বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাতার্ মূল: বেন ওকরি অনুবাদ : মনির তালুকদার

নতুনধারা
  ১৭ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

তুমি এসেছ নোংরা এবং ক্ষুধাতর্। তোমার সারা শরীর ঝুলকালিতে মাখা। তুমি এসেছ হিমরেখার ওপার থেকে। এটা হলো স্মরণীয় সুদীঘর্ যাত্রা। তুমি বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটেছ, অসংখ্য শহর এবং গ্রাম অতিক্রম করেছ, মাঝপথে হয়তো গুটি কয়েক জায়গায় থেমেছ, তবে বেশিরভাগ সময় হেঁটেছ এবং পরনের কাপড়চোপড়ও হয়তো কখনো পাল্টাওনি।

তুমি এমন সব এলাকা পেরিয়ে এসেছ, যেখানে ছিলে অপরিচিত এবং ভাষা জানতে না, এমনকি তাদের আচার আচারণ সম্পকের্ও তোমার কোনো ধারণাই ছিল না। রাস্তার পাশে অচেনা সরাইখানায় ঘুমিয়েছ। আর তুমি একাই যাত্রা করেছ এবং একটিমাত্র বাতার্ বহন করে এনেছ যা একমাত্র তুমিই তা বহন করার ক্ষমতা রাখ।

তুমি কতক্ষণ ভ্রমণ করেছ? তুমি তা জানো না হয়তো তোমার পুরো জীবন।

তুমি পথিমধ্যে তোমার শুখানুভ‚তিকে পরিহার করেছ। যাত্রাকালীন সময়ে সুখ-আনন্দকে ধরে রাখা খুবই কঠিন কাজ। তুমি নিদ্রাহীন অনেক রাত কাটিয়েছ এবং দিনেরবেলায় ক্ষুধাতর্ অবস্থায় যাত্রা অব্যাহত রেখেছ। যদিও তোমার গন্তব্য বিশ্রাম এবং খাবার। তোমার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো প্রাচীর ঘেরা অঙ্গনে এসে বাতার্ পেঁৗছে দেওয়া এবং আর তার পরেই তুমি মুক্ত।

তুমি অনেক দেশ পেরিয়ে এসেছ, নেকড়ের সঙ্গে লড়াই করেছ। তুমি কঠিন হৃদয়ের পুরুষদের অতিক্রম করেছ, কৌশলে সুচতুর লোকদের এড়িয়েছ এবং চরিত্রভ্রষ্টা রমণীদের কাছ থেকে সুকৌশলে নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছ।

তুমি আদিম বন বঁাদারে নিজেকে পরিত্যাগ করেছ। তারপরও তুমি তোমার যৌবনকে নিয়ে যাত্রা অব্যাহত রেখেছ এবং কখনই পুরোটা হারাওনি। যৌবন তোমার স্বাধীনতা এবং আত্মার সরলতার সঙ্গে মিশে আছে।

ধূলি-ধূসরিত সড়ক তোমার সংরক্ষিত সজীবতা। হয়তো যাত্রার শেষটা ছিল খুবই খারাপ। গন্তব্যের কাছাকাছি পেঁৗছানো ছিল দূরে সরে যাওয়ার মতো। রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে দৃষ্টির সীমানার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া সহজ। একজনের আগমন অনুভব করা সোজা, যখন কেউ ক্যাসেলের মিনার, শোভিত পতাকা এবং ব্যানার দেখে। তারপর আশা এবং উল্লাস এসে পুনরায় মন ভরিয়ে দেয়। তথাপি পথ তখনও অনেক দূরে। দূরত্ব হলো প্রবঞ্চক। আশা সবকিছুকেই অতি নিকটে নিয়ে আসে এবং প্রমাণ করে বিশ্বাসঘাতীও।

তুমি পথের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করেছিলে। তবে একবার গ্রামের পথে হারিয়ে গিয়েছিলে। একসময় রাত কাটানোর জন্য প্রলুব্ধ হয়েছিলে এমনকি একজন বৃদ্ধ মহিলার কাছে তোমার গন্তব্য ফঁাস করে দিতে চেয়েছিলে। তবে তা না করে বরং উল্টাপাল্টা ও নিজের মনগড়া অজুহাত দিয়ে ছিলে। শেষপযর্ন্ত সত্যটা তুমি তোমার হৃদকন্দরে গোপন রেখেছিলে। হয়তো তোমার মনে হয়েছে তখনও তুমি যাত্রার প্রারম্ভে আছ। তুমি সতকর্ ছিলে যে, তখনও বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে অবস্থান করেছিলে এবং তোমাকে অনেক দূর পথ পেরোতে হবে।

তোমার পুরো জীবনটাই এক ধরনের ভ্রমণ। এখন তুমি যদি থেমে গিয়ে ভাব অথবা আশা-আকাক্সক্ষার মুখোমুখি হও, তাহলে কেউ জানে না তোমার সম্মুখে কোনো প্রলোভনের ফঁাদ পাতা আছে এবং তুমি সেই ফঁাদে আটকা পড়ে যাবে। সুতরাং যাত্রা করার জন্যই তুমি তোমার জীবন বাজি রেখেছ। যাত্রা তোমার জীবন আর পথই তোমার জীবন। হয়তো তুমি মারা যেতে পারতে, কিন্তু তুমি ছিলে সতকর্। প্রতিটি মুহ‚তের্ক তুমি গোটা সময় হিসেবে ধরে নিয়েছিলে। তুমি সেটাই করেছ। এক সময় বুঝতে পারলে যে, তুমি গন্তব্যে পেঁৗছেছ। তুমি অঙ্গনের ভেতর আছ এবং যথাস্থানেই আছ। ঝুলকালি এবং ধুলাবালিতে মাখা বাতাির্ট তোমাকে বঞ্চিত করেছে। তবে তোমার কাছে তা ছিল যন্ত্রনাহীন। কেননা বাতার্ সম্পকের্ তুমি কিছুই জানতে না। তোমার মাঝেই ছিল বাতাির্ট, ছিল তোমার ঝুলকালি মাখা এবং অপরিষ্কার শরীরে এবং তোমার সতেজ উদ্দীপনায়। তাছাড়া বাতার্ ছিল তোমার চোখের তারায়, ছিল তোমার আগমনে, তোমার স্বপ্নে তোমার স্মৃতিতে। তুমি যা নিয়ে এসেছ অথবা যা আনতে পারনি, আর তার সবকিছুতেই ছিল তা বিদ্যমান। বাতার্ তোমাকে বঞ্চিত করেছে এবং তোমাকে ভারমুক্ত করেছে। তুমি নিজেকে হালকা অনুভব করেছ, যেন তুমি ঘষামাজার পরে গোসল সেরে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছ। তোমার শরীরের ময়লা কাপড়-চোপড় সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং তোমাকে নতুন পোশাক দেয়া হয়েছে। সেই নতুন পোশাক পরিধান করার পরে তোমাকে আগের মতো উজ্জ্বল মনে হয়েছে।

তোমার বীরোচিত যাত্রাকে স্বীকার করার জন্য একটা গুপ্ত রহস্যপূণর্ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু তোমার উচ্ছ¡সিত প্রাণচঞ্চলতা, যা তোমার অন্তরের স্বাধীনতা, যা ছিল তোমার আসল উপহার। তোমার ভেতরে জ্বলেছিল অবিনশ্বর আলোকচ্ছটা।

তুমি ছিলে তরতাজা যুবক এবং স্বাধীন। রাজ্যের অলিগলিতে ছিল তোমার পদচারণা। তাছাড়া নতুন এবং আলোকিত জগত সম্পকের্ তোমার সম্যক জ্ঞান ছিল। সেই রাজ্যে তুমি জাদুমুগ্ধ জীবন কাটাচ্ছ। তুমি আগেভাগে যাত্রা শুরু করেছ এবং তোমার আকাক্সিক্ষত সময়ের আগেই এসে পেঁৗছেছ। তোমার সম্মুখে পুরো নতুন জীবন অপেক্ষা করছে। তাই তুমি স্বণের্র মতো আলোকিত যৌবন নিয়ে এখানে অবস্থান করছ, যা তোমার উজ্জ্বলতা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। সবকিছুই তোমার সীমানায়। তোমার মূল অভীষ্ঠ লক্ষ্য এবং যাত্রা শেষ হয়েছে। কেননা তুমি আগেই যাত্রা শুরু করেছিলে এবং নিধাির্রত সময়ের আগেই এসে পৌঁছেছ। এখন বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতাও আছে। কি সৌভাগ্য তোমার। কেন ছটফাটানি নেই এবং যে জীবন তুমি কামনা করেছিলে, এখন শুধু সেভাবেই তোমার বেঁচে থাকা প্রয়োজন।

বুকের মধ্যে আশা নিয়ে যেমন কোনো যুবক অপরিচিত বিশাল শহরে আগমন করে, সুপ্রসন্ন ভাগ্য এবং আসল ভালোবাসা খঁুজে বেড়ায়, জীবনের সবচেয়ে সুখী এবং নিষ্কলঙ্ক দিন কাটায়, তেমনই তুমি রহস্যময় দুনিয়ার রাস্তা ঘাটে হালকাভাবে পদচারণা কর। সেখানে আছে রঙিন আকাশে নীলের ছেঁায়া এবং উষাকালের সূযের্র সোনালি আলোকচ্ছটা।

লেখক পরিচিতি

বেন ওকরি নাইজেরিয়ার একজন জনপ্রিয় এবং সফল ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও কবি। তাকে উত্তর আধুনিক এবং উত্তর ঔপনিবেশিক আফ্রিকার লেখকদের মধ্যে অন্যতম সাহিত্যিক হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি ১৯৫৯ সালের ১৫ মাচর্ দক্ষিণ নাইজেরিয়ার মিন্না শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র দু’বছর বয়সে তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে লন্ডনে পাড়ি দেন। তবে ১৯৬৮ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। পরে উচ্চ শিক্ষার জন্য পুনরায় লন্ডনে যান এবং এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। দেশে থাকাকালে গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, মাতৃভূমির প্রতি গভীর মমতা এবং স্বদেশী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তার লেখার মূল বিষয়। মাত্র ২১ বছর বয়সে তার প্রথম উপন্যাস “ফ্লাওয়াসর্ অ্যান্ড শ্যাডোস” এবং প্রকাশের পরপরই তার নাম বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সবচেয়ে প্রশংসিত এবং আলোড়িত উপন্যাস ‘দ্য ফ্যামিসড রোড’ এবং ওই উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৯১ সালে ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কার অজর্ন করেন। তার প্রথম গল্প সংকলন ‘ইন্সিডেন্টস অ্যাট দ্য শ্রাইন’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তার অন্য দুটি গল্পগ্রন্থ, তা হলো- ‘স্টাসর্ অব দ্য নিউ ক্যাফুর্্য’ (১৯৮৮) এবং ‘টেইলস অব ফ্রিডম’ (২০০৭)। ‘অ্যান আফ্রিকান এলইজি’ (১৯৯৭), ‘মেন্টাল ফাইট’ (১৯৯৯) এবং ‘ওয়াইল্ড’ (২০১২) তার কবিতার বই। তার অনেক উপন্যাস এবং ছোট গল্প বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।

ইংরেজিতে লেখা তার ‘দ্য মেসেজ’ ছোট গল্পটি অনুবাদ করা হয়েছে। এটি তার ‘টেইলস অব ফ্রিডম’ গল্পসংকলন থেকে নেয়া হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<8212 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1