বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথের পলস্নী উন্নয়ন ভাবনা ও কৃষক সমাজ

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  ১০ মে ২০১৯, ০০:০০

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নাগরিক মানুষ। জীবনের শুরুর দিকে পলস্নীগ্রামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল নিতান্তই হীন। গ্রামীণ জীবনের সামগ্রিক পরিচয় ও বিবিধ সমস্যার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে অনেক পরে। তাঁর পিতার নির্দেশে জমিদারী পরিচালনার জন্য পূর্ববঙ্গে আগমনের পরেই বাংলাদেশের গ্রামের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটে। রবীন্দ্রনাথ যে গ্রামীণ জীবনকে দেখেছেন পরবর্তীকালে তাই গ্রাম উন্নয়ন ভাবনায় তাঁকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। জমিদারীর কাজের জন্য রবীন্দ্রনাথকে অনেক জায়গায় ঘুরতে হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি নদীপথে যাত্রা করতেন এবং সেই যাত্রার ফলে গ্রামীণ জীবনাচরণ, রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহারসহ বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক সমস্যার সাথেও পরিচিত হন।

রবীন্দ্রনাথের পলস্নী বিষয়ক চিন্তা ও পরিকল্পনা প্রথম তাত্ত্বিক রূপ পেল ১৯০৪ সালে লেখা স্বদেশী সমাজ, পরবর্তীতে লেখা 'পলস্নী প্রকৃতি' প্রবন্ধে। কিন্তু কবির পলস্নী উন্নয়ন ও স্বদেশী সমাজ গঠনে চিন্তা সমকালীন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে সারা জাগাতে পারেনি। জাতীয়তাবাদের রাজনীতি সামন্ত মধ্যবিত্ত নির্ভরতা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন গ্রাম উন্নয়ন এবং দুস্থ অবহেলিত কৃষক শ্রেণির উন্নতির গুরুত্ব স্বদেশিকতা পটভূমিতে ভদ্রলোকদের বুঝিয়ে দিতে। ১৯০৭ সালে পাবনায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে তাঁর পলস্নী উন্নয়ন পরিকল্পনাকেই মূখ্য বিষয় হিসেবে তুলে ধরেন। যে তিনটি বিষয়ের ওপরে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন তাহলো গ্রাম পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলা, গ্রামীণ জনসমাজের সঙ্গে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিচ্ছিন্নতা দূর করা এবং গণসমাজের মধ্যে গ্রাম উন্নয়নের প্রচেষ্টাকে প্রসারিত করা। কারণ গ্রামীণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শুধু দরিদ্রই নয় তারা শতকরা আশি জনই কৃষি কাজে নিয়োজিত। তিনি রায়তদের শিক্ষিত ও শক্তিমান করে তোলার উপরেও গুরুত্ব আরোপ করেন, যাতে জমিদার জোতদার মহাজনরা তাঁদের উপর অত্যাচার চালাতে না পারেন।

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে সাহায্য সমর্থন না পাওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ যে কাজ শুরু করেছিলেন তাঁর নিজস্ব আওতায়, ক্রমে তিনি তার বিস্তার ঘটাতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথের যে-সব কাজে অংশ নিয়েছিলেন তার মধ্যে ছিল প্রাথমিক জনশিক্ষা সহ শিক্ষা কার্যক্রম বিস্তার, চিকিৎসা দান, পূর্তকর্ম যেমন কূপ খনন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, জঙ্গল পরিষ্কার, ডোবা-পুকুর সংস্কার ইত্যাদি, ঋণদায় থেকে কৃষকদের রক্ষা করা এবং অভ্যন্তরীণ সালিস-বিচার। তাই দেখা যায় দুই শতাধিক অবৈতনিক নিম্ন-প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে নিরক্ষরতা দূর করা তথা জনশিক্ষার কাজ শুরু হয়ে গেছে। ছোটদের জন্য দিনে এবং বয়স্কদের জন্য রাতে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হলো। গ্রামের লোকদের নিজেদের চিকিৎসার ব্যাপারে খরচ করার সামর্থ্য ছিল না। সেজন্য গ্রামের মানুষ সমবায় সমিতির সদস্য হয়ে চিকিৎসার সুযোগ পেল। পতিসরে গঠিত হলো হিতৈষী সভা। সমিতির সদস্যদের অর্থে একজন কম্পাউন্ডার রাখা হলো এবং বিনামূল্যে ঔষধ দেবার ব্যবস্থা ছিল। রবীন্দ্রনাথের পলস্নী পুনর্গঠন কর্মসূচীর মূল কথা ছিল সমবায় নীতির সর্বজনীন ও সুষ্ঠু প্রয়োগ। এ সম্পর্কিত বক্তব্যে তাঁর অর্থনৈতিক চিন্তারও আভাস মেলে। রবীন্দ্রনাথ বলতে চান, সমবায় প্রথার মধ্যে দিয়ে বড় পুঁজি এককভাবে গড়ে উঠতে পারবে না। এর ফলে সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা পাবে। তিনি চাষীকে সমবায়ের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চেয়েছেন, সমবায় ব্যাংকের সাহায্যে চাষীর ঋণভার কমাতে বা মোচন করার দিকে নজর দিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথের পলস্নী উন্নয়ন ও পলস্নীসমাজ গঠনের চেষ্টায় কৃষি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা ছিল একটি অসাধারণ চিন্তা। সম্ভবত ১৯০৫ সালের মাঝামাঝি বা কয়েক মাস আগে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। কৃষকদের মধ্যে এই ব্যাংক এতোই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, তাঁদের ঋণের চাহিদা মিটানো স্বল্পশক্তির এ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সমস্যার সমাধান কিছুটা ঘটে পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারের টাকা কৃষি ব্যাংকে জমা হওয়ার পর। টাকার পরিমাণ যাই হোক মূলধন পেয়ে ব্যাংক স্বচ্ছল হয়ে ওঠে। কৃষি ব্যাংকের প্রভাব কালীগ্রাম পরগনায় এতোটাই ছড়িয়ে পড়ে যে সেখান থেকে মহাজনদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হয়। রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংক চলেছিল কুড়ি বছর ধরে। কৃষি ব্যাংকের কাজ কিন্তু বন্ধ হয়ে গেল যখন সরকার কর্তৃক গ্রাম্য ঋণ সংক্রান্ত আইন প্রবর্তন করা হলো। প্রজাদের ধার দেওয়া টাকা আদায়ের উপায় রইল না। ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন শেষ করে দিয়ে। তিনি প্রচুর টাকা লোকসান গুনলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রমথ চৌধুরীকে বারবার বলেছিলেন, তোমার ব্যাংকটাকে জয়েন্ট স্টক কোম্পানী পরিণত করে নাও। কিন্তু সে সতর্কবানী ও অনুরোধ পালিত হয়নি। ব্যাংকটিকে জয়েন্ট স্টক কোম্পানীতে পরিণত করে নিলে এই লোকসান দিতে হতো না। ব্যাংকটিও টিকে যেত। রবীন্দ্রনাথ মুসলমান দরিদ্র প্রজা এবং হিন্দু দরিদ্র প্রজা সকলের কথাই ভেবেছেন। বিশেষ করে তিনি পূর্ববঙ্গের মুসলমান কৃষকদের পক্ষে শক্ত হাতে কলম ধরেছেন বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের সময়। পূর্ববঙ্গের দরিদ্র কৃষকরা যখন বিদেশী বস্ত্র ও পণ্য বর্জন করে অতিরিক্ত দাম দিয়ে দেশি পণ্য কিনতে চায়নি, তখন তাদের উপর আক্রমণ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সে আক্রমণ সঠিক মনে করেন নি, দরিদ্র চাষীদের উপর বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন চাপিয়ে দেওয়া পছন্দ করেননি। পূর্ববঙ্গের কৃষকরা বয়কট আন্দোলনে যোগ না দিলে যখন বর্ণহিন্দু নেতারা মুসলমান কৃষকদের ভুল বুঝেন, রবীন্দ্রনাথ তখন দরিদ্র কৃষক তথা মুসলমান কৃষকদের বয়কটে যোগদান না করার পক্ষে লিখতে শুরু করলেন। রবীন্দ্রনাথের জন্য সেটি ছিল যুক্তিপূর্ণ এবং দুঃসাহসী কর্ম। পলস্নীর উন্নয়নের জন্য, কৃষকের জন্য, কৃষকের উন্নয়নে আধুনিক চাষাবাদ প্রবর্তনের জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তারই একটা স্বারক পতিসরে ট্রাক্টরের ফলক। পতিসরের প্রথম ট্রাক্টরটি চালিয়েছিলেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে। তিনি ১৯০৫ সালে পতিসরে প্রতিষ্ঠা করেন কালীগ্রাম কৃষি ব্যাংক।

জমিদারী ব্যবস্থার সাথে সরাসরি যুক্ত হবার ফলেই রবীন্দ্রনাথ পলস্নীসমাজের একদিকে সাধারণ মানুষের দুঃখদৈন্য যথেষ্ট পরিমাণে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই দুঃখদৈন্য যথেষ্ট স্বভাবতই তাঁর স্পর্শকাতর ও দরদী মনকে বিশেষভাবে বিচলিত ও অভিভূত করেছিল। জমিদারদের শোষক চরিত্র, তাদরে প্রভুত্ববাদী অনাচারী স্বভাব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অজানা ছিল না। নিজে জমিদার হয়েও জমিদারদের চিহ্নিত করেছেন 'জমির জোক' পরাশ্রিত জীব' বলে, প্রজারা যাঁদের অন্ন জোগায় আর আমলারা সে অন্ন যাঁদের মুখে তুলে দেয়। যাঁরা বীর্যের দ্বারা বিলাসের অধিকার লাভ করে। কিন্তু তিনি ছিলেন বাস্তববাদী। জমিদারীকে যেমন তিনি পদ্মা-যমুনা-আত্রাই নদীতে ভাসিয়ে দিতে পারেন না, তেমনি খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রেও কঠোর হতে পারেন। কৃষকদের দুর্দিনে আবার খাজনা মওকুব করেও দেন। ঠিক তেমনি প্রশয় দেওয়া হয় না আমলা-কর্মচারীদের অত্যাচারকে। ন্যায় ও কর্তব্যবোধ রবীন্দ্রনাথের জমিদারী পরিচালনার দিকদর্শন হয়ে ওঠে। জমিদারী নিয়ে সম্পূর্ণ খেয়ালখুশি মতো চলার অবস্থায় তিনি ছিলেন না। কারণ জমিদারী মালিক তিনি একা নন, তদুপরি জমিদারীর খাজনার আয় দিয়ে চলে ঠাকুর পরিবারের গোটা সংসার। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি মানবিক গুণাবলী হারান নি। দরিদ্র কৃষকদের সমস্যার কথা ভুলে থাকতে পারেন নি। ভাবতে হয়েছে তাঁদের কল্যাণের কথা।

মানুষের সঙ্গে মানুষের অন্তরের যোগসাধনই রবীন্দ্র গ্রাম উন্নয়ন ও শিক্ষা চিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। পলস্নী শিক্ষার মাধ্যমে তিনি প্রধানত সহযোগিতার সভ্য নীতিটাকেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন মাতৃভূমির যথার্থ স্বরূপ গ্রামের মধ্যেই। তাই তিনি পলস্নীতেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন ভারতীয় আদর্শের মূল সূত্রটি। পলস্নীর মানুষকে মানবিক মূল্যবোধে জাগ্রত করাই তাঁর পলস্নী শিক্ষার প্রধান কথা। এখনও তাঁর সেই চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি, বরং তা আধুনিকতা লাভ করেছে। এ কথা গভীরভাবে সত্য যে, শিক্ষাকে স্বয়ম্ভর করে সর্বাঙ্গীণ গ্রাম উন্নয়নের প্রয়াস আধুনিক যুগে ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই প্রথম প্রতিভাত হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<48644 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1