রথম ধাপ শুরু হয়েছিল তার অথৈর্নতিক নিভর্রশীলতার মধ্য দিয়ে এবং তার সন্তান ধারণের সামাজিক সম্পকর্ নিণের্য়র মধ্য দিয়ে। কাজেই অথৈর্নতিক মুক্তি এবং তার সঙ্গে নারীর সমাজ বিকাশের সমান ভ‚মিকার স্বীকৃতি ছাড়া তো নারীমুক্তি সম্ভবপর নয়।

প্রকৃত অথের্ চ‚ড়ান্ত নারীমুক্তি আসলে কোন সমাজে ঘটবে, তা এখনো আলোচনার বিষয়। তবে চ‚ড়ান্ত মুক্তির লড়াইটি চলমান ও সাবর্ক্ষণিক এবং সেটা উত্তরোত্তর চলতে থাকবে অপেক্ষাকৃত উন্নত সমাজের লক্ষ্যে; কিন্তু লড়াইটা শুরু করতে হবে রাজনৈতিক, মতাদশির্ক প্রশ্নের জায়গা থেকে। যার জন্য নারীকে লড়াই করতে হয় দ্বৈত শত্রæর বিরুদ্ধেÑ শ্রমিক হিসেবে তার লড়াই পুঁজির বিরুদ্ধে এবং নারী হিসেবে তার লড়াই পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। কেননা সস্তা শ্রমের প্রয়োজনে পুঁজি নারীকে ঘরের বাইরে উৎপাদন জগতে আবার সামাজিক ক্ষমতার বাইরে তাকে গৃহবন্দি করে নিভর্রশীলতার নামে। কাজেই পুরুষতান্ত্রিক পুঁজির শ্রমদাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে নারীমুক্তির লড়াই শুধু কারখানাভিত্তিক কিছু দাবি-দাওয়া বা ইউনিফরম ফ্যামিলি কোডের দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। কারণ, আঘাত হানতে হবে গোটা ব্যবস্থায়, যার জন্য এমন রাজনৈতিক, অথৈর্নতিক ও সামাজিক পরিবতর্ন দরকার, যা শুধু কমর্সূচিভুক্ত নয়, আদশর্গত। এবং লড়াইয়ের প্রথম শত্রæ হলো এমন সমাজব্যবস্থা, যার প্রথম ভিত্তি ব্যক্তিগত সম্পত্তি। গুটিকয় লোকের হাতে সব সম্পত্তি জড় হলে সম্পত্তি বাড়ানোর চাহিদা তাকে নিপীড়কের ভ‚মিকায় অবতীণর্ করে, যার ফলে সমাজে তৈরি হয় নিপীড়িত-নিযাির্তত মানুষ। তাদের শ্রেণিসংগ্রাম লিঙ্গীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে। নিপীড়কের সঙ্গে এখন যুক্ত হয় ধমীর্য় মৌলবাদী গোষ্ঠী, বাণিজ্যিক স্বাথর্, সাম্রাজ্যবাদ; কাজেই সে লড়াই এখন তার নারীর লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকে না, তৈরি করে পৃথিবীর মুক্তিকামী সব মানুষের লড়াইয়ে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<10362 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1