বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক প্রমথ চৌধুরী

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
  ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

বাংলাসাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম প্রমথ চৌধুরী। তিনি বাংলাসাহিত্যে চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তক। তিনি একজন শক্তিমান লেখক ছিলেন, বাংলাসাহিত্যে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বাংলাসাহিত্যের গতিপথ ঘুরিয়ে দিয়ে নতুনত্ব এনেছিলেন। তার সাহিত্য রচনার সুনিপুণতা, সৃষ্টিশৈলিতা, গাম্ভীর্যতা, যুক্তিনিষ্ঠতা সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। সাহিত্য অঙ্গনে প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম ছিল 'বীরবল'। এ ছদ্মনামে পত্রিকার পাতায় লেখালেখি করে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। তাই উনাকে বলা হতো বাংলাসাহিত্যের বীরবল। সম্রাট আকবরের দরবারে নবরেত্নর একজন ছিলেন বীরবল আর বাংলাসাহিত্যে প্রমথ চৌধুরীও তেমনি এক রত্ন। প্রমথ চৌধুরীকে বাংলাসাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি প্রবন্ধ রচনা ও সাহিত্য সমালোচনার পাশাপাশি কবিতা, গল্প, চুটকি রচনায় খুব পারদর্শী ছিলেন। ব্যঙ্গাত্মক রচনাতেও তার জুড়ি নেই এবং তার কবিতাগুলো ছিল খুবই বাস্তববাদী এবং রূঢ়। প্রমথ চৌধুরীর রচনায় ছোটগল্পগুলো ছিল অসাধারণ। ছোট গল্প লেখার ক্ষেত্রে তিনি বাস্তবতার নিরিখে সুগভীর উপলব্ধি হতে সহজ সাবলীল ভাষায় লিখতেন। যেন সাধারণ পাঠক লেখাটি পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এই ধাঁচটি পরবর্তী সময়ে তার প্রবন্ধগুলোতেও দেখতে পাওয়া যায়। তিনি মূলত সাধারণ পাঠকদের কথা মাথায় রেখে সাহিত্য রচনা করতেন। পাঠকের মনোভাব উপলব্ধি করে তাদের অব্যক্ত কথাগুলো তিনি তার ছোট গল্প ও প্রবন্ধে লিখেছেন। তাই তো তিনি বলেছিলেন, 'ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।' তিনি রবীন্দ্র যুগে নিজেকে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং প্রশংসিত হয়েছেন। প্রমথ চৌধুরী সেই সময়কার জনপ্রিয় 'সবুজপত্র' পত্রিকার একজন স্বনামধন্য সম্পাদক ছিলেন। 'সবুজপত্র' পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব বেশ সফলভাবে পালন করেন। তার 'সবুজপত্র' পত্রিকার মাধ্যমে তিনি নব্য লেখকদের একটি শক্তিশালী সংঘ তৈরি করেছিলেন। এ পত্রিকার মাধ্যমে সাহিত্যের বিকাশে তিনি ব্যাপকভাবে অবদান রাখেন এবং তরুণ প্রজন্মের লেখক ও পাঠকদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।

প্রমথ চৌধুরী ১৮৬৮ সালের ৭ আগস্ট যশোরে তার পৈতৃক নিবাস পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামে স্থানীয় জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দুর্গাদাস চৌধুরী এবং মাতার নাম মগ্নময়ী দেবী। প্রমথ চৌধুরী কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে বিএ পাস এবং ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাস করেন। তার শিক্ষা জীবন ছিল অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ। ১৮৯৩ সালে ইংল্যান্ড গমন করেন এবং তিনি সেখান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গেই ব্যারিস্টারি পাস করেন। কর্মজীবনে কিছুকাল তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপনা ছাড়াও সরকারের উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরা দেবীকে বিয়ে করেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই। সুতরাং সে হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী-জামাতা ছিলেন প্রমথ চৌধুরী। লেখালেখির প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহের কারণে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে বিখ্যাত 'সবুজপত্র' পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কৃতিত্বের সঙ্গে পালন করেন। বাংলা সাহিত্যকে তিনি নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলাসাহিত্যের তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন সমালোচক। বর্তমানে সমালোচনার নামে যদিও অনেকে নিন্দা করে, ব্যক্তিকে খাটো করে, তার সৃষ্ট কর্মকে তুলোধুনো করে ব্যক্তি আক্রোশে। প্রমথ চৌধুরী ছিলেন তার উল্টো স্রোতের যাত্রী। ব্যক্তি আক্রোশ তার সমালোচনায় ছিল না বললেই চলে। তিনি সাহিত্যের গঠনমূলক সমালোচনা করতেন। যা এখনো তাকে প্রথম শ্রেণির সমালোচকের আসনেই অপরিবর্তিত রেখেছে। তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। সুতরাং সে কারণেই তিনি ইউরোপীয় শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। যার প্রভাব পড়েছিল পরবর্তী সাহিত্যে। অনেকেই মত পোষণ করেন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবের কারণেই তার প্রবন্ধগুলোতে অনেক উদ্ভট বিষয় স্থান পেয়েছে। নিঃসন্দেহে তার লেখার ধাঁচ বাংলাসাহিত্যের জন্য মাইলফলক।

তিনি ছিলেন মননশীল ও প্রচন্ড যুক্তিবাদী। তিনি বলেছেন, 'জ্ঞানের প্রদীপ যেখানেই জ্বালো না কেন, তাহার আলোক চারিদিক ছড়াইয়া পড়িবে। মনোজগতে বাতি জ্বালানোর জন্য সাহিত্যচর্চার বিশেষ প্রয়োজন।' স্বদেশপ্রীতি সম্পর্কে তার অভিমত, 'আমরা স্বদেশে যাতে বিদেশি না হই, সে বিষয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে।' তিনি মানসিক যৌবনকেই সমাজে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস করেছেন। কাব্যসাধনা যে কখনও 'জোর করা ভাব, আর ধার করা ভাষা'য় পরিণত না হয়, সে বিষয়ে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন। পাবনার বিখ্যাত চৌধুরী বংশের সন্তান প্রমথ চৌধুরী কেবল কুলে-মানে অভিজাত ছিলেন তা নয়, মনের দিক থেকেও ছিলেন উদার। কোনো কোনো সমালোচক মনে করেন, প্রমথ চৌধুরীর লেখা 'প্যারাডকসে আক্রান্ত' অর্থাৎ যে উক্তি আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও সত্যবর্জিত নয়। কিন্তু সত্য হলো তার লেখার ধরন খুবই বুদ্ধিবৃত্তিক, যুক্তিনিষ্ঠ। পারিবারিক সূত্রে রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী-জামাতা এবং বয়োকনিষ্ঠ হয়েও গদ্য রচনারীতিতে রবীঠাকুরকে প্রভাবিত করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী। যা কবিগুরু নিজেই স্বীকার করে ছিলেন। তিনি খুব উদার মানসিকতা থেকে বলেছিলেন, তার গল্প ও সনেট বাংলা সাহিত্যে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ এবং ভাষাভঙ্গি আর ভাবনার ধারা পরবর্তী একটি গোষ্ঠীর ওপর বিশেষ ক্রিয়াশীল হয়েছে। বাংলায় কথ্যরীতি তারই হাতে সাহিত্যিক স্বীকৃতি লাভ করে। রবীন্দ্রনাথের জোর সমর্থন এবং ব্যক্তিগত চেষ্টায় সে রীতি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। বস্তুত, প্রমথ চৌধুরীর 'সবুজপত্র' পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই এই দুজনের প্রচেষ্টাতে এই কথ্যরীতির পূর্ণতম প্রাণপ্রতিষ্ঠা ঘটে। 'সবুজপত্র' পত্রিকার মাধ্যমে প্রমথ চৌধুরী বাংলা গদ্যে নবরীতি প্রবর্তন করেন এবং তার প্রবন্ধাবলিতে প্রমাণ করেন যে, চলিতভাষায় লঘুগুরু সব ধরনের ভাবভাবনার প্রকাশ সম্ভব। নাগরিক বৈদগ্ধ, মননের তীক্ষ্নতা, চমক, রোমান্টিক ভাবালুতার বিরুদ্ধতা, বুদ্ধির অতিচর্চা এবং কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গ, কিঞ্চিৎ রঙ্গ-ব্যঙ্গের হাসি প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধের ভাষায় বিধৃত। উইট এপিগ্রামের সুপ্রচুর ব্যবহারে তার লেখা প্রবন্ধগুলো আজও পাঠকদের আকৃষ্ট করে। দর্শন, রাষ্ট্রনীতি, ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি নানা বিষয়ে তিনি যেসব প্রবন্ধ লিখেছেন সেগুলোর সর্বত্রই তার রচনায় তীক্ষ্ন মৌলিকতার চিহ্ন রয়েছে। বিষয়ের অভ্যন্তরে বিতর্কের ভঙ্গিতে প্রবেশ করে তার প্রাণকেন্দ্রটিকে আলোকপাত করতে প্রমথ চৌধুরীর জুড়ি নেই। সাহিত্য সমালোচক হিসেবেও তিনি সেইভাবে খ্যাত। তাকে এককথায় সৃষ্টিশীল এবং রূপবাদী আখ্যা দেয়া যেতে পারে।

(৯ পৃষ্ঠায় দেখুন)

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<67477 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1