বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হৃদয়ে আতশবাজি

সালাম সালেহ উদদীন
  ১১ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

চারদিকের আলো ঝলমল ভাব, মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। আকাশ হঠাৎ মেঘলা হয়ে উঠেছে। ঝড়ও আসতে পারে। তবে চৌধুরীর মনের ঝড়টা বেশি প্রকট। আজ তার হৃদয়ের সজীব অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। উদাস ভঙ্গিতে নিজের ঘরে বসে জানালা দিয়ে গাছ আর নাগরিক-পাখির সম্মিলন দেখছেন তিনি। প্রকৃত অর্থে তিনি নিঃসঙ্গ, বড় একা। বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে।

আজ বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে তার। বন্ধুরা বলেন- 'তোমার বয়স হয়েছে চৌধুরী, তার পরেও বজ্জাতি ছাড়তে পারলা না।' বন্ধুদের কথা শুনে চৌধুরী হাসে, আবেগ-মিশ্রিত পানসে হাসি। এই ধরনের কথা তিনি বহুবার শুনেছেন। অপমানবোধ না থাকার কারণে বেশ মজাই পান তিনি। তিনি তার কাজে দমে কিংবা থেমে যান না। দিন কয়েক আগে অনামিকাকে ফোন করতে গিয়ে স্ত্রী কদরজানকে ফোন করেন। অনামিকাকে তিনি যা বলেন, স্ত্রী ফোনে একই কথা শুনতে পান। 'অনামিকা তুমি আমার জান ভোরের পাখি লক্ষ্ণী-সোনামণি আমার কলিজার টুকরো, তুমি অনেক ভালো। তোমার মতো মেয়ে আমি জীবনেও দেখিনি।' কদরজানের সঙ্গে তার ৫০ বছরের সংসার। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি চৌধুরীর মুখে এমন মধুমিশ্রিত সুরেলা শব্দ শুনতে পাননি। তিনি চৌধুরীকে কিছু না বলে ফোন রেখে দেন। চৌধুরীর বহুদিনের পুরনো বন্ধু বাকের সাবকে ফোন করেন এবং সংলাপটি তাকে শোনান। কে এই অনামিকা তা জানার জন্য বাকের সাবকে তিনি দায়িত্ব দেন। দিন দয়েক পর বাকের সাব জানতে পারেন অনামিকা মধ্যবয়সী এক সুন্দরী, যার প্রেমে চৌধুরী হাবুডুবু খাচ্ছেন। এই খবর নিশ্চিত হওয়ার পর কদরজান চৌধুরীকে নাস্তানাবুদ করেন, বলেন, 'বুইড়া অইছো বাতাসে। তোমার এখন কবরে যাওয়ার সময়। বয়স অইছে ৭০, ভাব দেখাও নায়কের।' কদরজানের কথায় তিনি কোনো উত্তর করেন না। বরং ভেতরে ভেতরে সুখ অনুভব করেন। তিনি ভাবেন গিন্নি অনামিকা নামটি জানলো কী করে।

তার পুরো নাম নজরানা চৌধুরী। তার চোখ দুটো অস্বাভাবিক। ওই চোখ দুটো এই প্রবীণ বয়সেও কেবল নারী খোঁজে। পরিচিতজনরা বলে আপনার চোখই খারাপ। আপনি নারীবিষয়ক বদমাশ। এই ধরনের কথা কিছুদিন আগে কদরজানও বলেছেন। আমরা আড্ডার লোকজন তার কথা শুনে অবাক হই। তাকে বলি, ভাবী ৫০ বছর পর আপনাকে চিনতে পারলো? এতে অবশ্য চৌধুরীর কিছুই আসে-যায় না। তিনি চলেন তার মতো করে। তার সকালের আড্ডার বন্ধু কবির খান কথা বলে খুব মেপে মেপে। নজরানা চৌধুরীর মতো তারও সব বয়সী নারীদের প্রতি গভীর আগ্রহ ও আকর্ষণ রয়েছে। তিনি একদিন আমাকে বললেন, কবি ভাই, চৌধুরী সম্পর্কে আপনি কি কিছু শুনেছেন? আমি বললাম, চৌধুরী তো প্রতি মুহূর্তে একেকটি ঘটনার জন্ম দিচ্ছেন। তিনি তো অপ্রতিরুদ্ধ। তার চরিত্রের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পের চরিত্রের মিল রয়েছে। কোন ঘটনার কথা আপনি বলছেন? খান সাহেব বললেন, ওই যে মিরপুরে যে ঘটনাটি ঘটেছিল। বাসের মধ্যে কোন নারীর শরীর স্পর্শ করেছিলেন তিনি। এরপর ওই এলাকার তরুণরা তাকে একটি ঘরে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করেছিল। অবশেষে আমরা চাঁদা তুলে তাকে ছাড়িয়ে আনি। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল, রিক্তা। রিক্তাই সবার কাছ থেকে টাকা তুলে তাকে ছাড়িয়ে আনে। আমি বললাম, এই ঘটনাটি আমার জানা ছিল না। তবে চৌধুরীর মতো মানুষ এমন ঘটনা ঘটাবে এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। তিনি হচ্ছেন রহস্য-পুরুষ। তাকে চেনা কঠিন। একটি বিষয়ে আপনি লক্ষ্য করেছেন, চৌধুরী নারী ও পুরুষ দুই ধরনের মানুষের সঙ্গে বিপরীতধর্মী আচরণ করেন। পুরুষের প্রতি তার আচরণ খুবই বাজে। কোনো শিক্ষিত ভদ্রলোক এমন ব্যবহার করতে পারেন না। অথচ নারীদের সঙ্গে তার ব্যবহার কী মধুর। মুখ থেকে মধুর নহর বয়ে নদীতে পড়ছে যেন। মনে হয় পৃথিবীর সব নারীই তার প্রেমিকা। তিনি যেভাবে যে ভাষায় কথা বলেন, তা তার বয়সের সঙ্গে খাপ খাওয়া নয়। ক্ষেত্রবিশেষে হাস্যকরও।

'তুমি অনেক সুন্দর, সুন্দর করে কথা বলো। তোমার তাকানোর ভঙ্গিটি আমাকে মুগ্ধ করে। তোমার কথা আমি সবমসয় মনে রাখি, রাখব।' এসব কথা বলে অনায়াসে তিনি মেয়েদের-নারীদের মন জয় করেন।

চৌধুরী দেখতে সুদর্শন, সবচেয়ে বড় আকর্ষণ তার চোখ। চোখ দুটো অস্বাভাবিক। তিনি যেভাবে নারীদের দিকে তাকান, তাতে মনে হয় গিলে খাবেন। পরিচিত হোক কিংবা হোক অপরিচিত, সবার প্রতি তাকানোর ভঙ্গি প্রায় একই। তিনি যখন কোনো নারীর সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন দামি ও আকর্ষণীয় পোশাক পরিধান করেন। এর বেশির ভাগ পোশাকই তার ছোট ছেলের। তার এসব রোশনাই ও ভাষার কারণে নারীরা খুব সহজেই পটে যায়। নারীদের ভাষ্য, চৌধুরীর মতো ভালো মানুষ এ যুগে বিরল। খান সাবের তার সম্পর্কে ধারণা, 'যারা ভদ্রবেশি প্রতারক তারা এভাবেই মানুষকে আকৃষ্ট করে।' চৌধুরীর একটি বড় গুণ হচ্ছে, নারীরা তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করলেও তিনি হেসে কথা বলেন। অন্যদিকে পুরুষরা তাকে কিছু বললে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেন এবং কথা বলেন কর্কশ কণ্ঠে। নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে তার যে দ্বিমুখী আচরণ এটা আমাদের সকালের আড্ডার লোকদের অবাক করে। অতিরিক্ত নারী-প্রীতির কারণে চৌধুরী পেশাগত জীবনে মনোযোগ দিতে পারেননি বা করতে পারেননি উন্নতি লাভ। সারা জীবনে তিনি আট থেকে ১০ বছর চাকরি করেছেন। সিঅ্যান্ডএফের (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্সি) ব্যবসা করেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। তার স্ত্রীর কাছে তিনি দুটো বিষয়ে করুণা, ক্ষেত্র বিশেষে ঘৃণার পাত্র। একটি হচ্ছে অর্থ উপার্জনে অক্ষমতা, অন্যটি নারীবিষয়ক কেলেঙ্কারি। একবার তো আড্ডার মাঠে কদরজান এসে উপস্থিত। তখন তিনি রিক্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে আলাপে ব্যস্ত। ওই যাত্রায় কবির খান তাকে রক্ষা করেছিলেন। বলেছিলেন, রিক্তা তার শ্যালিকা।

\হচৌধুরীর স্ত্রী যদি বাসায় তার বান্ধবীদের দাওয়াত করেন, তা হলে চৌধুরীকে দিয়ে বাজার করানো থেকে শুরু করে সব কাজ করাবেন। মেহমান এলে তাকে বাসার বাইরে থাকতে হবে। কারণ চরিত্রগত কারণে তিনি বান্ধবীদের মাঝে তার উপস্থিতি অনুমোদন করেন না। কদরজানের সন্দেহের মাত্রাটা চৌধুরীকে কেন্দ্র করে এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে, বলতে গেলে সহ্যের সীমা লঙ্ঘন করেছে। যদি কখনো দুজনে প্রাতঃভ্রমণে বের হন, বিপরীত দিক থেকে আসা কোনো মহিলা যদি চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে হাসে কিংবা চৌধুরীকে সালাম দেন তা হলে, কদরজান তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করবেন। 'ওই মহিলা কেন হাসলো, ওই মহিলা কেন সালাম দিল, তোমার সঙ্গে কী সম্পর্ক। সারাদিন এসব করে বেড়াও। বুড়া অইলা কিন্তু ভালা অইলা না। কবরে যাওয়ার সময় অইছে এইডা তোমার খেয়াল নাই।' স্ত্রীর ধারাবাহিক আক্রমণে চৌধুরী কেবল তোতলাতে থাকেন। এসব ঘটনা যখন আমরা চৌধুরীর মুখে শুনি তখন তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে হয়। তার স্বভাবগত কারণেই স্ত্রীর কোনো কথার প্রতিবাদ তিনি করতে পারেন না। নারীবিষয়ক অপরাধের জন্য কতবার যে কদরজানের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছে ইয়ত্তা নেই।

এটা সত্য, চৌধুরীর রসালো ও গুছিয়ে বলা কথার কারণে নারীরা আকৃষ্ট হয়। এটা তার প্রধান অস্ত্রও বলা যেতে পারে। তবে তিনি আড্ডার মধ্যে প্রায়-ই বলেন, কালো মেয়ে তার খুব পছন্দ। তিনি কী কারণে এই কথা বলেন, তা আমরা আর তাকে জিজ্ঞেস করি না। হয়তো এমন হতে পারে, তিনি যৌবনে কোনো কালো মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। মেয়েটি তার জীবন থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। হয়তো তাকে তিনি এখনো ভুলতে পারেননি। সেই স্মৃতি তাকে এখনো বেদনাহত করে। নজরানা চৌধুরী অত্যন্ত নাছোড়বান্দা। অনামিকাকে পেয়ে যেন তিনি আকাশের চাঁদ পেলেন। মাঠের সবার অজান্তে তিনি ওর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুললেন। এর দুটো দিক রয়েছে, অনামিকার সৌন্দর্য অন্যটি অর্থ। তিনি নানা সমস্যা সংকট দেখিয়ে ওর কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছেন। মাঠের কেউ কেউ বলেন, অনামিকা তাকে বাজারও করে দেয়। মাঠে চৌধুরী একবার সবাইকে আপ্যায়ন করেছিলেন, এই টাকা নাকি অনামিকা দিয়েছে। এসব গুজব মাঠের বাতাসে ভেসে বেড়ায়। ভেসে ভেসে আমাদের কানেও আসে। আমরা আপস্নুত ও আমোদিত হই।

এ বিষয়ে আমি অনামিকাকে জিজ্ঞেস করলে ও অস্বীকার করে। অথচ এ নিয়ে মাঠের সবাই বলাবলি করছে। একজন বৃদ্ধের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক, বিষয়টি বেমানানও। একদিন সকালে খবির খান আমাকে বলল, ওরা নাকি রাতের বেলায় দেখা করেছে। দুজনে এক সঙ্গে ফুসকাও খেয়েছে। ওই দিন রাতে চৌধুরী নাকি জামাই সাজে গিয়েছিল অনামিকার সঙ্গে দেখা করতে। সেজে এসেছিল অনামিকাও। খান সাহেবের কথায় আমি বিস্মিত হই না। কারণ কদিন আগে তিনি অনামিকাকে বলল, তুমি বোরকা ছাড়। কী আনস্মার্ট মেয়ে। এরপর থেকে সে বোরকা ছেড়ে আড্ডায় আসা শুরু করল। তার ভেতরে বড় ধরনের পরিবর্তন এলো। রক্ষণশীল গৃহবধূর বেশ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক তরুণীদের মতো হয়ে উঠলো। কিছুদিন পরে চুলে রংও করালো। এখন সে নতুন নতুন পোশাক পরে আড্ডায় আসে। মাঠের এক অনুষ্ঠানে চৌধুরীর হাত ধরে নাচলোও।

অনামিকা আমার এলাকার মেয়ে ছোটবোন সমতুল্য, ভালো বন্ধুও। ওই মাঠের সবাইকে বলেছে কবি ভাই আমার অভিভাবক। গুজবের ডালপালা যখন ছড়াতে শুরু করল এবং তা আমাকে প্রভাবিত করল। কেউ কেউ এও বললেন, আপনার বোন চৌধুরীর সঙ্গে কী সব করে বেড়াচ্ছে? আপনি তাকে সামাল দিতে পারেন না? তারা তো গোপনে প্রায়ই দেখা করে।

এসব শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এ ব্যাপারে তাকে আমি আলটিমেটাম দিলাম। বললাম, তুমি যদি তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখো তা হলে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব বাদ দাও। অভিভাবক আর বড় ভাইয়ের দাবি থেকেও সরে আস। এরপরও দেখা গেল গোপনে গোপনে তার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছে অনামিকা। নানা অজুহাতে চৌধুরী অর্থ সাহায্য চাইলে তা দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে খান সাহেবের মন্তব্য অনামিকা হচ্ছে দিলওয়ালি। চৌধুরী যা চান, তাই পান। এমন সৌভাগ্যবান পুরুষ এই মাঠে কজন আছেন। অতীতে চৌধুরীর সঙ্গে যেসব নারীর সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে কোনোটাই স্থায়ী হয়নি। কারণ তারা বলতো- 'মিঠা কথায় চিড়া ভেজে না। আগে টাকা খরচ করুন তারপর সম্পর্ক।' অথচ এ ক্ষেত্রে ও নিজেই টাকা খরচ করে। এমন উদার মানবিক মহিলা কোটিপতির স্ত্রীরাও নন। এ কথা বলে খান সাহেব আমার দিকে বাঁকা নজরে তাকালেন। তার এই তাকানোর অর্থ বুঝেও না বোঝার ভান করলাম। এটা সত্য একুশ শতকে এসে নারী-পুরুষের সম্পর্কজনিত সংস্কৃতির পরিবর্তন এসেছে। টাকা ছাড়া কোনো নারীই সম্পর্ক করতে আগ্রহী নয়। এ ক্ষেত্রে অনামিকাই কেবল ব্যতিক্রম।

আমি খান সাহেবকে বললাম, কার সঙ্গে কে কী ধরনের সম্পর্ক রাখবে, সেটা তার নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু অনামিকা বরাবরই গোপন করে যাচ্ছে। এর কারণ কী আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। ও বলে চৌধুরী নাকি ওর বাবার মতো। তাকে সে কেবল সম্মান সমীহ করে, ভালোবাসে না। আমি ওকে বললাম, প্রবীণরা কি এই সমাজে যৌন নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত নন? তারা কি তরুণীকে বিয়ে করেন না। তাদের সঙ্গে কি তরুণীদের ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয় না। তা ছাড়া তোমার বাবা অনেক ভালো মানুষ। তোমাকে অনেক ভালোবাসে। হাসপাতালে যখন আমি তাকে দেখতে যাই, তার ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছে। তোমার তো দ্বিতীয় বাবার প্রয়োজন পড়ে না। আমার কথায় অনামিকা কোনো উত্তর করে না। তবে সে আমার কথায় রুষ্ট হয়। ওর মনোভাব এমন যে, ওর কাজে কেন আমি বাধা দিচ্ছি, হস্তক্ষেপ করছি।

একবার মাঠের পিকনিকে আমরা পুরনো ঢাকার বন্ধু রাকিব খানকে দাওয়াত করলাম। এর আগে আমিই অনামিকা ও রিক্তার সঙ্গে খানকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। চৌধুরী যখন জানতে পারলো বিষয়টি তখন বললেন, ওই ব্যাটার সঙ্গে তোমরা চলবে না। যার বউ চলে গিয়েছে, সে খুব খারাপ মানুষ। এরপর দ্বিতীয় দিন যখন রাকিব খান মাঠে এলো, রিক্তা অনামিকার জন্য বিশেষ উপহার নিয়ে, তখন, চৌধুরী তার ঠ্যাং ভাঙার হুমকি দিলেন। কেবল তাই নয়, মাঠে আসেন কামাল সাহেব। তার রয়েছে গাড়ির ব্যবসা। অত্যন্ত রসিকজন ও সুদর্শন। তার বয়স আশির কাছাকাছি। তার অফিসে যাওয়ার জন্যও চৌধুরী দুজনকে বারণ করলেন। বললেন আমি তাকে ২০ বছর ধরে চিনি। লোকটি ভীষণ নারীবাজ। অর্থ, দামি উপহার ও খাবার দিয়ে নারীদের ভুলিয়ে ফেলেন। খবরদার তোমরা তার কাছে যাবে না। তার সঙ্গে মাঠে আসেন আওয়াল সাহেব। বেশ রসিক লোক, তারও অসম্ভব নারীপ্রীতি রয়েছে। তার নানা রসিকতায় মুগ্ধ হয়ে অনামিকা-রিক্তা তার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই বাদসাধেন চৌধুরী। বলেন, তোমরা কি জানো ও কত খারাপ। খবরদার ওর সঙ্গে কথা বলবে না কখনো।

পুরনো ঢাকা থেকে এসেছে রাকিব খানের ভাতিজা লেখক-প্রকাশক শাহান শাহে আলম। তার একমাত্র পুত্র কেন্দ্রীয় কলেজে ভর্তি হওয়ার কারণে তিনি মোহাম্মদপুরের শেখের টেক চলে আসেন। আড্ডায় এসে পরিচিত হন রিক্তা অনামিকার সঙ্গে। অনামিকাকে তার ভালো লাগে। আমাকে বলে, ও বেশ সহজ-সরল রোমান্টিক। দেখতেও বেশ সুন্দর। এক সকালে চৌধুরীর কাছে অনামিকার ফোন নাম্বার চায় সে। চৌধুরী বলে, ওরটা দিতে পারবো না, রিক্তারটা নিতে পারেন। কথাটা শাহ আমাকে বলতেই আমি চটে যাই। এর আগের দিন রাত সাড়ে ১০টায় অনামিকা আমাকে ফোন দিয়ে বলে, চৌধুরী নাকি অসুস্থ, একটু খোঁজ নিয়ে আমাকে জানান। আমি বললাম, তুমি ফোন দাও। ও বললো, এত রাতে মেয়েমানুষ হয়ে আমার ফোন দেয়া ঠিক হবে না। আমি বললাম, তুমি কার কাছে শুনলে তিনি অসুস্থ। ও বললো, রিক্তা বলেছে। চৌধুরী এর আগেও অসুস্থতার নাটক করেছিলেন। যখনই অনামিকা তাকে কোনো কড়া কথা বলে অথবা সম্পর্ক ছিন্নের হুমকি দেয় তখনই তিনি অসুস্থতার নাটক করেন এবং রিক্তার মাধ্যমে অনামিকাকে জানান দেন। এটা হয়তো বা চৌধুরীর প্রণয়জনিত কৌশল। এবারো তাই করেছেন তিনি। আমি অনামিকাকে বললাম ঠিক আছে, দেখছি বিষয়টি। দুই মিনিট পরেই ব্যাকুল কণ্ঠে অনামিকার ফোন, উনার কী হয়েছে জানতে পেরেছেন কি? দ্বিতীয় ফোনে আমি অবাক হলাম। বললাম, আমি খাচ্ছি। তোমাকে একটু পরে জানাচ্ছি।

চৌধুরীকে অনামিকার অনুরোধে একবার এক কোচিং সেন্টারে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। চাকরি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখ উল্টিয়ে ফেললেন। মাঠে তিনি আর আমাকে চেনেন না। শুনতে পাই, তিনি অনামিকা আর রিক্তাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছেন খাচ্ছেন আর ফুর্তি করছেন। লোকটি অকৃতজ্ঞ নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে ফোন দিই না, রিসিভও করি না। অবশ্য নারী ঘটিত কারণে ওই চাকরিও চলে গেছে, বদনাম হয়েছে আমার। এরপর অনামিকার শত অনুরোধেও চৌধুরীকে দ্বিতীয়বার চাকরি দেয়ার ব্যাপারে মনোযোগী হই না।

আজকের ঘটনায় আমার কী করা উচিত। মাঠে নতুন যুক্ত হওয়া খালেদ ভাইকে ফোন দিলাম। বললাম, চৌধুরী নাকি অসুস্থ তার খোঁজ নিন। অনামিকা তার খবর জানার জন্য ব্যাকুল। আমাকে দুবার ফোন দিয়েছে। খালেদ ভাই ফোন দিয়ে বললেন, চৌধুরী ভাই আপনি নাকি অসুস্থ। এই কথা শুনে চৌধুরী অবাক। বললেন, আপনাকে কে বলেছে। খালেদ ভাই বললেন, কবি ভাই বলেছেন। চৌধুরী বললেন, ও তো একটি ভন্ড। খালেদ ভাই আমার খুব ভক্ত। তিনি এই কথা অনামিকাকে বলাতে, ও বললো এটা কবিকে বলবেন না। তিনি শুনলে রেগে যাবেন। কথাটি তিনি আমাকেও বললেন। আমি সব জায়গায় নিজেকে খারাপ মানুষ হিসেবে দাবি করি। এও বলি, আমি যতটুকু খারাপ এটুকু খারাপ অন্যেরা হলে বাংলাদেশ আরো উন্নত দেশের কাতারে যেত। লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, বাঙালি ৫০ ভাগ সৎ হলেই যথেষ্ট। এখন যে ঘুষ দুর্নীতি চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনো সম্রাটদের কেলেঙ্কারি তাতে ওই চিত্রই ফুটে ওঠে।

আজ সকালে যখন চৌধুরী অনামিকার নাম্বার শাহেন শাহকে দিলেন না। তখন আমি ক্ষিপ্ত হলাম এবং ভাবলাম যথেষ্ট হয়েছে এটা আর বাড়তে দেয়া ঠিক হবে না। কারণ পরিচয় হওয়ার সাত দিনের মাথায় খালেদ সাহেব কেন অনামিকাকে চারবার ভিডিও কল দিয়েছেন, তার সঙ্গে খাবার আনতে মাঠের বাইরে গিয়েছেন, রাতেও নাকি তারা দেখা করে। এই নিয়ে চৌধুরী খালেদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছেন। এ কথা জানার পর আমি ক্ষুব্ধ হই। খালেদ সাহেব এও বলেন, কবি ভাই চৌধুরী তো আপনার নামই শুনতে পারেন না।

এবার অগ্নিমূর্তি নিয়ে আমি তার মুখোমুখি হলাম। বললাম, রিক্তার নাম্বার দিয়েছেন অনামিকার নাম্বার শাহকে দেননি কেন? অনামিকা আপনার কে? তাকে নিয়ন্ত্রণ করার আপনি কে। আর আমাকে ভন্ড বলেছেন কোন সাহসে। আবার যদি অনামিকাকে ফোন করেন, তা হলে আপনাকে আমি দেখে নেব। এদিন মাঠে বেড়াতে এসেছিলেন কবি-বন্ধু সোহেলী খান। তিনিও এই ঘটনায় বিব্রতবোধ করলেন। তিনি আমাকে নিয়ে মাঠের বাইরে চলে এলেন। আজ বিজয়া দশমী, ৮ অক্টোবর, মঙ্গলবার, ২০১৯। আমরা দুজন বাঁশবাড়ি পূজামন্ডব পরিদর্শনে গেলাম। যেতে যেতে ও বললো মাঠে কেবল প্রেমের ছড়াছড়ি। হায় প্রেম হায় ভালোবাসা। আমি ওর দিকে বাঁকা নজরে তাকালাম। তিন বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ওর ছাড়াছাড়ি হয়েছে। ওর দুঃখ আমি বুঝি, কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। রিংরোড এসে ওকে তেঁতুলিয়া পরিবহনে তুলে দিলাম। বিদায়ের সময় ও বড় বড় চোখ করে করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

অনামিকার বাসাটা যে জায়গায়, ওখান দিয়েই আমার নিত্য যাতায়াত। ওর দুটো ছেলে, মেয়ে নেই। তাই আমার ছোট মেয়েকেই ও মেয়ে বলে জানে, ওভাবে আদরও করে। ওকে নানা সময় উপহার-খাবারও দেয়। সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগেই। আমি রিকশা করে বাসায় যাচ্ছি অনামিকার বাসার পাশে দিয়ে। হঠাৎ খেয়াল করলাম লাল পাঞ্জাবি পরে আলো-আঁধারির মধ্যে চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছে। আমার চোখ ছানাবড়া। তবে অনামিকাকে কোথাও দেখা গেল না।

০৮-১০-২০১৯

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<70520 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1