বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
জন্মদিনের শুভেচ্ছা

শাহীন রেজা এবং আমার অনুভব

হায়াৎ সাইফ
  ২৪ মে ২০১৯, ০০:০০

বছর সাতেক আগের কথা। কবি ফজল শাহাবুদ্দীন তখন বেঁচে আছেন। একদিন বিকালে তার অফিসে উপস্থিত হতেই আমার হাতে একটা বই ধরিয়ে দিলেন। বইটি শাহীন রেজার 'নির্বাচিত কবিতা'। বললেন, ওর ওপর একটা সংখ্যা বের করছি। আপনি একটা লেখা দেবেন। আমি এমনিতেই লেখালেখিতে খুব একটা সরব নই। বই আলোচনা করেছি তবে বেশি নয়। আর একজন লেখক বা কবিকে নিয়ে লেখা একটু কষ্টকর তো বটেই। তবুও ফজল ভাইয়ের অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। বললাম, লিখব। এরপর নানা ব্যস্ততায় লেখাটি সম্পন্ন করা হয়ে ওঠেনি, যদিও সে সময় বইটি মোটামুটি পাঠ করেছিলাম এবং লেখার একটি প্রস্তুতিও তৈরি হয়েছিল। এর কিছুদিন পর ফজল ভাই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। বিষয়টার সেখানেই বোধহয় ইতি ঘটতো। কিন্তু নাহ্‌। ২০১৮-তে আমি একুশে পদক পাওয়ায় আমার জন্য ছোট আকারে একটা সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল কবি ও সম্পাদক রানা মুস্তফী। তার বাংলাদেশ সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অন্যদের সাথে শাহীন রেজাও এসেছিল। ও সেদিন বক্তৃতা শেষে আমাকে নিয়ে লেখা একটা কবিতা পাঠ করে সেটি আমার হাতে তুলে দিয়েছিল। জীবনে অনেক পাওয়ার ভিড়ে এ পাওয়াটিকে আমার অকিঞ্চিতকর মনে হয়েছিল এবং আমি কবিতাটি এনে সযতনে আমার ড্রয়ারে তুলে রেখেছিলাম। সম্ভবত পরে এটি কোনো একটা কাগজেও ছাপা হয়েছিল। এর দু'তিনদিন পরে শাহীন আমাকে ফোন করেছিল। বলেছিল, আমাকে নিয়ে ওরা বড় একটা আয়োজন করতে চায়। আমার শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছিল না বিধায় ওকে বলেছিলাম কয়েকদিন পরে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে। ঠিক সে সময়েই আমার ফজল ভাইয়ের লেখাটির প্রসঙ্গ মনে এসেছিল। শাহীনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেই সংখ্যাটির কথা। ও করুণভাবে বলেছিল, সেটি বের হয়নি। তবে এখন বের হওয়ার প্রস্তুতি চলছে। আমি ওকে বললাম, আমি তোমাকে নিয়ে কিছু লিখতে চাই। ও ভীষণ আগ্রহ দেখালো। এতে আমার মধ্যেও এক ধরনের তাড়নার সৃষ্টি হলো। আমি ওর বইটিকে অনেক বইয়ের ভিড় থেকে বের করে আবার পড়লাম। দুদিন ধরে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে আমার মনে একটা প্রশ্ন জন্ম নিল। যার কবিতার গাঁথুনি এত মজবুত, শব্দপ্রয়োগ চিত্রকল্প এত হৃদয়গ্রাহী এবং ছন্দ এতটা দৃঢ় সে কেন এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছে। ওর তো অনেক আগেই কবিতায় একটি স্থায়ী আসন তৈরি করা উচিত ছিল। মনে পড়ল ফজল ভাইয়ের কথা। লেখক কিংবা কবি চিনতে তিনি যে ভুল করতেন না সম্ভবত শাহীন তার প্রমাণ। শাহীনকে নিয়ে তার গভীর আবেগই সে সত্যটিকে জানান দিয়েছিল কিন্তু সেদিন আমি সেটা বুঝতে পারিনি আজ ওর বই পড়ে সেই অনুভূতিটা আমি আমার মধ্যে ফিরে পেলাম।

শাহীনের একটি কবিতার শিরোনাম, 'শরৎ এবং ভেঙ্গে পড়া'। এ কবিতায় ও শেষ পঙ্‌ক্তিতে লিখেছে -

'শব্দ সৌন্দর্য শরৎ কাশফুল মৃত্তিকা পলস্নবের

কাছাকাছি অনিন্দ্য এবং অনিমেষ ভাঙ্গনে

আমার প্রতিনিয়ত জন্ম হয়'।

ভাঙ্গন যে অনিন্দ্য এবং অনিমেষ হতে পারে তা এই প্রথম ওর কবিতা পড়ে আমি উপলব্ধি করলাম। শেলী কিংবা বায়রনের কবিতায় এ ধরনের উচ্চারণ থাকলে আমি চমকিত হতাম না। কিন্তু শাহীনের কবিতায় এই প্রকাশ আমাকে মুগ্ধ ও বিমোহিত করেছে। একই কবিতার শেষ লাইনে শাহীন প্রকাশ করেছে সেই চিরাচরিত সত্যটিকে। যার উপরে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবী, দাঁড়িয়ে আছে মানুষের সব আস্থা ও নিবিড়তা এবং ভালোবাসার অনিঃশ্বেষ কথামালা-

'ভাঙ্গন, জন্ম ও মৃতু্যর অনিবার্য ধ্বনি'।

সত্যিই তো এক ভাঙ্গনের মধ্যদিয়ে আমাদের উদ্ভব, আর আরেক ভাঙ্গনে প্রস্থান। এই যে আসা যাওয়ার নিরন্তর ধ্বনির সূত্র আবিষ্কার শাহীনের পক্ষে সম্ভব হয়েছে একটি কারণে, আর সেটি হচ্ছে সে একজন 'কবি'। আমি ওর এই কবিস্বত্বাকে সালাম জানাই।

'কবিতা' লেখা এক জিনিস আর 'কবি' হওয়া ভিন্ন জিনিস। কবি হতে হলে একজনকে চিন্তার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে হয়। আবিষ্কার করতে হয় একের পর এক জীবনের নিগূঢ় রহস্য এবং অভিসন্ধিকে। তাকে অর্জন করতে হয় তৃতীয় নয়ন। সৃষ্টির সম্ভাব্যতায় ভাসিয়ে দিতে হয় নিজের সমুদয় চিন্তা-চেতনার সম্ভার।

শাহীনের কবিতা পড়ে আমার মনে হয়েছে সে মূলত প্রেমিক তবে তার মধ্যে দেশ ও প্রকৃতিকে আমি আবিষ্কার করেছি বহুবার বহুরূপে। জীবন বোধের অত্যন্ত কাছাকাছি একটি সরল অংকে অবস্থান করেও যে প্রেমে প্রবিষ্ট হওয়া যায় শাহীনই বোধ হয় তার একমাত্র প্রমাণ।

গ্রন্থটির একটি কবিতায় সে একজন মধ্যবিত্ত কবির বাজার গমনের দৃশ্য চিত্রায়িত করার প্রয়াস পেয়েছে। একজন কবি, যিনি সারাক্ষণ মেতে থাকবেন সৃজনে কূজনে এবং শব্দময়তা ঘিরে থাকবে যার প্রতিটি মুহূর্ত, তাকে কেন স্পর্শ করবে সংসারের তীব্র অনটন, কেন তাকে সহ্য করতে হবে মাছের আঁশটে গন্ধ আর মাংসের দোকান থেকে উড়ে আসা মাছির তীব্র ভনভন। কবিতাটির শেষ দুটি লাইন যেন প্রতিটি মধ্য এবং নিম্নবিত্ত কবির একান্ত আর্তনাদ।

'বাজারে যাবোনা শেলী পাজামাটা তুলে রাখো আজ

কবিকে কি মানায় বলো ছেঁড়া চপ্পলের সাজ'।

(কবি এবং বাজার যাত্রা)

এ কবিতাটি পড়তে পড়তে আমার চোখে ভেসে উঠল নজরুল, সুকান্তসহ সে সময় এবং এ সময়ের নির্মলেন্দু গুণ, শাহাদাৎ বুলবুলসহ অগণিত কবির ছবি। কবিকে কেন ছেঁড়া চপ্পল পরে ব্যাগ হাতে বাজারে ছুটতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে বাস কিংবা ট্রামের? সে তো সৃষ্টিশ্বর, রাজাধিরাজ। স্বয়ং বিধাতা প্রেরিত জগতের শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। শাহীনের এই আর্তনাদ যেন পৃথিবীর সব কবির আর্তনাদে মিশে গেছে।

হিংসা হানাহানির এই সময়ে এটি যেন একটি প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদ। আজ সারা বিশ্বে যে সন্ত্রাস ধ্বংসযজ্ঞ চলছে সেখানে মৃতু্যতেও যেন শেষ হচ্ছে না সব কিছু। একজন মৃতের স্বাভাবিক গন্ধতেও যেন মিশে যাচ্ছে হন্তারক বারুদের ঘ্রাণ। চিত্রকল্পের মাধ্যমে ভয়াবহতার এই প্রচ্ছন্ন বর্ণনা সত্যিই মোহিত করার মতো।

আলোচনাটি আরও দীর্ঘ হলে হয়তো ভালো হতো কিন্তু সেটি করতে গেলে যে সুস্থতার প্রয়োজন তা এ মুহূর্তে আমার নেই। শেষাংশে এসে আমি শাহীনের বিভিন্ন কবিতা থেকে আমাকে স্পর্শ করেছে এমন কয়েকটি পঙ্‌ক্তি উলেস্নখ করতে চাই-

'মানুষ স্বপ্নান্ধ মানুষ জন্মান্ধ'

'নামতা অভাবে ঘাস এবং নক্ষত্রের হিসাব মেলেনা'

'আমার হাতের মধ্যে কিছু বৃষ্টি

হাতের মধ্যে আমার বর্ণমালা'

'পুনশ্চঃ ইঁদুর ঠেকাতে কৃষক সতর্কতার বিকল্প নেই'

'আমাকে ফিরিয়ে দাও আমার বিবেক '

'আমি কবি

বেঁচে আছি পাখি ও কবিতার কাছাকাছি

আমি কেন ভুল পথে যাবো?'

'আমাকে খুঁজোনা তুমি বেতফল চোখ'

খন্ডখন্ড এ সব উচ্চারণ যদিও কবি হিসেবে একজন শাহীনকে শনাক্ত করার জন্য যথেষ্ট নয় তবুও আমি আমার ভালোলাগা এবং ভালোবাসাকে তুলে ধরলাম। শাহীনের বয়স পঞ্চান্ন পেরিয়েছে। একজন কবির জন্য এটা কম সময় নয়। যদিও আমাদের তুলনায় এবং শারীরিক গঠনপ্রকৃতি আর পোশাক-আশাকে সে তরুণই রয়ে গেছে। তার সামনে পড়ে আছে আরও দীর্ঘপথ। আমি কবিতার এই সূর্যসন্তানকে আমার আশীর্বাদ জানাই এবং প্রার্থনা করি ওর মধ্যে কবিতার শেষ গন্তব্য 'আধ্যাত্মিকতা' প্রবিষ্ট হোক।

(লেখাটি কবি শাহীন রেজাকে নিয়ে প্রকাশিতব্য একটি বিশেষ সংখ্যার জন্য কবি হায়াৎ সাইফ রচনা করেছিলেন ২০১৮ সালের মে মাসে। অপ্রকাশিত সে লেখাটি কবি শাহীন রেজার ৫৭তম জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশিত হলো- সাহিত্য সম্পাদক)

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<50755 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1