বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কান্তিসাহার শেষ অধ্যায়

মাসুম বিলস্নাহ
  ১৫ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, 'পাঠকরা মনে করেন আমি যা লিখি তা সবই আমার জীবনের ঘটনা।' অল্পবয়সে যখন শরৎবাবুর উপন্যাসগুলো গোগ্রাসে গিলেছিলাম তখন আমারও মনে হয়েছিল সবই বুঝি লেখকের কাহিনি। হা হা।

আরেক লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'উপনিবেশ' প্রকাশের পর জনৈক পাঠকের চিঠির জবাবে তিনি বলেছিলেন- 'আমি গল্পই লিখিয়াছি সুতরাং কাহিনির সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন অবান্তর তবে উপাদান এবং পারিপার্শ্বিক বাস্তব অভিজ্ঞতা হইতে গ্রহণ করিয়াছি।'

আমারও মনে হয়- লেখক সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে গল্প লেখেন। আমাকেও এরকম প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে- ভাই, গল্পটা কি সত্যি? আবার, আসলেই কি এটা গল্প নাকি বাস্তব? কেউ কেউ তো সরাসরি বলে, ঘটনাটা নিশ্চয়ই আপনার!

পাঠকের এই যে প্রশ্ন, কল্পনা, গল্প নিয়ে সত্য-মিথ্যা, বাস্তব-অবাস্তব চিন্তা করা এসবই লেখকের জন্য আনন্দের, ভালোলাগার বিষয়! আমারও ভালো লাগে। তখন মনে হয়, আমার লেখাগুলো তবে একটু হলেও 'লেখা' হয়ে উঠেছে!

শরৎবাবু, নারায়ণ বাবুদের কপাল ভালো ছিল, তারা পাঠকের চিঠি পেয়েছেন, তারা সে-ই চিঠির উত্তরও দিতে পেরেছিলেন। বর্তমান যুগে সে-সুযোগ কই? লেখককে কেউ চিঠি লেখে না! অথচ লেখক মনে মনে অপেক্ষা করে- যদি আজ বিকালে ডাকপিয়ন সাইকেলের বেল বাজিয়ে বলে, বাড়িতে কেউ আছেন? চিঠি আছে, চিঠি...'

আমাদের চিঠিভাগ্য নেই। এক বছর আগে অর্থাৎ ফেব্রম্নয়ারির মাঝামাঝি সময়, সঠিক তারিখটা এখন মনে নেই, ডায়রি দেখে বলা যায়, কিন্তু এই রাতে খোঁজাখুঁজির হঁ্যাপায় যেতে ইচ্ছে করছে না; বরং সেদিনের সন্ধ্যার ঘটনাটা বলি: আমার জিগরি বন্ধু বাদশা এবং আরও দুজন ঠাঁটারীবাজার স্টার হোটেলে বসে জম্পেস খানাপিনা আর ধুন্ধুমার আড্ডা দিচ্ছিলাম। সে সময় আরও একজন আমাদের টেবিলে এসে বসল। নাম বলেছিল 'বুলু', আগে-পরে কিছু নেই। সে বাদশার কানে ফিসফিস করে আমার পরিচয় জানতে চাইলে বাদশা গমগমে কণ্ঠে বলে, আরে মিয়া তুমি আমার লেখক দোস্‌ রে চিনবার পারো নাই...!

বাদশার কথায় লজ্জার মধ্যে পড়ে যাই আমি। এরপর যে ঘটনা ঘটল তার জন্যও প্রস্তুত ছিলাম না, বুলু উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে আমার হাত ধরে বলল, আরে আরে দেখছোনি কারবার, আপনেরে চিনিবার পারছি...আপনার বই কিনছি আগের বইমেলায়...বই ত পড়া শ্যায়! তয় হালায় একটা কাহানি পুরাই আমার কাহানির লগে খাপেখাপে মিইলস্না গ্যাছে গা! তয় মাগার আপনে আমার কাহানি কেমতে জানলেন কন তো?

বিস্ময়ের ঘোরে পড়ে গেলাম, দ্রম্নত সামলে পাল্টা প্রশ্ন করি- কান গল্পটা বলুন তো? বুলুকে এবার বিপদে ফেললাম বোধহয়, মাথা চুলকাচ্ছে, দুই পাশে মাথা দুলিয়ে বলল, ওই যে হালায় রাইতে বউ ঘুমাই যায়গা...ঘুমাইয়া যায়গা... বুঝছেননি?

বুলুর কথায় আমার হাসি চাপল বটে, কিন্তু হাসা ঠিক হবে না বলে হাসি চেপে গিয়ে বলি, হুম, বুঝতে পেরেছি-গল্পের নাম 'ঘুমবউ'!

বুলু আবার দ্রম্নত মাথা দুলিয়ে বলল, হ হ এই নামই হইবো। অহন কন, এ কাহানি কেমতে পারইলেন? আপনারে বাদশা কয় নায় তো?

দ্রম্নত বললাম, বুলু ভাই, গল্পটা পুরোপুরি আপনার কিনা জানি না। পুরোটা কল্পনা করে বানিয়ে বানিয়ে লিখেছি, আমাদের কাজই নতুন নতুন কাহিনি সৃষ্টি করা। এখনো যা ঘটেনি তা ঘটানো। এই পর্যন্ত বলে বুলুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি চাইলাম, আমার মনে হলো- বুলু কিছুই বোঝেনি, মোটেও খুশি হয়নি; তার মুখ দেখে তাই মনে হলো। বিরসমুখে সে বলল, আপনেরা কবি-লেখক মানুষ, আপনাগো কথার পঁ্যাচপোচ কেমতে বুঝুম, কন!

সেদিন স্টার থেকে বেরিয়ে বুলু আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে করুণস্বরে আপন মানুষের মতো বলেছিল, 'হাছা কইতাছি লেখকভাই, কাহানি পুরাই আমার কাহানি, বিশ্বাস যান! আমার বউও রাইতে খালি ঘুমায় আর ঘুমায়...। আপনেরে কইতে শরম নাই, কি করুম কন, শ্যাষে একদিন জিদ কইরা হোটেলে গেছিলাম...!'

আলোচনা অন্দরমহলের আরও গভীরে ঢুকে পড়ছে দেখে বুলুকে থামিয়ে দিয়ে বলি, 'ভাই, চিনা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আজ আমার একটু তাড়া আছে, আরেকদিন আলাপ হবে।'

আমার আরেকজন বন্ধুপাঠক আছে- সোবাহান বাপ্পী। গল্প পড়ে আমাকে বলেছে, 'ভাই, গল্পটার দ্বিতীয় পার্ট লেখা যায় না?'

এরপর অনেকদিন বুলুর কথা ভেবেছি, বাপ্পীর কথা রাখতে গল্পটার শেষ থেকে লেখার কথা ভেবেছি, কিন্তু কোনো ঘটনা বানাতে পারিনি। ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়েছি কটা দিন। তা ছাড়া কোনো গল্পের দ্বিতীয় পার্ট লেখা যায় কিনা বা নিয়ম আছে কিনা তাও জানি না!

শেষমেশ মাথার ভেতর একটা খসড়া টেনেটুনে দাঁড় করিয়েছি! 'ঘুমবউ' গল্পে আমাদের শ্রীমান কান্তিসাহার মনে দুঃখের অন্ত নেই। নেই কোনো পরিত্রাণ।

স্ত্রীর ওপর তার বেজায় রাগ। স্ত্রী হেনা ঘরকন্নায় নিপুণা। শুধু কান্তির বিশেষবেলায় বেখেয়ালি। সারাদিন ফসলের জমিতে খাটাখাটনি করে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে তখন হেনাকে সে তার মতো করে কাছে পায় না। এবেলা না-ই পেল, কিন্তু রাতের বেলা? তখন তো আরও বিপদ হয় কান্তির। সন্ধ্যার পর থেকেই হেনার চোখ পিটপিট করে, চোখের পাতায় ক্লান্তির ছাপ। চোখ লাল হয়ে আসে। তারপর টুপ করে ঘুমিয়ে পড়ে। কতবার সে তার ব্যাপারটা হেনাকে বুঝিয়ে বলেছে, কিন্তু লাভ হয়নি কোনো। প্রতিবার হেনা অপরাধীর ভঙ্গিতে নিজের ভুলটা স্বীকার করে এবং এমনটি আর হবে না বলেও কথা দেয়! কিন্তু প্রতিবারই এমন হয়। কান্তিকে রেখে হেনা ঘুমিয়ে যায়। বিছানায় ছটফট করে কান্তি। শরীরের ভেতরের বাঘটাও পাগল হয়ে ওঠে। খাঁচার ভেতর ঘুরপাক খেতে খেতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে!

কান্তির ইচ্ছে করে দূরে কোথাও চলে যেতে। একদিন সকালে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল আর ফিরেছিল যখন রাত গভীর। সারাদিন সে পীযূষ চক্রবর্তীদের পুকুরের পেছনের বড় জামগাছের গোড়া বসেছিল দুপুর পর্যন্ত। এরপর বৃষ্টি নামল। তার আলুথালু অবস্থা। জমির আলপথ ধরে ঠিকানাহীন হেঁটে গেল। ছেলেবেলার মতো ফড়িং ধরতে গেল, কিন্তু পারল না। ফিঙে পাখি দেখে সে 'পাখি' হতে চাইল-'কান্তি পাখি হলি ভালো হতো'! তারপর সন্ধ্যা নামে দিগন্তে। ঘুম নামে চোখে। যখন ঘুম ভাঙে তখন চারপাশে নিকষকালো আঁধার। কান্তি শ্রান্তপায়ে ঘরে ফিরলে হেনা কথা দিয়েছিল-'আর অমন হবে না, কথা দিচ্ছি'! কিন্তু সে-রাতেই হেনা তার কথা রাখতে পারেনি- সে বিছানায় এসে দেখে হেনা ঘুমিয়ে পড়েছে! তারপর সে মরা মাছের মতো ঘুমন্ত স্ত্রীর দিকে চেয়ে সে-রাতটা কাটিয়ে দিল।

সকালে ঘুম ভেঙে প্রতিদিনের মতো হেনা কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে-উঠোন ঝাড়ু, গোয়ালঘর ধুয়ে-মুছে সাফ করা, এঁটো থালাবাসন নিয়ে পুকুরঘাটে ছোটা। তারপর রান্নাঘরে ঢুকে গরমভাত আর আলুভর্তা করে কান্তিকে প্রচন্ড দরদ নিয়ে ডাক দেয়- 'কই, শুনতিছো, ভাত খেতে আসো'। কান্তিও প্রতিদিনের মতো চোখ কচলে বলে, মরিচ পুড়িছো? হেনা জিভ কেটে বলে, এই তো এহনি দিচ্ছি, তুমি হাত-মুখ ধুইয়ে আসো।

কান্তি পাটিতে বসে পড়ে- 'ভাত খাইয়ে ধোবানি'।

হেনা নাক-মুখ কুচকিয়ে বলে, 'এ্যা মা ঘেন্না'!

শুকনো মরিচ গরমভাতের পেস্নটে পিষতে পিষতে আড়চোখে একবার হেনাকে দেখে আবার চোখ সরিয়ে নেয়। হেনা বলল, কী দেখতিছো?

-'কিছু না।' কান্তির হেঁয়ালিস্বর।

-আমি জানি তুমি আমার ওপর রাগ কইরে আছো...কিরাম কইরে যে ঘুমায়ে গেলাম!

-ঘুম আসলি তো মানুষ ঘুমাবে-ই।

-এবার কিন্তু দিবানি...

কান্তি হাসার চেষ্টা করেও মুহূর্তে আবার আগের চেহারা নিয়ে ভাতের পেস্নটে হাত ধুয়ে উঠে পড়ল। পেছন থেকে হেনা তাকে ডেকেও ফেরাতে পারেনি।

কান্তি গরু-বাছুর নিয়ে বের হয়। আজ একটু দূরে নিয়ে বাঁধবে। বাড়ির পাশে তেমন ঘাস নেই। প্রতিদিন খেতে খেতে নেই কিছু, ঘাস বড় হতেও সময় লাগে। গরুর দড়ির খুঁটিটা মাটিতে পুঁতে দিতে দিতে সে ভাবে- কান্তিও খুঁটিতে বাঁধা গরু-ছাগলের মতোন। ওদের দড়ি ছিঁড়ে পালানোর সুযোগ নেই, তেমনি কান্তিরও সেই দশা। মেনে নিয়ে, মানিয়ে চলার নামই জীবনধর্ম। যার একটা পা নেই সে কী বসে বসে কাঁদবে? এক পা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও হাঁটবে জীবনসংসারের পথে। সংসারে বিধাতা সবাইকে সবকিছু সমান দেন না, কম-বেশি করেই দেন; কিছু অপূর্ণতার চিহ্ন এঁকে রাখেন চিরকাল। ওই তো পাশের গাঁয়ের হাশেম শেখের সংসারে কোনো ছেলে-পুলে নেই, বুড়ো-বুড়ি দুজন মাত্র। বউ একবার স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলেছিল, হাশেম শেখ রাজি হয়নি, তার এককথা- 'পুরুষ মানুষ বিয়ে একটাই করে'। মানুষটাকে এজন্য বিশেষ সম্মানের চোখে দেখে কান্তি, সে নিজেও মনে করে- 'দুইডে বিয়ে করা শরমের কথা'। এমনিতেও তার সুখের সংসার। জমি-জিরাত, গরু-বাছুর, ধান-চাল কোনো কিছুর অভাব নেই। সংসারে ঝইঝই নেই। গায়ের অন্যসব বউদের মতো স্বামীর কানের কাছে দিন-রাত 'শাড়ি দেও, চুড়ি দেও, নতুন গয়না গড়িয়ে দেও' বলে ঘ্যানঘ্যান করে না। তা ছাড়া তার যত্ন-আত্তিও করে সংসার সামলিয়ে। কান্তি নিজেকে অনেক সুখী ভাবে। নিয়ম করে ভগবানের নাম জপ করে। কান্তির এবেলা হুঁশ ফেরে- সূর্য মাথার ওপর থেকে পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সে বাড়ির পথ ধরে। জোর পায়ে বাড়ির উঠোনে এসে হাঁক দেয়- ও হেনা, আমার গোসলের গামছাডা নিয়ে আসোদিন, ম্যালা দেরি হয়ে গেল...'

রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো হেনা। গামছা আর গায়েমাখা সাবানের কেস স্বামীর হাতে দিয়ে বলে- বেশি দেরি হয়নি, শান্তিমতোন গোসল দিয়ে আসেন- আমার রান্নাও শেষ।

মাথা নেড়ে কান্তি পুকুর ঘাটে আসে। ধুন্দুলের খোসায় সাবান মাখতে মাখতে সে ভাবে- হেনাও যদি তার সঙ্গে গোসল করতে আসত, তারপর সাবান মেখে তার পিঠ ডলে দিত! দৃশ্যটা চোখের সামনে কল্পনা করতে তার জোর হাসি পেল, তারপর বিড়বিড় করে বলল, ছোটবেলায় মা পিঠ ডলে দিত, এরপর হেনাও বিয়ের পর প্রথম প্রথম দিয়েছে...'

গোসল সেরে সোজা রান্নাঘরে ঢুকল কান্তি। বলল, আজকে এখানে বইসে খাই।

হেনা কিছু বলতে গিয়েও বলল না। সে ভাতের পেস্নট এগিয়ে দেয়।

কান্তি তরকারির বাটি থেকে ঝোল ঢেলে ভাত মাখাতে গিয়ে ভাবে- প্রতিদিন নিজে ভাত মাখিয়ে খেতে ইচ্ছে করে না, হেনা যদি ভাত মেখে খাইয়ে দিত! সে স্ত্রীর দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকে। হেনা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, কী হয়েছে?

সে মাথা নেড়ে বলে, কিছু হয়নি। তুমিও ভাত খেয়ে নেও।

-আপনে খেয়ে নেন, আমি গোসল কইরে খাবানি।

-আগেভাগে সব কাজ সাইরে নিলি তো আর দেরি হয় না।

-সংসারে মাইয়ে মানষের কী আর সে জো আছে!

কান্তি আর কথা খুঁজে পায় না। চুপচাপ ভাত খেয়ে নেয়। আজ আর বেরুতে ইচ্ছে করছে না। বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দেয়। এখন যদি হেনা এসে মাথায় বিলি কেটে দিত তাহলে সে আরামসে ঘুম দিতে পারত। না হয় পাশাপাশি দুজনে শুয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ত। তার ভাবনার দুয়ারে টোকা পড়ল, হেনা এসে বলে, শুইয়ে পড়লেন যে!

-আজ ইচ্ছে করতিছে না।

-আচ্ছা, ঘুমান।

-একলা একলা ঘুম আসপে না, তুমিও আসো...'

-পুকুরে যাচ্ছি...'

কান্তি নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলে, তাই তো, তাই তো, তাড়াতাড়ি যাও, বেলা পইড়ে যাচ্ছে...'

হেনা কান্তির মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, আপনে চোখ বন্ধ করেন, আমি আসতেছি...!

কান্তি ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের ভেতর অনেক উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখল। আবার স্বপ্ন ভেঙেও যায়। বাইরে তখন রোদ মরে গিয়ে সূর্যের রং গাঢ় লাল। সন্ধ্যার পূর্বমুহূর্ত। তার মাথা ভার লাগল। দুপুরের ঘুমের এই এক হঁ্যাপা। বিছানায় কয়েক বার শরীরের আড়মোড়া ভাঙল। হেনাকে খুঁজল। দেখতে পেল না। বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দেখে- হেনার পাশের বাড়ির নিতাইয়ের বউয়ের সঙ্গে কথা বলছে, দুজনের হাতে ফুলতোলার নতুন কাপড়। হেনা ফুলতোলার নতুন কাজটা শিখে নিচ্ছে। তাকে দেখে বলল, লম্বা ঘুম হলো, এখন বাইরে হাঁটাহাঁটি কইরে আসলে ভালো লাগবেনে...।

কান্তিরও এমনটি ইচ্ছে, ঘরের ভেতর থাকলে মাথাব্যথা শুরু হবে। তারচেয়ে বরং বাইরে বাতাসে হেঁটে এলে শরীর-মাথা ঠিক হবে।

নিতাইয়ের বউ চলে যেতে হেনা সুইসুতা নিয়ে বসল। কান্তি ফিরেও এলো তাড়াতাড়ি। পাশে এসে বসল। বলে, ফুলটা দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে!

-সেজন্যি তো বউদির কাছে শিখে নিয়েছি।

-চা করতি পারবা এখন?

-আপনে না বললিও এখন চা করতি যাতাম, আপনে বসেন, চা-করে আনতেছি...

সে আবার ঘরের বিছানায় এসে গা এলিয়ে বসে। হেনাও চায়ের কাপ নিয়ে ফিরে এলো। তার হাতে চায়ের কাপ দিয়ে বলে, এই শুনতিছো, আমি রাতে ঘুমায়ে গেলে তুমি আমারে জাগাবা, বুঝিছো?

স্ত্রীর কথায় সে ফিক করে হেসে দেয়। তারপর স্ত্রীর দিকে অপলক চেয়ে বলে, তুমি অনেক সুন্দর দেখতি!

হেনা চোখ পাকায়।

তার ইচ্ছে করে হেনাকে এখন জড়িয়ে ধরতে, সমস্ত রাত জড়িয়ে ধরে থাকতে! ইচ্ছেটাকে চাপা দিয়ে রাতের অপেক্ষা করতে থাকে। মনে মনে অনেক কথা সাজায়, অনেক কিছু ভাবে, ভেবেও রাখে। রাতের খাবার খেয়ে নেয় আগেভাগে, বিছানায়ও এলো দশটার দিকে। কিন্তু তার ভেতরে অপেক্ষা ফুরোয় না- অল্পসময়েই হেনার চোখে ঘুম নামে। কান্তি ভীরু হাতে হেনার গাল স্পর্শ করে, এরপর হেনার নাক, কপাল ছোঁয়; হেনা টের পায় না। ঘুমন্ত মানুষের মুখ দেখলে ডাকাতেরও মায়া লাগে। কান্তি সাহা অনভিজ্ঞের মতো হেনার কপালে তার ঠোঁট ছুঁয়ে আবার দ্রম্নত সরিয়ে আনে। এখন মাঝরাত। কান্তির চোখেও ঘুম নামে।

আবার নতুন একটা দিন আসে পৃথিবীতে। পাখি ডাকে, ফুল ফোটে। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে হেনা প্রাত্যহিক সাংসারিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কান্তি গরু-বাছুর আর ফসলের মাঠের কাদা-মাটিতে মন-প্রাণ ঢেলে দেয়, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে ঘরের বউটির পানে। যখন তার জমিতে নতুন ফসল ফলে তখনও তাতে সে তার বউয়ের সুন্দর মুখটির ছবি দেখতে পায়, কান্তিকে তখন ভীষণ গর্বিত দেখায়।

এভাবে দিন গিয়ে রাত আসে, আর ভোর হয়। বছর যায়, বছর আসে। আমাদের গল্পও ফুরিয়ে আসে।

তবে গল্পের আরেটু লেখা যেতে পারে এভাবে-

এক রাতে হেনার চোখে ঘুম এলো না। কান্তিও মনে মনে অবাক হয়! কান্তি তবু কিছু না-বলে পাশ ফিরে শোয়। হেনা হাত বাড়িয়ে কাছে টানল।

কান্তি পাশ না ফিরে বলল, কিছু কবা?

-হুম।

-বলো, শুনতেছি...।

হেনা কথাটা কান্তির কানের কাছে ফিসফিস করে বলল!

কথাটা শুনে সে শব্দ করে হেসে উঠল। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে পড়ল যেন। হেনা লজ্জা পেয়ে বলে, শয়তানি করবেন না কচ্ছি।

কান্তি শান্তকণ্ঠে বলে, আমার ইচ্ছে করতিছে না।

-আমার ইচ্ছে করতিছে... আসো, কচ্ছি!

-সত্যি কচ্ছি বউ।

-ঢং করতিছো কিন্তু, আসো...'

হেনা অনেক ভাবে চেষ্টা করে গেল, কিন্তু কান্তির কোনো ভাবান্তর হলো না। শেষে হেনা তাজ্জব হয়ে বলে, এমন হলো কীরাম কইরে?

-মানুষ চেষ্টা করলি সব পারে বউ।

-কি বলতিছো তুমি! আমি তো কিছু বুঝতেছি নে!

-তোমার আর কিছু বুঝতি হবে না, রাত ম্যালা হইছে-আসো ঘুমায়ে পড়ি!

-না, আগে কও, তোমার হঠাৎ এরাম হলো কীরাম করে?

-আচ্ছা কচ্ছি... আমি আমার শরীরডারে প্রতিদিন বুঝাইছি... শরীরের এই বাঘরে খাঁচার মইদ্যে বন্দি কইরে রাখছি... একদিন দেখি বাঘটা মইরে গেছে...!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<75493 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1