শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মহাকবি মধুসূদন জীবন ও সাহিত্য

সাইফুদ্দিন সাইফুল
  ২৪ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। ইতিহাসের ভেলায় চড়ে কালকে জয় করে হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে একেবারে বুকের মাঝে ধারণ করে শির উঁচু করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে অনেক রক্তের দামে কেনা ভালোবাসার জন্মভূমি বাংলাদেশ। আমাদের এই অতিচেনা অতি জানা চির সবুজের রঙে রাঙানো সোনার দেশের ঐতিহ্যবাহী যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার 'কপোতাক্ষ নদে'র তীরে অবস্থিত সাগরদাঁড়ি গ্রামে ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি সোনার চামচ মুখে নিয়ে এই ধরাধামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলাসাহিত্যের মহাপুরুষ, বাংলা কাব্য প্রথম আধুনিক কবি, বাঙালির চেতনার প্রাণের কবি, অতীব প্রতিভাবান অমর কবি, অমিত্রাক্ষর ছন্দের বাংলা ভাষার প্রবর্তক এবং আধুনিক বাংলা কাব্যের মহান রূপকার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাঙালি কবি মধুসূদনের হাত ধরেই আজকের বাংলা কাব্যের আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে। বাংলা কাব্যে আধুনিকতা, বাংলা মহাকাব্যে বিপস্নবের সুর-ছন্দ; কুসংস্কার ধর্মান্ধতার প্রতিবাদে বিদ্রোহের অগ্নিশিখা কবি মধুসূদনের রচনায় খুব সচেতনভাবেই উঠে এসেছে। আর তাই বাংলা কাব্যে সাহিত্যে আধুনিকতার, বিদ্রোহের প্রতিবাদের ভাষার চেতনার উন্মেষ কবি মধুসূদনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মধ্যেই আলোকিত করেছে।

এই বৃহত্তর ভারত উপমহাদেশে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনকালে আজকের যশোর জেলার কেশবপুর থানার সাগরদাঁড়ি গ্রামের স্থানীয় প্রভাবশালী জমিদার পিতা-রাজনারায়ণ দত্ত আর মাতা স্নেহময়ী জাহ্নবী দেবীর কোল আলোকিত করে, বহুমাত্রিক জ্ঞানের অধিকারী হয়ে প্রিয় কবি মধুসূদন দত্ত এই দুঃখ-কষ্ট; সুখ-শান্তির পৃথিবীতে এসেছিলেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি মনোরম পরিবেশ পাখি ডাকা ছায়া ঢাকা সাগরদাঁড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত বিখ্যাত 'কপোতাক্ষ নদে'র সঙ্গে মিলেমিশে তার অমৃত সুধা সতত পান করে শিশু মধুসূদন ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠেন। আজ কালের সাক্ষী হয়ে এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে মধুসূদনের স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদ। অথচ এই কপোতাক্ষ নদের জলকে মায়ের পবিত্র দুধের সঙ্গে তুলনা করে কবি মধুসূদন রচনা করেছিলেন তার বিখ্যাত সনেট কবিতা (চতুর্দশপদী কবিতা) 'কপোতাক্ষ নদ' কবিতাটি। মূলত 'কপোতাক্ষ নদ' রচনা করে কবি মধুসূদন তার জন্মভূমির একটি নদীর এবং স্বদেশের প্রতি অপার প্রেম গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধ দেখিয়েছেন এবং প্রকাশ করেছেন। এই কবিতায় স্বদেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কৃতজ্ঞতাবোধ মমত্ববোধের মধ্য দিয়ে কপোতাক্ষ নদের যে জল, তার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। 'কপোতাক্ষ নদ' কবিতাটি কবি মধুসূদনের অন্যান্য সনেট কবিতার মধ্যে বিখ্যাত এবং অন্যতম।

কবি 'কপোতাক্ষ নদ' কবিতায় বলেছেন-

সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে,

সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;

সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে

শোনে মায়া-যন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে

জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে

পিতা রাজনারায়ণ দত্তের কাছ থেকে শিশু মধুসূদন মেধা মনন জ্ঞান আহরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পাশাপাশি তিনি তার মাতা জাহ্নবী দেবীর কাছ থেকেই প্রথম রামায়ণ, মহাভারত পাঠ শিক্ষা নিয়েছিলেন। যা পরবর্তী কালে কবি প্রতিভা বিকাশে মেধা সমৃদ্ধিতে অত্যন্ত পেরনা যুগিয়েছিল। আর এ কারণেই কবির জীবনে তার স্নেহময়ী মায়ের প্রভাব ছিল খুবই গভীর। আর তাই কবি মধুসূদন তিনি মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রেম শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের ভেতর দিয়ে এক অনুপম উজ্জ্বল আদর্শ রেখে গেছেন। ইতিহাসের পাতা উল্টালে তারই প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাই। ছেলেবেলায় নিজ গ্রামের এক পাঠশালায় শিশু মধুসূদনের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। কিন্তু গায়ের পাঠশালায় শিশু মধুসূদন বেশি দিন লেখাপড়া শিখতে পারেননি। কারণ, পিতা রাজনারায়ণ দত্ত কর্মের জন্য তার পরিবার পরিজন নিয়ে কলকাতায় খিদিরপুরে এসে বসবাস শুরু করেন। এখানে এসে কিশোর মধুসূদনকে প্রথমে লালবাজার গ্রাম স্কুল পরে হিন্দু কলেজের জুনিয়র শ্রেণিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র সাত বছর।

কলকাতায় হিন্দু কলেজে অধ্যায়ন করার সময়ে কবি মধুসূদন রাজনারায়ণ বসু, ভোলানাথ চন্দ্র, ভুদেব মুখোপাধ্যায় ও গেরীদাস বসাক প্রমুখ মেধাবী কৃতী ছাত্রকে সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন। এসব বন্ধু ছিলেন কবি মধুসূদনের একান্তই প্রিয় বন্ধু। ওরা পরবর্তীকালে স্ব-স্ব কাজের দ্বারা বড় মাপের মানুষ হয়েছিল। এ ছাড়া তিনি এই কলেজে পড়ার সময় রিচার্ডসন ও ডিরোজিও নামে দু'জন ইংরেজ পন্ডিতের সঙ্গ পেয়েছিলেন এবং তাদের দ্বারা কবি ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, কবি মধুসূদন তার এই প্রিয় দুই পন্ডিতের অন্ধভক্ত ছিলেন।

ছাত্র হিসেবে মধুসূদন বরাবরই ভালো ছিলেন, কৃতী ছাত্র হওয়াতে তিনি বৃত্তিও পেয়েছিলেন। এমনকি তিনি নারী শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে বিগত ১৮৪২ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। আর এই জন্য তিনি স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। হিন্দু কলেজে পড়া অবস্থায় কবি মধুসূদনের জীবনে এক বাক পরিবর্তন হয়। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন। এ সময় কবির মনেপ্রাণে বিশ্বাস জন্মেছিল যে, ভবিষ্যতে বড় কবি হতে হলে ইংরেজি সাহিত্যচর্চার কোনো বিকল্প নেই। আর তখন থেকেই তিনি ইংরেজি সাহিত্যকে মনেপ্রাণে প্রাধান্য দিতে থাকেন এবং ইউরোপ বিভুঁইয়ে যাওয়ার জন্য মনস্থির করেন। শুধু কি তাই! কবি মধুসূদন এ সময় তাসো, ভার্জিল, হোমার ও মিলটনের মতো জগৎবিখ্যাত ইংরেজ কবি লেখকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং এসব কবির মতো তিনিও বড় কবি হবেন এ আকাঙ্ক্ষা মনেপ্রাণে বিশ্বাস এবং ধারণ করতেন।

কবি মধুসূদন বিগত ১৮৪৩ সালে ৯ ফেব্রম্নয়ারি তার বাপ-দাদার ধর্ম হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান ধর্মগ্রহণ করেন এবং নতুন করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত নাম ধারণ করেন। মূলত এই নতুন নামেই তিনি পরিচিত হন। এ সময় তিনি হিন্দু কলেজ ছাড়েন এবং কিছুদিন পরে কবি মধুসূদন কলকাতার শিবপুরে বিশপস কলেজে ভর্তি হন। এরপর বিশপস কলেজ ত্যাগ করে তিনি ১৮৪৮ সালে মাদ্রাজে চলে যান। সেখানে তিনি 'মাদ্রাজ মেলঅর্ফান এসাইলাস' বিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষতার পদে চাকরি নেন। এখানেই থাকা অবস্থায় তিনি ইংরেজিতে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ইংরেজিতে লেখা মধুসূদনের কবিতা-প্রবন্ধ সে সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন ভাষাও শিখতে থাকেন। কবি মধুসূদনের ইংরেজিতে লেখা কবিতাগুলোকে কখনো উপেক্ষা করা যাবে না। কারণ, সেগুলো তার কবিসত্তার এক মূল্যবান অংশ।

মাদ্রাজে বসবাসকালে কবি মধুসূদন রেবেকা ম্যাকটাভিস নামে এক নীলকর কন্যাকে বিবাহ করেন। সংসার জীবনে কবির চার সন্তান হয়েছিল। যদিও তাদের এই দাম্পত্য জীবন তেমন সুখের ছিল না। তারপর এক সময় ইংরেজ কন্যা এমেলিয়া হেনরিয়েটার সঙ্গে কবি মধুসূদনের পরিচয় হয়। কালক্রমে দু'জনার মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কবি মধুসূদনের জীবনে সুখে-দুঃখে হেনরিয়েটা সব সময়ের জন্য পাশে থাকতেন। ১৮৫৫ সালে জানুয়ারিতে মধুসূদন কলকাতা আসেন, তার কিছুদিন পর হেনরিয়েটাও মাদ্রাজ ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। কবি মধুসূদন কলকাতায় আসার পর তিনি দেশীয় শিল্প-সাহিত্য-ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি নিজেকে একান্তে চর্চায় মনোনিবেশ করেন। বিশেষ করে মায়ের ভাষা বাংলা চর্চার প্রতি তার আগ্রহটা বেড়ে যায়। এই বাংলা ভাষার যে অপার শক্তি, অসম্ভব আকর্ষণ আছে তা কবির মনে নাড়া একান্তে দিয়েছিল। আসলে কবি মধুসূদন মনেপ্রাণে বুঝতে পেরেছিলেন যে, অন্যের ভাষা নয়; আপন মাতৃভাষা ইতিহাস ঐতিহ্যই আপনাকে অনেক বেশি বিকশিত, প্রচারিত ও সম্মানিত করবে এবং অন্তরের গভীরে এক প্রেরণা উৎসাহিত করতে সহায়ক হবে। মূলত, মাতৃভাষা বাংলা কতটা আপনার, সমৃদ্ধির এবং প্রেরণার উৎস হতে পারে তা কবি কড়ায়-গন্ডায় যা পুনরায় বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কবি 'বঙ্গভাষা' কবিতায় এভাবেই বলেছেন-

হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন-

তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,

পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ

পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি

কবি মধুসূদন যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেন সে সময়ে বাংলা কাব্য জরাগ্রস্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে কাল অতিবাহিত করছিল। বাংলাসাহিত্যাকাশে কবি মধুসূদনের আগমনে জরাগ্রস্ত বাংলা কাব্য যেন প্রাণ ফিরে পেল এবং নতুনের ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত হলো। চরম সত্যিটা এই যে, মধুসূদনের হাত ধরেই বাংলা কাব্য যে পুনরুজ্জীবন বিকশিত হয়েছিল তা আজকের এই বাংলা কাব্যের ধারাবিহকতার দিব্য প্রকাশ। কেননা, কবি মধুসূদনের নিরলস শ্রম ও আত্মপ্রচেষ্টায় বাংলা কাব্য ও সাহিত্য আজ অনেক অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী হয়েছে। তিনি যেমন বাংলাসাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের স্রষ্টা তেমনি আধুনিক বাংলা কাব্যের রূপকার। মহাকবি মধুসূদন মূলত একজন প্রতিভাবান কালজয়ী কবি। বাংলাসাহিত্যের যে বিষয়ের ওপর তিনি নজর দিয়েছেন- সে বিষয়টি নতুনত্বের ছোঁয়া পেয়েছে এবং বিকশিত হয়ে ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করেছে। আর তাই যুগস্রষ্টা ও আধুনিক বাংলাসাহিত্যের পথিকৃত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আমাদের অহংকার, গৌরব ও বাঙালি জাতীয় সত্তার ও চেতনার প্রতীক।

১৮৬২ সালে ৯ জুন কবি মধুসূদন ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার সময়ে ভীষণভাবে এক অর্থাকষ্টে পড়েছিলেন। তারপরেও তিনি আপন মেধার বলে এবং বহু চেষ্টার ফলে ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। শত অর্থাকষ্ট তাকে তার এই ব্যারিস্টারি পড়তে এতটুকু বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। অবশ্য তার এই বিপদের সময়ে মনীষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সহৃয়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর তাই তিনি আর্থিক দুর্বিপাক থেকে অনেকটা উদ্ধার লাভ করেছিলেন। কবি মধুসূদন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতি অতীব মুগ্ধ হয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার জায়গা থেকে তিনি তাকে নিয়ে একটি চমৎকার সনেট কবিতা রচনা করেছিলেন।

কবি 'ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর' কবিতায় লিখেছেন-

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে,

করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে;

দীন যে, দীনের বন্ধু! উজ্জ্বল জগতে

হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্স্নান কিরণে

\হবিগত ১৮৬৭ সালে কবি মধুসূদন বিদেশ ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন এবং কলকাতার হাইর্কোটে ব্যারিস্টারি হিসেবে যোগ দেন। এ সময়ে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। কিন্তু তা যথাযথ ধরে রাখতে পারেননি। অমিতব্যয় ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের কারণে তার ওপর আবার নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। ফলে ব্যারিস্টারি ছেড়ে প্রিভি কাউন্সিল আপিলের অনুবাদ বিভাগে চাকরি নিলেন। প্রায় দুবছর এ পদে চাকরি করার পর আবার ব্যারিস্টারিতে ফিরে এলেন। এবারও তিনি তেমন সুবিধা করতে পারেননি। ফলে পঞ্চকোট রাজ্যের আইন উপদেষ্টার পদে নিযুক্ত হন। কিন্তু এখানেও তিনি বেশি দিন চাকরি করতে পারেননি।

১৮৫৮ সাল থেকে ১৮৬২ সাল পর্যন্ত মাত্র ৫ বছরের মধ্যে কবি মধুসূদন একে একে রচনা করেন- তিলোত্তমাসম্ভব, মেঘনাদবধ, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য এবং শর্মিষ্ঠা নাটক, পদ্মবতী নাটক, একেই কি বলে সভ্যতা, কৃঞ্চকুমারী নাটক, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো ইত্যাদি নাটক ও প্রহসনসহ বিভিন্ন কাব্য ও কবিতা। এখানে একটি বিষয় উলেস্নখ করতেই হচ্ছে যে, মধুসূদনের অমর সৃষ্টি 'মেঘনাদবধ কাব্যে'র পাশাপাশি তার রচিত অন্যান্য রচনা অর্থাৎ সব কাব্যের ভেতরে মানবতার জয়গান প্রকাশ পেয়েছে। মানবিক মূল্যবোধই তার রচনাতে বারংবার উঠে এসেছে। কেননা, মানবিক মূল্যবোধ কিংবা মানবতাবাদ কবি মধুসূদনের চিন্তাচেতনার একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল। একথা সত্যি যে, মধুসূদনের রচনার মধ্যে যে আধুনিকতা আমরা খুঁজে পেয়েছি বা প্রকাশ হয়েছে তা মূলত মানবিকতা অথবা মানবতাবাদেরই দিব্য প্রকাশ। এ ছাড়া তার রচনার মধ্যে মানবতার পরেই স্বাধিকার চেতনার প্রতিবাদের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে উঠে এসেছে।

কবি মধুসূদন তার জীবদ্দশায় বেশকিছু মহাকাব্য রচনা করেছিলেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দে তিনি প্রথম রচনা করেছিলেন 'তিলোত্তমাসম্ভব' নামে মহান কাব্যটি। এই কাব্যেও মধুসূদন মানবিকতার দিকটাকে উপস্থাপন এবং নান্দনিকতার প্রকাশ করেছেন। যদিও তিনি নাটক 'পদ্মবতী' লেখার সময় অমিত্রাক্ষর ছন্দ আবিষ্কার করেন। ১৮৫৯ সালে মধ্য সময় থেকে ১৮৬০ সালের প্রথম দিকে 'তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য'টি রচনা শেষ হয়েছিল। এই বছরেই ওই কাব্যটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। আর এই প্রকাশের যাবতীয় ব্যয়ভার সার্বিকভাবে বহন করেছিলেন মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর। কবি মধুসূদন প্রকাশিত 'তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য'টি রাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে উৎসর্গ করেছিলেন। এই কাব্যটির মধ্যেও মানবতাবাদের জয়গান ফুটে উঠেছে।

কবি মধুসূদনের দ্বিতীয় মহাকাব্য 'মেঘনাদবধ মহাকাব্য' বাংলাসাহিত্যে নতুন সংযোজন হয়ে বাংলা মহাকাব্যকে প্রাণ দিয়েছিল। ১৮৬১ সালে কাব্যটির রচনা শেষ হয়েছিল এবং একই সালে কাব্যটি দুই খন্ডে প্রকাশিতও হয়েছিল। রাজা দিগম্বর মিত্র এই মহাকাব্যটির প্রকাশনার সব খরচ বহন করেছিলেন। কবি মধুসূদন তার এই মহাকাব্যটি রাজা দিগম্বর মিত্রের ওপরে উৎসর্গ করেছিলেন। এই 'মেঘনাদবধ কাব্যটি' যখন প্রকাশিত হয় তখন কবির অপার সৃজনশীল প্রতিভা, তার কাব্য সৌন্দর্যবোধ এবং ছন্দ রূপ রস নিয়ে অনেকেই সে সময়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনায় মেতে উঠেছিলেন।

বাংলাসাহিত্যের আর এক প্রতিভা 'বৃত্রসংহার' মহাকাব্যের রচয়িতা হেমচন্দ্র বন্ধ্যোপাধ্যায় 'মেঘনাদবধ মহাকাব্য' সম্পর্কে বলেছেন- 'মেঘনাদবধ মহাকাব্য রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্তের আজ কি আনন্দ! এবং কোনো সহৃদয় ব্যক্তি তার সেই আনন্দে আনন্দিত না হইবেন। অমিত্র-ছন্দে কাব্য রচনা করিয়া কেহ যে এত অল্পকালের মধ্যে এই পয়ার পস্নাবিত দেশে এরূপ যশোলাভ করিবে একথা কাহার মনে ছিল; কিন্তু বোধ হয়, এক্ষণে সকলেই স্বীকার করিবেন যে মাইকেল মধুসূদনের নাম সেই দুর্লভ যশঃপ্রভায় বঙ্গমন্ডলীতে প্রদীপ্ত হইয়াছে।' মূলত, 'মেঘনাদবধ মহাকাব্যে'র মধ্যে কবি মধুসূদনের মানবতাবাদী চেতনার, স্বদেশ প্রেমের অমর কাহিনী, বিদ্রোহের সুর এবং জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছে। এখানে তিনি লংকার অধিপতী রাবণকে নায়করূপে উপস্থাপনের ভেতর দিয়ে মানবতাবাদের স্বাধিকারের দেশপ্রেমের এবং দ্রোহের দিকটাকে তুলে ধরেছেন। আধুনিক কবি মধুসূদন মানবিকতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে রাবণের মধ্যে মানবতার ভাবকে জাগ্রত করেছেন।

'ব্রজাঙ্গনা কাব্য' কবি মধুসূদনের তৃতীয় কাব্য। এই কাব্যটি 'মেঘনাদবধ কাব্য' রচনার আগে লেখা হয়েছিল। কবি এই কাব্যে রাধাকে মানুষের পৃথিবীর বুকে একজন অতীব মানবী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি এখানে দেখাতে চেয়েছেন যে, রাধা মানবী হওয়া সত্ত্বেও একজন সাধারণ নারী। 'বীরাঙ্গনা কাব্য' কবি মধুসূদনের চতুর্থ ও শেষ কাব্য। এই কাব্যটি ১৮৬২ সালে প্রথম দিকে কবি রচনা করেন এবং একই বছরে শেষ দিকে কাব্যটি প্রকাশিত হয়। 'বীরাঙ্গনা কাব্য'টি মূলত পত্র-কাব্য হিসেবেই অধিক পরিচিত। বাংলা সাহিত্যে ইহা পত্রাকারে রচিত এই ধরনের কাব্য এটিই প্রথম। কবি মধুসূদন এই কাব্যে উলিস্নখিত নারীদের ধর্মের বেড়াজাল ছিন্ন করে সম্পূর্ণরূপেই আধুনিক নারী হিসেবে আধুনিকতার রঙে পরশ রাঙিয়ে সমাজের সামনে কালের সম্মুখে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। 'বীরাঙ্গনা কাব্যে'র নারীরা এখানে মানবতাবাদী প্রেমের প্রতীক হয়ে উঠে এসেছে।

বহু প্রতিভার অধিকারী কালজয়ী মহাকবি মধুসূদন কাব্যসাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ ও বিকাশ ঘটিয়েছেন, তেমনি আবার নাট্যসাহিত্যকেও সমানভাবে সমৃদ্ধ ও শৈল্পিক করে তুলেছিলেন। তিনি পাশ্চাত্য রীতিনীতি অনুসরণে চতুর্দশপদী কবিতার পাশাপাশি নাট্যকাব্যও রচনা করেছেন। 'শর্মিষ্ঠা নাটক' কবির প্রথম বাংলা রচনা। এটি বিগত ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয়। 'শর্মিষ্ঠা' নাটকটি তিনি ইংরেজিতে অনুবাদও করেছিলেন। গ্রিক পুরাণের কাহিনী অবলম্বনে কবি মধুসূদন রচনা করেছিলেন 'পদ্মাবতী নাটক'। এই নাটকটি ১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয়। 'একেই কি বলে সভ্যতা' এবং 'বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রো' নামে দু'টি ব্যঙ্গাত্মক প্রহসন প্রকাশিত হয় ১৮৬০ সালে। এই প্রহসন দু'টির প্রকাশনার খরচ বহন করেছিলেন বেলগাছিয়া ছোটো রাজা ইশ্বরচন্দ্র সিংহ। এ দু'টি প্রহসন কবি মধুসূদন বেলগাছিয়া থিয়েটারের জন্য রচনা করেছিলেন। কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয় যে, এই এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির ভীষণ আপত্তির ফলে প্রহসন দুটি মঞ্চস্থ হতে পারেনি। এতে করে কবি মানসিকভাবে খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। 'কৃঞ্চকুমারী' ও 'মায়াকানন' নামে কবি আরও দু'টি নাটক রচনা করেছিলেন।

১৮৬১ সালে 'কৃঞ্চকুমারী নাটক' এবং ১৮৭৪ সালে মার্চ মসে 'মায়াকানন নাটক'টি প্রকাশিত হয়। কবি মধুসূদনের 'হেক্টরবধ' একটি গদ্যকাব্য রচনা। এটি পৃথিবীর বিখ্যাত মহাকবি হোমারের 'ইলিয়াড' মহাকাব্যের কাহিনী অবলম্বনে অনুবাদ রচনা। মহাকবি হোমারের 'ইলিয়াড' মহাকাব্যটি কবি মধুসূদন গ্রিক ভাষায় পড়ার পর সেটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। যদিও কবি মধুসূদন দত্ত তার জীবদ্দশায় এই অনুবাদ রচনাটি শেষ করতে পরেননি। ফলে ১৮৭১ সালে ১ সেপ্টেম্বর মাসে 'হেক্টরবধ' গ্রন্থটি অসমাপ্ত অবস্থাতেই প্রকাশিত হয়।

'চতুর্দশপদী কবিতাবলী' (সনেট) কবি মধুসূদনের এক বিস্ময়কর অমর সৃষ্টি। সনেটের জন্য তিনি বাংলা সাহিত্যাকাশে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। পাশ্চাত্য সনেটের অনুসরণে রচিত সনেট বাংলা সাহিত্যে একদিকে যেমন নতুন, অন্যদিকে এক নব অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। কবি মধুসূদন 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী'গুলোর অধিকাংশ রচনা করেছিলেন ফ্রান্সের ভার্সেস শহরে অবস্থান সময়ে। এই সনেটগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ সালে ১ আগস্ট মাসে। রামগতি ন্যায়রত্ন ওই গ্রন্থ সম্পর্কে নিজস্ব মত ব্যক্ত করেছেন এভাবে- 'কবি যৎকালে ইউরোপে গমন করিয়া ফরাসি দেশস্থ ভরসেলস নগরে অবস্থান করেন, তৎকালে এই কাব্য রচিত হয়। কবির স্বহস্তে লিখিত ইহার উপক্রমভোগ লিথোগ্রাফে মুদ্রিত হইয়াছে। তদ্বারা তাহার হস্তলিপি দর্শনেচ্ছুগণ পরিতৃপ্ত হইবেন। মিত্রাক্ষর ও অমিত্রাক্ষর উভয়বিধ ছন্দের চতুর্দশ পঙক্তিতে একশতটি পৃথক বিষয় ইহাতে বর্ণিত হইয়াছে।' এ ছাড়া চতুর্দশপদী কবিতার পাশাপাশি কবি মধুসূদনের বিভিন্ন সময়ে রচিত 'নানা কবিতা' নামে গৃহীত হয়েছে।

আমাদের কবি মধুসূদন একটা সময়ে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এবং শেষ জীবনে ভয়ঙ্করভাবে অর্থাকষ্টে ঋণগ্রস্ত ও অসুস্থতার ফলে কবি মধুসূদনের জীবন ভয়াবহ দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। তারপর সব চাওয়া-পাওয়া উপেক্ষা করে ১৮৭৩ সালে ২৯ জুন কলকাতার এক হাসপাতালে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃতু্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৪৯ বছর। আর এই ৪৯ বছরে কবি মধুসূদন বাংলাসাহিত্যে যা দিয়েছিল তা সত্যিই অতি মূল্যবান ও দুর্লভ। যতদিন বাংলাসাহিত্য বাংলা কাব্য পৃথিবীতে টিকে থাকবে ততদিন কবি মধুসূদনের অসাধরণ বৈচিত্র্যময় সৃচনশীল অমর সৃষ্টি বেঁচে থাকবে। কবি মধুসূদন যে সময়ে মৃতুবরণ করেছিলেন, সে সময়ে তিনি বেশকিছু রচনা শুরু করেও শেষ পর্যন্ত শেষ করে যেতে পারেননি। কলকাতায় কবির সমাধি লিপিতে এপিটাফে কবি তার দৃঢ় বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার জায়গা থেকে কবি হৃদয়ের যে বেদনা তা প্রকাশ করেছেন।

এখানে কবি মধুসূদন বলেছেন-

দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব

বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে

(জননীর কোলো শিশু লভয়ে যেমতি

বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত

দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন.............

পরিশেষে, বাংলা কাব্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি, আধুনিক কবি ও বাংলা কাব্যে নতুন ধারা (অমিত্রাক্ষর) প্রবর্তনকারী আমাদের প্রিয় মহাকবি মধুসূদন বাংলা শব্দে ছন্দেভাবে শিল্পে একজন কালজয়ী মহাপুরুষ। কালের সন্তান, যুগের কণ্ঠস্বর, মানবতার বক্তা যুগান্তরের মহানায়ক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সৃষ্টি অসম্ভব অনিন্দ সুন্দর অমর সাহিত্যকর্ম; বাংলাসাহিত্যকে/কাব্যকে অনেক অনেক কালদীপ্ত আলো হয়ে জগৎ সংসারে সাহিত্য ভুবনে আলোকিত করবে। মধুসূদনের সমগ্র সাহিত্যকর্মে মানবিকতা, স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধের যে অপার উন্মেষ ঘটেছে; তা বাংলা কাব্যকে বাঙালি জাতিকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও বিকশিত করেছে। হে মহাকবি, যুগস্র্রষ্টা কাব্যপ্রেমিক মধুসুদন তুমি তোমার আপন সৃষ্টির মাঝেই সতত জাগ্রত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<85618 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1