শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাউল মানস ও বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মনোরাজ্য

জহির আহমেদ
  ১৭ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

নদীমাতৃক বাংলা চিরকালই গানের দেশ- প্রাণের দেশ। বাংলার মানুষ সংগীতপ্রিয়। আর এদেশের মানুষের সবচেয়ে প্রিয় বাংলার লোক ও বাউল গান। যুগ যুগ ধরে বাউল সাধকদের অসংখ্য অমূল্য সংগীত বাঙালির মনোজগতের অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। হাজার হাজার গান কিংবদন্তির মতো বাঙালির মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-তিতাসের তীরে-তীরে একতারা হাতে দরদি বাউলরা গানে-গানে তাদের মনের মানুষ-প্রাণের মানুষ খুঁজে বেড়ায়। যেমনÑ ফকির লালন সঁাই বলেন ...

‘কী সন্ধানে যাই সেখানে,

মনের মানুষ যেখানে।

অঁাধার ঘরে জ্বলছে বাতি,

দিবা রাতি নাই সেখানে।

যেতে পথে কাম নদীতে

পাড়ি দিতে ত্রিবিনে ...

আমি মণি হারা ফণির মতো

হারা হইলাম পিতৃধনে।’

আজীবন তারা সুরে-সুরে মানুষের ভেতরে যে মানুষ, আবার সেই মানুষের ভেতরে যে সঁাই, তারই সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। মনের মানুষের ভালোবাসায় তারা প্রভুর প্রেমের আস্বাদ অনুভব করে।

***

অনাদি অনন্ত অসীম প্রেমময় মহাপ্রভুর পরমাত্মা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে মানবাত্মা। তাই বলা যায়, সমগ্র মানব সমাজ আসলে পরস্পর আত্মার আত্মীয়।

কবি বলেছেন,

‘জগৎজুড়িয়া এক জাতি আছে

সে জাতির নাম মানুষ জাতি;

এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত

একই রবি শশী মোদের সাথী।’

মানুষের মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে স্রষ্টার রহস্য। মানুষের দ্বারাই বিশ্বজাহান পরিচালিত হচ্ছে। তাই মানুষকে অবহেলা করে স্রষ্টার উপাসনার কোনো সুযোগ নেই।

বাউল কবি জালাল উদ্দিন খঁা বলেছেন,

‘মানুষ থুইয়া খোদা ভজ,

এই মন্ত্রনা কে দিয়াছে?

মানুষ ভজ, কোরআন খুঁজ,

পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে।’

***

বাউলেরা মানুষে মানুষে ধমর্, গোত্র, বণর্ কোনো রকম ভেদাভেদই স্বীকার করে না। তারা একটি প্রেমময় অখÐ মানব সমাজের স্বপ্ন দেখে। বাউল সম্রাট লালন সঁাই তাই তার এক গানে বলেছেন:

‘এমন মানব সমাজ কবেগো সৃজন হবে!

যেদিন হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ খিষ্টান জাতিগোত্র নাহি রবে।’

বাউলরা মানুষকে ভালোবেসেই স্রষ্টার প্রেমের মাহাত্ম প্রচার করে। বাঙালি সমাজে মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ ও ভেদাভেদ মুক্তির প্রচেষ্টায় বাউলদের ভ‚মিকা খুবই গুরুত্বপূণর্। যুগে-যুগে তারা এদেশে মানবপ্রেমের বাণী শুনিয়ে বাঙালিদের মন এত প্রেমময়-সংগীতময় করে তুলেছেন।

***

যে মানুষ নিজেকে চেনার কাজে ব্যস্ত, অন্যের দোষত্রæটি খেঁাজার তার কোনো আগ্রহ থাকে না। বাউলরা জানে, নিজেকে চিনতে পারলেই প্রভুকে চিনা যায়। প্রকৃত সত্য জানতে পারলেই মানুষ বুঝতে পারে- আমি-তুমি-সে সবার মাঝেই এক অবিনশ্বর সত্তা বিরাজমান। এই প্রকৃত তত্ত¡ জানা মানুষ মানুষে-মানুষে আর কোনো ভেদাভেদ মানে না।

স্রষ্টা ও সৃষ্টিতত্ত¡ জানার জন্য গুরুমুখী আধ্যাত্মিক শিক্ষা দরকার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যেমন শিক্ষাগুরু, আধ্যাত্মিক শিক্ষায়ও তেমন দীক্ষাগুরুর দরকার।

কিন্তু ভেতরের অহংকাররূপ শয়তান মানুষকে সব সময় দম্ভের বেড়াজালে আবদ্ধ করে রাখে। অহমিকারূপ এই শয়তান মানুষের পীর বা গুরুর পথে বাধা হয়ে দঁাড়িয়ে থাকে। এই শয়তানকে পরাজিত করতে পারলেই গুরুর রাজ্যে প্রবেশ করা সম্ভব। তখন সত্যগুরু বা কামেল মুশিের্দর নিকট দীক্ষিত হয়ে গুরুর নিদেির্শত পথে কমের্ নিষ্ঠাবান হলেই সাধনায় সফলতা আসে। লালন বলেছেন,

‘ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার,

সবর্ সাধন সিদ্ধ হয় তার।’

***

মানুষ গুরুর নিকট দীক্ষিত হয়েই বাউলদের প্রকৃত আধ্যাত্মিক জীবন শুরু হয়। গুরুর বাতলে দেয়া পথে তখন শুরু হয় তার নিজেকে চেনার সংগ্রাম। নিজেকে চিনতে গিয়ে তখন স্রষ্টাকেও খুঁজে বেড়ায় সে। লালন সঁাই যেমন বলেছেন,

‘খুঁজি তারে আসমান জমিন,

আমারে চিনি না আমি,

এ কী ভীষণ ভুলের ভ্রমি!

আমি কোন জন আর সে কোন জনা।

কে কথা কয় রে, দেখা দেয় না।’

জীবনভর পরম প্রভুর সন্ধানে থেকে মানুষে মানুষে জাত-বিভাজন তারা ভুলে যায়। তাই ধমর্বণর্ নিবিের্শষে মানুষের প্রতি তাদের অন্তরে সৃষ্টি হয় অফুরান ভালোবাসা। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি বাউলদের প্রশংসা করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউল গান সম্পকের্ বলেছেন,

‘এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে, কোরআন পুরাণে ঝগড়া বাধেনি।’

তিনি আরেক জায়গায় বলেছেন,

‘আমি বাউলর দলে।’

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার এক গানে বলেছেন,

‘আমি এক ক্ষ্যাপা বাউল, আমার দেউল আমারই এই আপন দেহ।’

***

ওদিকে ভেদবুদ্ধির কণ্টকে আর কুটিলতায় আবদ্ধ মানুষরা মতভেদ কিন্তু সৃষ্টি করেই চলছে। এসব মানুষ পাথির্ব হিসেবে যতই বিদ্বান, ক্ষমতাবান বা প্রদশর্মান পরহেজগারই হোক না কেন, তারা বিশ্ব মানবের প্রিয় হতে পারে না। বরং তারা ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন স¤প্রদায় বিশেষের কাছেই গুরুত্বপূণর্। যা কিছুই হোক, এসব সা¤প্রদায়িক মানুষের সরলতা ও মানবতাবোধ থাকে না। তারা মানুষের প্রতি অহঙ্কার ও বিদ্বেষ পোষণ করে। তাই সৃষ্টিকতার্ও তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যান। স্রষ্টার প্রিয় সৃষ্টিজীবের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ সীমাবদ্ধ সা¤প্রদায়িক মানুষ কখনো অসীম দয়ালু ও পরম অসাম্প্র্রদায়িক আল্লাহর কাছে প্রিয় হতে পারে না।

***

মানুষ সামাজিক জীব। নিঃসঙ্গতা মানুষের কাম্য নয়। ধমর্-বণর্-জাতি-বংশ নিবিের্শষে মানুষের জন্য মানুষের প্রাণ টানে। মানুষের প্রতি মানুষের এই টান বা ভালোবাসা মানুষের সহজাত স্বভাব। এই স্বভাব বা প্রকৃতিকে ইসলাম ধমের্ বলে ‘ফিতরাত’। ইসলামকে ফিতরাতের ধমর্ও বলা হয়। এই ফিতরাতের ধমর্ই সত্য ধমর্ বা মানব ধমর্। ফিতরাত বা স্বভাব সরল পথে রাখার জন্যই মানুষের যত উপাসনা-ইবাদত। মানুষের স্বভাবের পথই হলো সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ। মানব ধমের্ বিশ্বাসী মানুষগণ মানবিককায় ভরপুর থাকে। তাদের হৃদয়ে থাকে মানুষের জন্য অগাধ ও অবাধ ভালোবাসা। ভালোবাসায় পরিপূণর্ মানুষের অন্তরই পরম শান্তিময় আল্লাহর আরশ বা সিংহাসন।

যার নিজের মধ্যে শান্তি নেই, সে যতই বেশধারী কিংবা আচারনিষ্ঠ হোক না কেন, আসলে তার ধমর্ও নেই। বতর্মান বিশ্বে ধমীর্য় বেশভ‚ষা ও আচার-অনুষ্ঠানের অভাব না থাকলেও প্রকৃত ধমর্কমর্ ও ধামিের্কর খুব অভাব।

***

পৃথিবীতে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ইত্যাদি নামে যেসব ধমর্ বতর্মানে প্রচলিত আছে, তার প্রায় প্রতিটিই সত্য-শান্তির বাণী প্রচারের জন্য স্রষ্টা কতৃর্ক প্রেরিত। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ¯্রষ্টা প্রেরিত সেসব সত্য ধমের্র মমর্ না বুঝে মানুষ না হয়ে হয়ে যায় সা¤প্রদায়িক মুসলমান, সা¤প্রদায়িক হিন্দু, সা¤প্রদায়িক বৌদ্ধ কিংবা সা¤প্রদায়িক খ্রিষ্টান। এই অপূণর্ মানুষেরাই ধমের্র নামে পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাচ্ছে সা¤প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। অথচ, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ঠ, আর মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ অন্যদিকে সা¤প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে মানুষের মুক্তির জন্য মহামানবেরা চিরকালই সচেষ্ট।

বাউলরা সাবর্জনীন মানব ধমের্ বিশ্বাসী। তারা প্রকৃত অসাম্প্র্রদায়িক চেতনার মানুষ। আমরা যদি সকল প্রকার অহংকার ও হিংসা ত্যাগ করে মানবতার আদশর্ অনুসরণ করতাম, তাহলে আমাদের পৃথিবীর রূপটি কতই না সুন্দর হতো! ধমর্ ও অথের্র জন্যই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অধমর্ ও অনথর্ সৃষ্টি হচ্ছে। বাউলরা অহঙ্কার ও বিদ্বেষপূণর্ জাতিধমের্র ঊধ্বের্ থেকে গানেগানে মানবপ্রেমের বাণী শোনায়। তাদের মানব প্রেমের মধ্যেই স্রষ্টা প্রেম নিহিত থাকে। বাউলরা বিশ্বের অসা¤প্রদায়িক ও মানবতাবাদী মানুষদের শ্রেষ্ঠ। উল্লেখ্য যে, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় বাংলার বাউলদের নিয়ে চচার্ হচ্ছে। উল্লেখ্য যে, ইংল্যান্ডের অক্সফোডর্ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলার বাউল শ্রেষ্ঠ লালনের জীবন ও সংগীতের ওপর ইংরেজিতে গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে।

***

দেহতাত্তি¡ক সাধনায় বাউলরা রূপের মাঝে তার অরূপরতনকে খুঁজে বেড়ায়। তারা ত্যাগের সাধনায় শান্তমতি অজর্ন করে। কয়েক বছর আগেই জাতিসংঘ কতৃর্ক তারা শান্তিপ্রিয় মানব স¤প্রদায় হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। বাউলরা গানে-গানে প্রেম ও শান্তির বাণী শোনায়। মহষির্ মনমোহন দত্ত তার এক গানে বলেন ...

‘কও দেখি মন আমার কাছে, তুমি হিন্দু মুসলমান।

আল্লা না হরি তোর ঠাকুর বটেরে,

তুই কে, তোর মনিব করে, করবে ইনসান।

আমি তুমি যত কায়া আছে,

কে বিরাজে বল এসব কায়ার মাঝে,

প্রাণে প্রাণে টানে টানে জাত বিচার নাই

দেখি প্রমাণ।’

***

বাউলরা সাম্প্রদায়িক মুসলমান নয়, হিন্দু নয়, বৌদ্ধ নয়, খ্রিষ্টান নয়, তারা বিশ্বমানব- ইনসান। জাতি ধমের্র যে বিভেদ হিংসাবিদ্বেষ সৃষ্টি করে, মানুষে-মানুষে সেই জাত-বিভাজনে তারা মমার্হত হয়। তারা সব মানুষকে ভালোবাসে।

বাউলরা বিশ্বাস করে, মানুষের মাঝে গোপনে বিরাজ করেন এক অধরা মানুষ। সেই মানুষই তার মনের মানুষ, তার আত্মার আত্মীয়। সেই অপরূপ মনের মানুষের ভেতরেই আছেন তার পরমেশ্বর। তিনিই আবার অচিন পাখিরূপে মানুষের দেহ-খঁাচার ভেতর আসা-যাওয়া করেন। কোরআন শরীফে আছে, ‘আমি মানুষকে আমার প্রতিরূপে সৃষ্টি করেছি।’ আল্লাহর সেই রূপ কখনো কখনো কোন কোন মানুষের কাছে অপরূপ রূপে দেখা দেয়, আবার হারিয়ে যায়। এ হলো আশেক-মাশুক বা প্রেমিক-প্রেমাস্পদের খেলা। ভক্তের সাথে তিনি প্রেমের লুকোচুরি খেলেন। তাই পরমকে পাওয়ার জন্য বাউলরা আকুল হয়ে থাকে। মাশুকের জন্য আশেক দেওয়ানা হয়ে যায়।

মানুষই তাদের সাধনা, মানুষই তাদের আরাধনা। সেই মানুষের জন্যই বাউলরা জাতকুলমান, লোকলজ্জাকে বিসজর্ন দিয়ে দেয়। বাউলরা মনের মানুষের রূপেই পরমের দশর্ন খুঁজে। তাই মনের মানুষের বিচ্ছেদহীন সাক্ষাত বা মিলনের আশায় লালন সঁাই বলেন-

‘মিলন হবে কত দিনে,

আমার মনের মানুষের সনে। ...

ঐরূপ যখন স্মরণ হয়

থাকে না লোকলজ্জার ভয়

লালন ফকির ভেবে বলে সদাই

ও প্রেম যে করে সে জানে।’

***

জগতের জেলখানায় বন্দি হয়ে হঁাসফঁাস করা প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, ‘আমি আসলে কে?’ ‘আমি কোথায় ছিলাম?’ ‘কোথায় এসেছি?’ ‘যারা আসে, তারা সবাই চলে যাচ্ছে। আমিও একদিন চলে যাব। কোথায় যাব? সেখানে কীভাবে থাকব?’ ভাবুক মানুষের মনে এসব প্রশ্ন জাগে। বাউলরা আত্ম-অনুসন্ধানের পথে এগোতে থাকেন। হাদিসে কুদশিতে আছে, ‘মান আরাফা নাফছাহু, ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু’। যে নিজেকে চিনতে পেরেছে, সে তার প্রভুকে চিনতে পেরেছে। তবে ‘আমি’কে চিনার জন্য একজন ‘তুমি’ বা মাশুকের প্রয়োজন। বাউলরা নিজেকে চিনার রাস্তা সহজ করতে একজন মানুষগুরু বা সত্যপীরের কাছে মানবিক ত্রæটিবিচ্যুতি বা অহমিকাকে সমপর্ণ করে দেয়। তারা পীরের শরণ নেয় ও তাকে অনুসরণ করে।

যারা আত্মজ্ঞানী তারাই সত্যপীর বা সদগুরু। তাই আত্মজ্ঞানীকে অনুসরণ করলেই নিজেকে চেনা সম্ভব। আত্মঅনুসন্ধানী লালন একদিন মানুষগুরু সিরাজ সঁাইয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে নিজেকে চিনা তথা প্রভুকে চেনার পথ খুঁজে নিয়েছিলেন। লালন সঁাই আরেকটি গানে বলেছেন,

‘...বহু তকের্ দিন বয়ে যায়,

বিশ্বাসে ধন নিকটে পায়।

সিরাজ সঁাই ডেকে, বলে লালনকে,

কুতকের্র দোকান খুলিসনে আর।

মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার,

সবর্ সাধন সিদ্ধ হয় তার।’

***

আমরা আত্মকেন্দ্রিক মানুষেরা সত্যকে ধারণ করি নাÑ ধমের্র বুলি আওড়াই মাত্র। আমরা মানুষকে ভালোবাসি না, ঘৃণা করি। আমরা অসহায় পাপীতাপীকে দয়া করি না, গরিমা ও অহঙ্কারে দূরে ঢেলে দেই। কিন্তু লালন-হাছন-মনোমোহন-জালাল-করিম-রাধারমণরা তা করেন না। তারা আত্মতত্ত¡ জ্ঞানী ও দরদী-প্রাণ, তারা মানুষকে ভালোবাসেন। তাই যুগে-যুগে তারাই সব ধমের্র মানুষের প্রিয় ও অনুসরণীয়।

সবাই ভালোবাসা পেতে চায়। ভক্তি ও ভালোবাসা পেলে সবাই খুশি হয়। আমাদের প্রিয় সন্তানকে কেউ ভালোবাসলে আমরা যেমন খুশি হই, তেমনি আল্লাহর প্রিয় বান্দাকে কেউ ভালোবাসলেও আল্লাহ খুশি হবেন, এটাই স্বাভাবিক। যে আল্লাহর প্রিয় বান্দাকে ভালোবাসেন, আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন। দয়ালু, হৃদয়বান ও মানবতাবাদী মানুষই আল্লাহর প্রিয়। তাই মানুষের প্রতি মানুষের যে বিশ্বাস-ভক্তি-ভালোবাসা তা আল্লাহই পেয়ে থাকেন। লালন, হাসন, মনোমোহন, জালাল, করিম, বিজয় রাধারমণরা তাদের মানুষগুরুর কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ও তাদের ভালোবেসে সে প্রমাণ রেখে গেছেন।

***

গুরু-শিষ্য, শরীয়ত-মারেফত, হিন্দু-মুসলমান, আধুনিককালেও বাউলদের জনপ্রিয় পালাগান এগুলোই। বিশেষ করে বিভিন্ন মাজারকেন্দ্রিক গ্রামে-গঞ্জে সারারাতব্যাপী বাউলদের পালাগানের যে আসরগুলো হয়, সেগুলো শুনলে বুঝা যায়, তারা আজও তাদের ঐতিহ্যগত অসাম্প্রদায়িকতাকে ধরে রেখেছে।

ধমের্র নামে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ফিতরাত থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাদের বিভিন্ন মতবাদ ও ফেরকার কারণে তারা নিজেদের বিরুদ্ধে সব সময় বিষোদ্গার করেই যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল এই গোষ্ঠী সুযোগ পেলেই স্রষ্টার প্রতি অবিশ্বাসী মানুষের ওপর গুপ্ত হামলা করে তাদের নিহত করছে। তাদের রিরংসা থেকে বাদ যাচ্ছে না অসা¤প্রদায়িক চেতনা লালনকারী ও ¯্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসী মানবপ্রেমিক সুফি-বাউলরাও।

সমকালীন বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী বাউল শাহ আব্দুল করিমের বিখ্যাত গান...

‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।

গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু-মুসলমান

মিলিয়া বাউলা গান আর মুশিির্দ গাইতাম...

মানুষ ছিল সরল, ছিল ধমর্বল,

এখন পাগল সবাই বড়লোক হইতাম।’

আজকাল আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞানের বৈপ্লবিক পরিবতের্নর ফলে মানুষ অনেক কিছু অজর্ন করছে ঠিক, কিন্তু হারিয়ে ফেলেছে মানবিক ফিতরাত বা স্বভাবগুলো। আজ মানুষ বড়ই স্বাথার্ন্ধ। পৃথিবীজুড়ে অথার্ন্ধতা ও ধমার্ন্ধতা আজ জেঁকে বসেছে। আত্মকেন্দ্রিক স্বাথর্পরতা ও সা¤প্রদায়িক ধমার্ন্ধতা মানুষের মানবিক বোধকে দিন দিন বিষাক্ত ও কলুষিত করে দিচ্ছে। এভাবে মানুষ তাদের আগেকার সহজ-সরল সুন্দর দিনগুলো হারিয়ে ফেলছে।

***

বাংলাদেশের গ্রামের হাটে-মাঠে-ঘাটে আজও রাতব্যাপী চলে বাউলদের চমৎকার সব গানের আসর। তত্তে¡-কথায়, ভাবে-বৈচিত্র্যে, প্রেমে-বিচ্ছেদে মাতোয়ারা থাকে সে গানের আসরগুলো। রাতভর চলে তাদের আধ্যাত্মিক, মারফতি, মুশিির্দ, বিচার ও বিচ্ছেদি গান। হাজারো দশর্কশ্রোতার মন জয় করে বাউলরা রাতব্যাপী তাদের গানের মাধুরী ছড়িয়ে যায়। এক স্বগীর্য় মহিমায় সেই সাধক বাউল শিল্পীরা সারারাত অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে বলিয়ান থাকে। ক্লান্তি তাদের স্পশর্ করতে পারে না। রাতের আকাশ থেকে স্বগীর্য় দূতেরা এসে যেন তাদের ক্লান্তি দূর করে দিয়ে যায়। সৃষ্টি হয় এক মানবতাবাদী অপাথির্ব পরিবেশ! একই মঞ্চে চলে নবী-রাসুল-আউলিয়া, আবার স্বরসতি-মহষির্-মহাপুরুষদের বন্দনা। সুর ও গানের মূছর্নায় আর কথা সারারাত মুগ্ধ হয়ে থাকে দশর্কশ্রোতারা। তীথের্র কাকের মতো আরও কীসের আশায় যেন আকুল হয়ে চেয়ে থাকে তারা। রাত্রি যত গভীর হতে থাকে, অনিবর্চনীয় এক বেদনাময় আনন্দের জোয়ার বইতে থাকে সে আসরে। মানুষের জাগতিক বন্ধনগুলো যেন আস্তে আস্তে খুলে যেতে থাকে। শিল্পীরাও চলে যায় ভিন্ন এক জগতে। গানে আসে মায়ের প্রসঙ্গ, আসে বাবার প্রসঙ্গ। মাতৃভক্তি-পিতৃভক্তিতে শিল্পী-শ্রোতার অঝোরে অশ্রæ ঝরে। পীর বা মুশিের্দর রূপে আসে প্রেমাস্পদ বা প্রভুর প্রসঙ্গ। গুরু বা মুশির্দকে আপন করে পাওয়ার আশায় তারা বিরহে কাতর হয়। মুশিের্দর মাধ্যমেই তারা আল্লাহ বা ঈশ্বরকে পেতে চায়। আবদুল আলিমের গাওয়া এই জনপ্রিয় বাউল গানটি এমন কথাই আমাদের শোনাচ্ছে ...

‘কেহই করে বেচাকেনা, কেহই কান্দে,

রাস্তায় পড়ে ধরবি যদি তারে,

চল মুশিের্দর বাজারে।’

***

হাজার বছরের আবহমান বাংলা। একদিকে সবুজ ফসলের মাঠে উদাসী বাতাস, টলমলে নদীর টলটলে জলে শীতল করা প্রাণ, সুনীল আকাশের উদারতা আর বঙ্গোপসাগরের বিশালতায় বাঙালির পবিত্র দেহভ‚মি গঠিত। অন্যদিকে বাউল-ফকির, মহষির্-সন্ন্যাসীদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দরদিয়া ও প্রেমময় যার মনোরাজ্য, এমন কোমলপ্রাণ বাঙালির দেশে চ‚ড়ান্তভাবে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের উত্থানের কোনো আশঙ্কাই নেই। কারণ আমরা প্রাথর্না করতে জানি। অনেক বছর আগে রেডিওতে একটি গান শুনতাম, সেই গানটি স্মরণ করেই আজকের লেখার সমাপ্তি টানছি ...

‘এই অলি আল্লাহর বাংলাদেশ,

শহিদ-গাজীর বাংলাদেশ,

রহম কর আল্লা, রহম কর আল্লা।’...

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<8203 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1