বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অসাম্প্রদায়িক ও প্রতিবাদী কথাশিল্পী শওকত ওসমান

সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, সমস্যা, বৈষম্য ও নিপীড়িত মানুষের কথা তিনি লিখে গেছেন। তিনি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তবে তার লেখার মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ চেতনা জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন।
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
  ২৪ মে ২০১৯, ০০:০০

বাংলা সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত কথাসাহিত্যিক ছিলেন শওকত ওসমান। তিনি বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ। তিনি ছিলেন আধুনিকতা, অসাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী একজন লেখক। বাঙালি মুসলিম কথাসাহিত্যিকদের সাহিত্য রচনার অতীত ইতিহাস খুব বেশি গর্ব করার মতোন ছিল না। ধর্মীয় প্রভাব, আধুনিক শিক্ষার অভাব, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মুসলিম কথাসাহিত্যিকরা ছিলেন পশ্চাদপদ। ঊনবিংশ শতকে সেখান থেকে সর্বপ্রথম বের হয়ে আসেন মুসলিম কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিকাশ ঘটে। তখন তাদের মধ্যে মুক্তবুদ্ধি, উদার নৈতিক চিন্তা ও পাশ্চাত্য মানবতাবাদী জীবন দৃষ্টির আলোকে সাহিত্যচর্চার একটা স্ফুরণ লক্ষ্য করা যায়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কাজী নজরুল ইসলাম অসাম্প্রদায়িক কবি ও লেখক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠেন। বাঙালি মুসলিম লেখকদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সাহিত্যচর্চার প্রেরণা ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। আর শওকত ওসমান ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্য রচনার অন্যতম দিকপাল। প্রয়াত কবি ও কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ শওকত ওসমানকে বলতেন 'অগ্রবর্তী আধুনিক মানুষ'। শওকত ওসমান শুধু একজন কথাসাহিত্যিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন একাধারে একজন কবি, নাট্যকার, রম্য লেখক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, গ্রন্থ সম্পাদক প্রভৃতি। উপন্যাস ও গল্প রচনার পাশাপাশি তিনি কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, রম্যরচনা, স্মৃতিকথাসহ বেশকিছু শিশুতোষ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন দিকে বিচরণ করে শওকত ওসমানের অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তবে তিনি বাংলা সাহিত্যে একজন কথাশিল্পী হিসেবেই সুপরিচিত।

১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সাবলসিংহপুর নামক গ্রামে একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শওকত ওসমান। তার পিতার নাম শেখ মোহাম্মদ এহিয়া ও মাতার নাম গুলজান বেগম। পারিবারিকভাবে দেয়া তার প্রকৃত নাম হচ্ছে শেখ আজিজুর রহমান। তিনি প্রথম দিকে এই নামেই লেখালেখি শুরু করেছিলেন। 'সওগাত' 'আজাদ' ও 'বুলবুল' প্রভৃতি পত্রিকায় শেখ আজিজুর রহমান নামে বেশকিছু কবিতা প্রকাশের তথ্য পাওয়া যায়। তৎকালীন সময়ে আজিজুর রহমান নামে আর একজন কবি থাকায় তিনি নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। তখন থেকেই তিনি শওকত ওসমান নামে লেখালেখি শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে এই নামেই তিনি বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত হোন। তার শৈশব-কৈশোর, শিক্ষাজীবন, কর্মজীবনের শুরু কলকাতায় হলেও উত্তরকালে তিনি পরিবারসহ বাংলাদেশেই আমৃতু্য বসবাস করেছেন। শওকত ওসমান কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসা থেকে প্রবেশিকা (১৯৩৩), সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে আইএ (১৯৩৬) ও বিএ (১৯৩৯) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ (১৯৪১) পাস করেন। আইএ পাস করার পর তিনি কিছুদিন কলকাতা করপোরেশন এবং বাংলা সরকারের তথ্য বিভাগে চাকরি করেন। এমএ পাস করার পর তিনি গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে (১৯৪১) লেকচারার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ অব কমার্সে যোগ দেন এবং ১৯৫৯ সাল থেকে ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করে ১৯৭২ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে যান। চাকরিজীবনের প্রথমদিকে স্বল্পসময় তিনি কৃষক পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন।

সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদবিরোধী শওকত ওসমান আজন্মকাল শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে কলম ধরে ছিলেন। বাংলাদেশের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, আইয়ুবীয় সামরিক শাসন, ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরে জাতির জনকের হত্যা, সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন প্রভৃতি সামাজিক রাজনৈতিক সংগ্রামে, সংকটে সমকালীন বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান হয়ে ওঠেন অনিবার্য, অবিস্মরণীয়, অনন্য এক কথাশিল্পী। ওই সময়কার সময়ে তার প্রকাশিত রচনাবলির মধ্যে তার ছাপ সুস্পষ্ট। ওই সময়ে তার প্রকাশিত উলেস্নখযোগ্য কয়েকটি রচনা হলো, উপন্যাস জননী (১৯৫৮), ক্রীতদাশের হাসি (১৯৬২), সমাগম (১৯৬৭), চৌরসন্ধি (১৯৬৮), রাজা উপাখ্যান (১৯৭১), জাহান্নাম হইতে বিদায় (১৯৭১), দুই সৈনিক (১৯৭৩), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩), পতঙ্গ পিঞ্জর (১৯৮৩), আর্তনাদ (১৯৮৫), রাজপুরুষ (১৯৯২), ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৯০), সংস্কৃতির চড়াই-উতরাই (১৯৮৫), মুসলিম মানসের রূপান্তর (১৯৮৬), নাটক আমলার মামলা (১৯৪৯), পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা (১৯৯০)। এইসব রচনাবলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল জননী ও ক্রীতদাসদের হাসি। জননীতে সামাজিক জীবন ও ক্রীতদাসের হাসিতে রাজনৈতিক জীবনের কিছু অন্ধকার দিক উন্মোচিত হয়েছে। প্রাচীন কাহিনী, ঘটনা ও চরিত্রের রূপকে লেখক সমকালীন রাজনীতিতে স্বৈরাচারী চরিত্র ও নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেছেন। জননীতে গ্রাম ও নগরজীবনের সংঘাতে একটি পরিবারের বিপর্যস্ত অবস্থার বিবরণ আছে। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত নেকড়ে অরণ্য গ্রন্থে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলার নরনারীর নির্যাতনের করুণ বিবরণ আছে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি কলকাতায় উদ্বাস্তু ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শওকত ওসমান গোলাবারুদ বা রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করেননি, কিন্তু যুদ্ধের পক্ষে তার পূর্ণ সমর্থন ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দসৈনিকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তিনি নিয়মিত কবিতা ও কথিকা পাঠ করতেন। এগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, তেমনি তাদের মনোবল করেছে নিবিষ্ট। তিনি তার উপন্যাসগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যা আমাদের স্থবির করে দেয়। বিশেষ করে তার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ কালরাত্রি খন্ডচিত্র (১৯৮৬) ও (১৯৯৩), মুজিবনগর (১৯৯৩) উলেস্নখযোগ্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ৮ জানুয়ারি তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তিনি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পছন্দের একজন মানুষ। বঙ্গবন্ধু নিজেও শওকত ওসমানের রচনাবলির একজন একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন বলে জানা যায়। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তখন তিনি অভিমানে ও ঘৃণায় একধরনের প্রতীকী প্রতিবাদস্বরূপ স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। তিনি সেখানে টানা পাঁচ বছর অবস্থান করেছিলেন। দেশের বিশিষ্টজনদের অনুরোধে ১৯৮১ সালে ১৭ এপ্রিল তিনি আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। তবে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান কালে তিনি নিরলসভাবে সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করে ছিলেন।

সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, সমস্যা, বৈষম্য ও নিপীড়িত মানুষের কথা তিনি লিখে গেছেন। তিনি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তবে তার লেখার মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ চেতনা জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী একজন লেখক। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশে যে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তিনি এর বিপক্ষে ছিলেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তুলতে তিনি বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনা করেন। এ ছাড়াও তিনি সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে অনেক প্রবন্ধ ও গল্প রচনা করেছেন। তিনি শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশে বেশ কিছু শিশুতোষ গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি তার জীবদ্দশায় অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। আবার অনেক লেখাই গ্রন্থ আকারে প্রকাশের সময় ও সুযোগ তিনি পাননি। তিনি লেখালেখির দিকে যেভাবে মনোযোগী ছিলেন, গ্রন্থ প্রকাশের দিকে তারচেয়ে বেশি অমনোযোগী ছিলেন। তিনি বলতেন, সুযোগ পেলেই লিখি কিন্তু প্রকাশনার ব্যাপারে আমার আঠারো মাসে বছর। তিনি আমৃতু্য সাহিত্যচর্চায় সময় কাটিয়েছেন, কখনো সময়ের অপচয় করতেন না, এখানেই তার কৃতিত্ব। এই বরেণ্য কথাশিল্পী ১৯৯৮ সালের ১৪ মে ৮১ বছর বয়সে ঢাকায় মৃতু্যবরণ করেন। সাহিত্যকর্মে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৬), পাকিস্তান সরকারের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৭), একুশে পদক (১৯৮৩), মাহবুবউলস্নাহ ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৩), মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৭)-এ ভূষিত হন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<50753 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1