বিকালে তীরধরা দ্বীপের মায়াবী পরিবেশে দাদু ও নাতির মজাদার আড্ডার মধ্যে হঠাৎ নাতি বলল, দাদু তুমি আজ বহু পুরনো রূপকথার গল্প শোনাও না? বাস্তবতার দিন-কাল ঠেলে।
-নাতি ভাই, তাহলে আমি আমার দাদুর কাছে যে গল্প শুনেছিলাম দর্শনা কেরুর কেন্টিনে বসে চা খেতে খেতে সেই গল্পটিই আজ তোকে বলে শোনাই-।
দিন আনা দিন খাওয়া যার সংসার, ব্যথায় যার কুঠার বসায় বুকে তার নাম বেথু হলে দোষ কী? হাবাগোবা ভ্যানচালক কার্পাসডাঙ্গা বাজারের। পাঁচ বছরের ঘর-সংসারে আজও প্রদীপ জ্বালাতে পারিনি। বউটার সুরোত ভালো। তাই তো বাপু পড়শীর মনটা আলো।
সকালে ঘুম থেকে ওঠামাত্র বাড়িওয়ালা (বউ) ঝোলা ধরে দিল বেথুর হাতে, সঙ্গে দিল পাঁচ টাকা। এই শোন, (কর্কশ কণ্ঠে বলে) পাঁচ টাকার কিছু খেয়ে নেবে? আর বাড়ি আসার সময় অবশ্যই দুই কেজি চাল আর সঙ্গে বাজার থাকে যেন?
কুল আটি ভরা পায়ে ভ্যানচালকের কষ্ট হয় বৈকি। কি আর করা বউ তাড়া দেয়। কার্পাসডাঙ্গা বাজারে এসে বেথু ভাবছে, থাক এ টাকা আর খাবো না, যদি ভাড়া না হয়। ভাবতে ভাবতে এক ফটকাবাজের আবির্ভাব ঘটল। বলে, এই চুয়াডাঙ্গা যাবে? বেথু বলল, যাব মিয়া সাব, ভাড়া কিন্তু ত্রিশ টাকা দেয়া লাগবে। পকেট যার ফাঁকা, তার কি আর হয় চোখ বাঁকা। ভ্যানে চেপে বসে চলল দুজন।
পথিমধ্যে বেথুর প্রশ্ন -মিয়া সাব কী করেন?
\হ-সোজা-সাপ্টা উত্তর-কথা বেঁচে খাই।
\হ-সে আবার কেমন কথা?
\হ-তুমি যদি জানতে চাও প্রতি কথার দাম দশ টাকা লাগবে। শুনবে তুমি?
\হবেথু মনে মনে ভাবল ত্রিশ টাকার মধ্যে দশ টাকা যায় যাক। শুনিই না একটি কথা। ফটকাবাজের প্রথম কথা
\হ-ফেলিসতো দেখে শুনে ফেলিস।
\হকথাটা শুনে বেথু মুখস্থ করতে করতে চুয়াডাঙ্গা পৌঁছে গেল। লোকটি তো খুবই চিন্তিত। বাকি দশ টাকা কীভাবে দেবে। পকেটে তো পুরো ফাঁকা।
\হবেথু আবার বলল, মিয়াসাব ভাড়া আর দিতে হবে না। আর একটি কথা শোনাও না।
\হলোকটি হাসতে হাসতে বলল, বন্ধুদের সঙ্গে মিশে গোপন কথা বলিও না।
\হলোকটি চলে যাওয়ামাত্র বেথুর মাথায় চিন্তার ভার বেড়ে গেল। কীভাবে যে আজকের বাজার হবে। বউ তো আচ্ছা বকুনি দেবে। কথা শুনে তো এ ভাড়া মারা ত্রিশ টাকাও গেল। যাহোক মনের দুঃখে পাঁচ টাকা খেয়ে বড় বাজার ঘুরে-ফিরে আসছে। ভ্যান ঘুরিয়ে চুয়াডাঙ্গার কোর্টের কাছে আসা মাত্রই কিছু লোক থামিয়ে তাকে বলল,
\হ-এই এখানে এক বুড়ি মারা গেছে। দুইশত টাকা সবার কাছ থেকে তোলা হয়েছে তোমাকে দিচ্ছি যেখানে-সেখানে ভাগাড়ে ফেলে চলে যেও?
\হকথামতো ভাবল, দুশো টাকা যদি হয়। এখানে কেউ তো আর আমায় চেনে না, বুড়িকে তুলে নিয়েই যাই। বহু পুরনো লেপ বালিশসহ জড়িয়ে তুলে দিল সবাই মিলে।
পথিমধ্যে নদীর তীরে এসে ভ্যান ভিড়িয়ে বুড়িকে লেপসহ টেনে ফেলে দিল। বুড়ি তো গড়াতে গড়াতে নদীতে গেল। এদিকে ভ্যানের চাকার নাটে গেল বালিশের কোণা ছিঁড়ে আটকে। টানা-হেঁচড়া করতেই কিছু পয়সা গড়িয়ে পড়ল।
\হবেথুর মনে হলো সেই কথা- ফেলিস তো দেখেশুনে ফেলিশ। বেথু বালিশ নাড়াতেই টাকা-পয়সার আলামত বুঝে বালিশটা ভ্যানে রাখল। পড়ে যাওয়া পয়সাগুলো রাখল পকেটে। বুড়ির সারাজীবনের জমানো অর্থবোঝাই বালিশ এখন বেথুর দখলে। ময়লাযুক্ত বালিশ ভ্যানে কেউ সন্ধেহ করবে না, এতে কী আছে। বাড়ি পৌঁছে ঘরের কোণের মাটি দিয়ে তৈরি কোলার ভিতর রাখল সব টাকা-পয়সা।
বেথু এখন প্রতিদিন বউয়ের কথামতো ভালো ভালো বাজার করে। কিন্তু ভ্যানচালক আর ভ্যান ঠেলে না। রূপসী বউয়ের কথায় এনেছে এবার শ্যাম্পু, সুগন্ধি বাসনা তেল আরও অনেক পারফিউম। বউ নদীতে যায় তেল শ্যাম্পু নিয়ে। হঠাৎ এত সব পরিবর্তন দেখে ছিচকে চোরের বউ ভ্যানচালক বেথুর বউকে বলল,
\হ-হ্যারে তোদের তো খুব অভাব ছিল, এসব কীভাবে হলো?
বেথুর বউ বলল, আমার স্বামী আর ভ্যান চালায় না। তবে যা বলি তাই কিনে আনে?
\হ-তোর কথা সব শোনে বুঝি?
\হ-হঁ্যা।
\হজবাব শোনামাত্র চোরের বউটা বলল, তোর গলাটা বড্ড ফাঁকা লাগে, সোনার হার নিতে পারিসনে?
\হরাতে বেথুর কাছে আবদার করে বলল,
\হ-আমার সোনার হার কিনে দিবা কালকে?
\হযেমন কথা তেমন কাজ। পরেরদিন ঘাটে বেথুর বউয়ের গলায় পাঁচ ভরি ওজনের হার দেখে, চোখ উলটিয়ে কপালে গেল ছিচকে চোরের বউটার।
\হপরদিন আবার বলল, তোর কান দুটি বড্ড ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছে, সোনার দুল হলে ভালো হয়।
\হতার পরের দিন আবার দুল কানে ঘাটে স্নান সারতে গেছে।
\হচোরের বউটা আবার বলল, হাত দুটি একদম ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সোনার চুড়ি হলে চোর এই সুন্দর হাতে ভালোই মানায়।
\হকথা মতো পরের দিনই সোনার চুড়ি হাজির।
\হএত সব পরিবর্তন দেখে চোরের বউটা বলল, তোর স্বামী এত টাকা পায় কোথায়? তুই জিজ্ঞাসা করেছিস কোনোদিন? তুই তো বেথুর ঝলমলে টলমলে লক্ষ্ণী বউ। জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারিসনে?
\হএমন মিষ্টি করে বলা কথা শুনে বেথুর বউ বেজায় খুশি হয়ে রাত্রে বেথুকে আদর করতে করতে ঘটনা শুনতে চাইলে বেথু সরল সোজা মনে সব খুলে বলল। মাটির ওই কোলার ভিতর টাকা-পয়সা ভর্তি, সব সাজানে গোছানো।
\হপরদিন বাসনা তেল মাথায় দিতে দিতে চোরের বউ সব ঘটনা শুনে নিল। পরের রাত্রে যা হবার তাই হলো। কোলা সোজা বড় সিঁদ কেটে কোলাসহ সবকিছু চোর চুরি করে নিয়ে চলে গেল। বেথু ঘুম থেকে উঠে বউয়ের কথামতো বাজারের ব্যাগ নিয়ে, পয়সা নিতে গিয়ে দেখতে পেল মাটির কোলাটি নেই। দেয়ালে সিঁদকাটা।
\হ-হায়! হায়! করে বেথু কেঁদে উঠল। বউটাও হাজির। দুজনেই কাঁদতে লাগল। বেথু গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল সেই কথা। গোপন কথা কাউকে বলিসনে। বেথু ঘরের বাতা থেকে নেকড়া টেনে ভ্যান মুছে আবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল চিন্তার কাছে জীবন সঁপে-।
সত্যিই দাদুভাই, গোপন কথা বউকে না জানালে এমন ফল হতো না।
\হ-হঁ্যা নাতি ভাই? আজ ওঠা যাক? তোর মা আবার তোকে খোঁজাখুঁজি করবে?
-চলো দাদুভাই।