বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অতঃপর মঞ্চ ি

মর্জা আবু হেনা কায়সার টিপু
  ২৪ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সন্তোষ, জি গুরু, যেই কয় মাস ধইরা টানা রিহার্সেল করেছো তোমরা। এইবার মনে হয় নাটকটা দর্শকদের মন জয় করতে পারব।

ব্যাটা সন্তোষ, জি গুরু। এইবার যদি গতবারের মতো করছ। তোর মাথা ফাটাই দেব আমি। আমি বলি, তোরে যেই সংলাপ দিতে কই, তুই অর্ধেক ভেতরে জমা রাইখা অর্ধেক সংলাপ ডেলিভারি দেস কেন? তুই বাকি সংলাপ ব্যাংকে জমা করবি? না গুরু, বেশি মানুষ দেইখখা......।

এই অভ্যাস সংশোধন করন লাগব। ব্যাটা মঞ্চের কাজটাই তো হইলো মানুষের সামনে। তুই কি মানুষের পেছনে বাকি সংলাপ কইবি। আমি কিন্তু সাবধান কইরা দিলাম। গতবার তোর কারণে লজ্জিত হইছি, ছি ছি ছি, তুই থাইমা যাস, দর্শক উপহাসের হাসি হাসে। আমার জীবনে কোনো দিন এমন পোলাপাইন নিয়া নাটক করি নাই।

বনমালীরে দেখ, আহারে দুই চাইরটা মানুষ সামনে থাকলেই কি অনর্গল ঝরঝরে সংলাপ আওড়ে যাস। মঞ্চে উঠলে দর্শক নিস্তব্ধ হইয়া যায় তর দাপটে।

বাসন্তী তোর কি হইছে- ক তো? তরে সংলাপ দিলাম মাথা নিচু কইরা ভয় ভয় ছিল সেই সংলাপ। তুই মাথা উঁচু কইরা বনমালীর মুখের দিকে তাকাইয়া রইলি। মাথা খারাপ মাইয়া, তুই কই পাইলি এই সংলাপ? আমি তোর প্রেম দিয়া কাঁথা সিলাইবো, তোর প্রেম দিয়া জামার বোতাম, সিলাইবো, আমি তোর প্রেম দিয়া রসুন তেলে নাইলস্না শাকের চচ্চরি রান্না করব, আমি তোর প্রেম দিয়া গরম ভাত রান্না করব, কি, খাইবি না বনমালী? হঁ্যা বাসন্তী খাব, তোমার হাতের গরম ভাত খাব। বনমালী, জি গুরু। বাসন্তী যে আউলা সংলাপ দিল, তুই সঙ্গে সঙ্গে বিপরীত সংলাপ কেন দিলি? নির্দেশক কি আমি না তুই? জি ওস্তাদ আপনি। তাইলে দর্শকের সামনে তোরা দুইজন আমার ইজ্জত নিয়া টানাটানি করতে পারলি? কি বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে গেল গতবার, এইবার আমি সেইসব দুরবস্থা চাই না। মাফ করবেন গুরু, বাসন্তী যখন পাটশাক আর গরম ভাতের কথা বলল, আমার কি জানি হয়ে গেল। খাইতে ইচ্ছে করল। গুরু, বাসন্তী কেন এই মুহূর্তে পাটশাক আর গরম ভাতের কথা বলল! আমার কি দোষ? থুক্কু থুক্কু, তিন থুক্কু, গুরু আমারই দোষ, আমি আসল সংলাপ ভুইলা গেছিলাম। তাই এই আউলা সংলাপ দিছি, সব দোষ আমার, আপনার বাসন্তীর এই অপরাধ ক্ষমা কইরেন গুরু।

নাটকে বনমালীর চরিত্রটা তো ছিল হরমুজের, বাসন্তীর চরিত্রটা ছিল মরিয়মের, তুই হরমুজও কইলি না, ডাইরেক্ট বনমালী কইয়া, আর বনমালী তুই মরিয়মও কইলি না কইলি বাসন্তী, দুইজনে আমার নাটকের বারোটা বাজাইয়া দিলি। আরে তোরা খেতা সিলাইবি না বোতাম সিলাইবি, নাইলস্না শাক খাইবি না কলমি শাক খাইবি, আমার নাটকে কেন বাবা?

বনমালী, জি গুরু। গতবার তুই মঞ্চে দৌড়াইয়া উঠলি। অর্ধেক কাপড় নিয়া। উপরের কাপড় ঠিকই পড়লি। নিচেরটা নিলি না। লজ্জা দিবেন না গুরু। সর্টপ্যান্ট ছিল, উপরের কাপড়টাও মোটামুটি লম্বাটে ছিল। চুপ কর হারামজাদা, জি গুরু। তোরে কি আমি কমিডিয়ান চরিত্র দিছিলাম? তোরে দিলাম ইমোশনাল চরিত্র, তুই প্যান্ট ছাড়া মঞ্চে উইঠা, সেই দর্শকের হাসির কারণ হইলি। সংলাপ কইলি ইমোশনাল, দর্শক চোখের জল ফেলার পরিবর্তে হাসলো। একজন নির্দেশক হিসেবে কতটা কষ্টের ছিল সেই মুহূর্তটি কি করে বলি।

গুরু আমি পায়ে পড়ি ক্ষমা করুন, ভবিষ্যতে একবিন্দু এমন হবে না।

জয়দেব, জি গুরু। আমার কিন্তু মাথায় আছে, তরে কইলাম সতর্ক কইরা দিলাম। এইবার যদি সব প্রস্তুতি নিয়া মঞ্চে উইঠা চিৎকার কইরা কস, মধু ভাই অ মধু ভাই, পর্দা টাইনা দাও, ওরে বাবারে আমার ডর লাগছে। তর একদিন কি আমার একদিন; জি গুরু।

অই ব্যাটা মধু, তরে কে কইছে ইচ্ছে মতো পর্দা টানতে। পর্দা কি তর বাপের সম্পত্তি? গুরু, জয়দেবের ডর দেইখ্‌খা আমার মাথা ঠিক আছিল না। এইবার মাথাডারে আগেই কইয়া রাইখো ঠিকঠাক থাকতে, না হয় তোর মাথা আমি আলাদা কইরা দেম।

বনমালী সেইসব দিনগুলি মনে হইলে ভালস্নাগে না রে। গুরু চইলা গেল। এই মঞ্চের প্রেম গুরুই আমাদের ভেতরে বাইরে দুইয়া দিছিল অসম্ভব নেশা। সেই নেশা থাইক্কা আমরা দুইজন আর বারোইতে পারলাম না। ঠিকই বলেছ সন্তোষ দা। জীবনের একটা বড় অংশই আসলে সংলাপে আর মঞ্চে কাটিয়ে দিলাম। কি পেলাম কি না পেলাম সেসবের হিসেবে নাই বা যাই। অভিনয়কে ভালোতো বেসেছিলাম। তোমার কি মনে আছে সন্তোষ দা, গুরু বলতো, কোনো দিনও টেলিভিশনে অভিনয় করবি না। আরে ব্যাটা মঞ্চই হইলো নাটকের প্রাণ। দর্শকের সামনে অভিনয় করতে পারার সুখ তুই আর কোনো মাধ্যমেই পাইবি না। সস্তা জনপ্রিয়তা হয়তো পাইবি। পাইবি হয়তো কিছু টাকা- পয়সাও, কিন্তু সুখ বস্তু অধরাই থাইকা যাইবো।

বনমালী তুই আর আমি ঠিকই রাখলাম গুরুর কথা। অথচ দেখ, জয়দেব বাসন্তী ঠিকই টেলিভিশনে ছুইটা গেল। সস্তা জনপ্রিয়তাও পাইল, পাইল আর্থিকভাবে উন্নতিও। ওরা গাড়িও কিনছে ফ্ল্যাটও কিনছে। যেদিকে যায় এক শ্রেণির দর্শকতো অন্তত বইলো উঠে। ওই দেখো জয়দেব না, আরে বাসন্তীই তো মনে হইতেছে। বাদ দাও তো সন্তোষ দা। ওইসব ওদের নিজস্ব ব্যাপার। কারও পার্সনাল বিষয়ে হাত না দেওয়াই ভালো। কে নিষেধ করেছে তোমারে। গুরু বলেছে, গুরুর বলা শুনতে হবে। কে বলেছে, তোমারও ইচ্ছে হলে টেলিভিশনে যাও। গুরুর কি আসে যায়। জয়দেব বাসন্তী ওরা গেছে গুরুর কিছু কি যায় আসে।

ওইদিন জয়দেবের সঙ্গে দেখা হইছিল বনমালীর, জয়দেব তার বউ অন্তরা, ছেলে সুদীপ এক সঙ্গে আছিল সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। আমাকে দেখ্‌খাই অতীত স্মৃতি হাতরাইয়া গেল। জানস বনমালী, তোর কথা কইছে। কইলো, বনমালীটা কি এখনো মঞ্চ নিয়ে পাগলামি করছে? বললাম, তোমরা তো মিয়া হারাইয়া গেলা। আমি আর বনমালী এখনো সংলাপ আর মঞ্চ লাইয়া দিন কাটাই। গুরুর মুখটা ভাইসা বেড়ায় দুজনের চোখেমুখে।

সন্তোষ দা, এই জীবনের দৌড়ে অধরাই রয়ে গেল সমস্ত হিসেবের খাতা। পাতায় পাতায় ভরে উঠলো কত কথা কত অকথা। জীবনের রং আসলেই বিচিত্র, মঞ্চের মতোই। এই সেজেগুঁজে সংলাপ আওড়ে যাওয়া। মঞ্চ থেকে নেমে গেলেই সব সংলাপ অচেনা, সব চরিত্রগুলো অচেনা অজানা। তবুও তো মানুষ মানুষ খেলা কি নাট্য মঞ্চ কি জীবন মঞ্চ। সবখানেই চরিত্রের হিসেব নিকেশ। একটা চরিত্র অধ্যয়ন করতেই মানুষের আসা-যাওয়া। একটা চরিত্রের প্রয়োজনেই মানুষের এই মানুষ হয়ে উঠা। হিসাব মিলে না সন্তোষ দা- হিসেব মিলে না।

আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে সন্তোষ দা, চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে। এই পৃথিবীর ছায়ায় ছায়ায় এত অসুন্দর কেন? কেন এই অসুন্দরের ভেতর সব সুন্দরেরা পালিয়ে বেরায়। কিসের এই মানুষ মানুষ খেলা? কিসের এই মানুষ মানুষ অভিনয়? উত্তর কি আছে তোমার কাছে? ঘূর্ণমান অপদার্থ পৃথিবী! জানি উত্তর শিখনি তুমি, শুধু শুনতেই শিখেছো, বলতেও শিখনি। কি আর কথা তোমার কাছে, কি আর অভিযোগ অনুযোগ অভিমান। তুমি একটা মাটির স্তূপ মাত্র, আর কিছুই নও। আমি যে রাজপুত্র, রাজ্যহীন এই সংসার মঞ্চে একটু সংলাপ দিতেই এসেছিলাম। সংলাপ ফুরোলে নেমে যাব মঞ্চ থেকে..... হা হা হা হা....। এই মঞ্চ ফাঁকা হয়ে যাবে সংলাপ ফুরালে। চরিত্ররা যার যার মতো ঘরে ফিরবে খালি হাতে।

এই বনমালী কি হয়েছে তোর? এইটা মঞ্চ না। খোলা আসমানের তলে এইরকম করলে মানুষ কি ভাববো? চুপ কর চুপ কর ভাই।

সন্তোষ দা, জীবনে নাট্য মঞ্চে অনেক সংলাপ বলেছি। আজ জীবন মঞ্চে আমাকে সংলাপ বলতে দাও, বাধা দিও না সন্তোষ দা। জীবন মঞ্চটা নাট্য মঞ্চের চেয়ে বেশ বড়োসড়ো মনে হচ্ছে। আমাকে প্রাণখুলে সংলাপ বলতে দাও। দেখছো না আকাশে বাতাসে খোলামেলা মঞ্চ সাজিয়েছে চতুর পৃথিবী। এই মঞ্চে আমার সংলাপ বলতে দারুণ ভালো লাগছে সন্তোষ দা, তুমিও শুরু করো। নিবারণ চরিত্রটা ধরো। থাম ভাই থাম, কি হইছে তোর। বনমালী চল ফিরা যাই, না সন্তোষ দা কিচ্ছু হয়নি আমার। আমি তো জীবন মঞ্চে সংলাপ বলতে চাইছি, তোমার কি পছন্দ হয়নি অভিনয়টা। আজ গুরু থাকলে নিশ্চয়ই পিঠে একটা থাপ্পর দিয়ে বলতো, এই হইলো আমার সোনার টুকরা। এইদিকে আয় ভাই চোখটা মুইছা দেই। অ চোখে জল এসে গেছে বুঝি?

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<85633 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1