শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আসাদ চৌধুরী চোখের দোষে কাতর এক কবি

ড. ফজলুল হক সৈকত
  ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

এই পৃথিবী এক অপার সৌন্দযের্র আধার। অঁাধার পেরিয়ে আলোর পথে পাড়ি দেয়ার জন্য এখানে আছে অশেষ পথ ও মত। মতের ভিন্নতায় যেমন মানুষের মৌলিকত্ব, তেমনই জীবনকে উপভোগ আর চোখে দেখার প্রাতিস্বিকতায় মানুষের ব্যক্তিতা তৈরি হয় আলাদা আলাদা কল্পনা ও চিন্তার উঠোনে। বঁাধা-পড়ার আর বঁাধন ছেঁড়ার খেলায় আমরা যে মত্ত, তার শক্তি ও সৌন্দযর্ ধরা পড়ে সৃজনশীলতা আর প্রকাশের ভারের ভেতর। প্রোফেট, পোয়েটরা মানুষের জীবনের অথর্ ও অনথের্র মধ্যে একটা চমৎকার সম্পকর্ স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। বতর্মানে নবী না থাকলেও কবিরা ভাবনার ও পরিকল্পনার চরকা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রকৃতি আর মানুষের, মানুষের আর ¯্রষ্টার সম্বন্ধ বিষয়ে চিন্তার ধারাভাষ্য বিবরণে।

প্রথমে সৌন্দযর্ ও রহস্যÑ এই পৃথিবীর অসীম অব্যাখ্যায় অধ্যায়সমূহ দেখে কবিরা বিমুগ্ধ হন। তারপর তারা সাজাতে থাকেন শব্দের মালা; চালাতে থাকেন কল্পনার শাবল ও হাতুড়ি। এভাবে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করে ব্যক্তি, তার এক বিশেষ কাঠামোকে আমরা নাম দিয়েছে কবিতা। এমনই এক কল্পনা-বিবরণকারী বাঙালি কবি আসাদ চৌধুরী (জন্ম : উলানিয়া, বরিশাল, ১১ ফেব্রæয়ারি ১৯৪৩)। জীবনকে রঙিন জানালায় দঁাড়িয়ে বণির্ল আকাশের তারায় তারায় ভরিয়ে তোলার আনন্দে বিভোর এই কবি। মুখে মিষ্টি পানমাখা হাসি আর বুকে মানুষের জন্য নিভের্দ্য ভালোবাসা নিয়ে কবিতার সঙ্গে তার প্রতিদিনের সংসার। কিন্তু কবিতাকে তিনি সংসারের বিষয় করে তোলেননি। সুন্দরের মিনার ও মন্দির ভেবেছেন কবিতাকে। তাবৎ সৌন্দযর্ কীভাবে যে তার কবিতা-কঁাথায় মাথা মুড়ি দিয়ে শীতল পাটিতে ঘুমিয়ে থাকে, অনুভবের প্রখরতা না থাকলে তা বুঝে ওঠা আমাদের আদতেই কঠিন। কবি আসাদ চৌধুরী একজন পরিব্রাজকও বটে। সৌন্দযের্র টানে ছুটছেন দেশ-দেশান্তর। যাপন করে চলেছেন শত-সহ¯্র আচ্ছন্ন কবিতা-প্রহর। শব্দের রহস্য আর জীবনের বিচিত্র রসিকতাকে লালন করে চলেছেন ‘তবক দেওয়া পান’-এর কবি আসাদ চৌধুরী।

¯্রষ্টা-বন্দনা, ধমির্চন্তা ও নারীভাবনা বিষয়ে একটি অভিজ্ঞতার বণর্না দিয়ে বতর্মান আলোচনাটি শুরু করতে চাই। ২০০৯ সালের কথা। ঢাকার বারিধারায় ক্যামব্রিয়ান কলেজ আয়োজন করেছে ‘বিশ^ কবিতা দিবস’ উপলক্ষে আলোচনা সভার। সঞ্চালক সুব্রত কুমার দাস, সভাপতি করুণাময় গোস্বামী, প্রধান অতিথি কবি আসাদ চৌধুরী, বিশেষ অতিথি ড. আকিমুন রহমান এবং প্রধান আলোচক বতর্মান প্রাবন্ধিক। সদাহাস্য আসাদ চৌধুরী নানান কথা প্রসঙ্গে, বিশেষত কবিতা ও শিল্পচচার্ এবং ঈশ^রভাবনা প্রসঙ্গে কী যেন কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ বললেনÑ ‘এই দেখুন না, আমার স্ত্রী নিয়মিত নামাজ পড়েন, তাহাজ্জতের নামাজও পড়েন, কিন্তু কী ভাগ্য তার কোনো দঁাড়ি উঠলো না; আর আমি নামাজই পড়ি না, কিন্তু কী কপাল আমার দঁাড়ি উঠে গেল!’Ñ এই কথায় রসিকতা আছে বটে। কিন্তু পরে আমি ভেবেছিÑ নারীর প্রতি কি ¯্রষ্টার কোনো কাপর্ণ্য আর পুরুষের প্রতি কোনো করুণা আছে? তা না হলে পৃথিবীতে নারী নবী কিংবা রসুল প্রেরিত হয়নি কেন? যাই হোক, কবি আসাদ চৌধুরী ¯্রষ্টার প্রতি একটা সরল ধারণা নিশ্চয় পোষণ করেন। সম্ভবত নিয়তিবাদে তার সহজ সমথর্ন। তিনি লিখেছেনÑ ‘তোমার অমল পঙ্ক্তি ডান থেকে শুরু।’ তারপর বলেছেনÑ

যারা বিশ^াস এনেছে

ক’রে থাকে সৎকমর্

সত্য আর ধৈযর্ ধারণের কথা নিজে মানে,

সারাক্ষণ বলা-কওয়া করে; তারা নয়,

তুমিই তো বলেছ,

তুমি আছ

ধৈযর্শীলদের সঙ্গে,

তুমি আছ, তুমি থাকো

তাহলে কিসের ভয়?

(‘তাহলে কিসের ভয়’ : কবিতা নিবাির্চতা১)

আসাদ চৌধুরী আনন্দলোকের কবি। যাপিত-জীবনের নানান প্রসঙ্গ, জটিলতা, সংকট ও প্রতিক‚লতাকে তিনি অনুভব করেছেন আনন্দের মোড়কে। নিজস্ব-বিবরে সৃষ্টি করছেন আপন-আনন্দধারা। যেমন একটি কবিতার অংশ-বিশেষÑ ‘বাসর ঘরে আমাদের জন্য/ না ছিল বালিশ, না মশারি/ ঠাট্টার আত্মীয়রা থাকলে যা হয়।’ জীবনের তিক্ততাকে তিনি পাশ কাটাতে চান আপাত পলায়নের প্রয়াসের ভেতর দিয়ে। নিজের অক্ষমতাকে ঢাকতে চান চাতুরী দিয়ে। আত্ম-পরিক্রমায় জানান এই কবিÑ ‘আমার গালে পান/ বরং তোমরাই বলো, আমি শুনি।’ মানুষে মানুষে যে বিভেদ পৃথিবীব্যাপীÑ সাদা আর কালো, মুসলিম আর হিন্দু, মুসলিম আর বৌদ্ধ, ইহুদি ও মুসলিমÑ এই যে দ্ব›দ্ব ও সংঘাত, এসবের সমাপ্তি কোথায়? মানুষের প্রবীণতায় কী-ই বা প্রভেদ? সাদা চুলের মানুষ মাত্রেই তো যাওয়ার জন্য প্রস্তুত জনতাÑ এই ধারণা আসাদ চৌধুরীর আছে। তিনি উপলব্ধি করেছেন ভাঙা-গড়ার নিত্য খেলা। মানব-সভ্যতার সরল ইতিহাসও তিনি পাঠ করেছেন প্রতিনিয়ত। তাই লিখতে পেরেছেন এইসব প্রৌঢ়োক্তিÑ

শুধু লাউ ডগা এগিয়ে যাচ্ছে লকলক করে।

নতুন মাটির জন্য ভাঙছে জনপদ।

শস্য ও সম্পদ, গুবাক তরুর সারি

আর স্বপ্ন হারানো গাঙ্-ভাঙা মানুষেরা

অসহায় দৃষ্টি মেলেছে গগনে।

ঐ তো পাখির ঠেঁাটে খড়,

নাবিকেরা কী সিদ্ধান্ত নেবে, কে জানে।

(‘নদীর ভাঙন আর পাখির ঠেঁাটে খড়’)

‘কোথায় ডাবের জল? কই হাত-পাখার বাতাস?’Ñ এইসব হাতাশা লালন করেন কবি আসাদ চৌধুরী। দু-চোখ ভরে দেখেন নগরায়ণ, প্রযুক্তির প্রবল প্রভাব, লৌকিকতার বিদায়-সংকেত। অভিমান-ভরা বুক তার। নিজের প্রতিবিম্বেও খেঁাজেন রূপান্তরের বারতা; পরিবতের্নর বিরূপ বাতাস। কী এক নীরব কষ্টে পার করেন দিন ও রাত্রি। আর ভাবেনÑ ‘এত মানুষের ভিড়ে মানুষ কোথায়?’ জীবনের অভিযাত্রায় তিনি যেন এক উত্তরবিহীন পথিক। শৈশব-কৈশোরের হাজারো স্মৃতি, কত শত সঙ্গীর গায়ের গন্ধ পেছনে ফেলে তিনি যাচ্ছেন কোথায়, তা-ও জানেন না। কেন পার হচ্ছেন এই জটিল পথ, সে-কথাও জানা নেই এক বিন্দু তার। বলছেন সে-কথাÑ ‘পাথর বেঁধে নায়ে/ ডাইনে মুখ, যাচ্ছি কেবল বঁায়ে!/ ভাসতে থাকি ¯্রােতে।’ আন্তজাির্তকতা, ‘তৃতীয় বিশে^র বিপুল আশ^াস’, দুভার্গা দেশ, অদৃষ্টবাদী জনতা, বায়ান্ন ও একাত্তরের অগণন গবর্, অধিকার ও মযার্দার প্রশ্নে ম্যান্ডেলার আফ্রিকা ও বাংলাদেশের অভিন্নতাÑ অতঃপর স্বপ্নবিভোরতাÑ আশাবাদ।Ñ এই তো মানব জীবন! আসাদের চোখ অন্তত সেটুকুই দেখে। চোখের দোষে কাতর তিনি। তাহলে কি সত্যিই আমরা, মাইকেল মধুসূদনের কথায়, ‘আশার ছলনে ভুলি’?

স্রোতবাহী নদী ও লোকায়ত জীবন আসাদ চৌধুরীর কবিতায় যেন স্বপ্নের জোয়ার হয়ে হাজির থাকে সবর্ক্ষণ। নদীর তীরে তৈরি-হওয়া তার জীবনে কত যে স্মৃতি, তার সীমানা জানা নেই কবির। শৈশবের কীতর্নখোলাকে ঘিরে বেড়ে উঠেছে কত প্রাণ, তার হিসেব তিনি তুলে ধরেন। বরিশালের ঐতিহ্য ও অহংকারের কথা সাজিয়ে তোলেন পরম মমতায়। আহসান হাবীবের শঙ্করপাশা, রূপসী বাংলার ধূসর পাÐুলিপি, মাধবপাশার দীঘি, ‘আলতাফ মাহমুদের চঞ্চল আঙুল’, ‘আমি কি ভুলিতে পারি’র অমর সুরধারা, কমলের চোখÑ কিংবদন্তি কিংবা সাহসী পুরুষের জন্য প্রাথর্না; কবিতার আর শিল্পের জন্য এক কবির প্রবল হাহাকার, ‘বিবি পুকুরের শীণর্ দেহ’, বিজয় গুপ্তের ‘গৈ-গেরাম’ আর শের-ই বাংলার অমিত প্রভাবের স্মৃতিতে অ¤øান আসাদ চৌধুরীর কবিসত্তা। তিনি লেখেনÑ “সুদের শিকার এক চাষি বউর কান্না শুনে-শুনে/ বিড়-বিড় করে এক খোকা, চাখারের,/ ‘মা-গো, আমি তোর অশ্রæ মুছে দেব’।” (‘কীতর্নখোলার চোখে স্বপ্নের জোয়ার’) আসাদের দুঃখ, কেন ‘স্মৃতিতে কাতর নয় তরুণ প্রজন্ম।’ তবে কি সমকাল ও প্রযুক্তি-নিভর্র এই জেনারেশন উড্ডয়নের পরিবতের্ অবতরণের সুতোয় বঁাধা পড়েছে?

চলতি পথে দেখা-মানুষের ভেতর কবি চৌধুরী চাতুযর্ লক্ষ্য করেছেন। ‘আসল কথাটি এড়িয়ে/ শুধুই ধানাই-পানাই/ শুধুই শীবের গীত।’Ñ এই হলো তার চোখে দেখা মানব-প্রবণতা। মানুষ চিনতে চিনতে অগ্রসর হয়েছেন কবি আসাদ চৌধুরী। মানুষের মধ্যেই যাপন করে চলেছেন জীবন। কিন্তু তার গোপন অভিমানেরও যেন শেষ নেই। ‘এরপর যদি’ শিরোনামের এক কবিতায় লিখেছেনÑ ‘এরপর দ্যাখা হলে/ মানুষের কপটতা নিয়ে আর টু-শব্দ করব না।’

“ক’ফেঁাটা চোখের জল” মাকার্ প্রেম-ভাবনায় বিশ^াসী নন কবি আসাদ চৌধুরী। তিনি মনে করেন প্রেমে কোনো স্থিতি নেই। চঞ্চলতা এবং পলায়নপরতা প্রেমের প্রধান প্রবণতা। প্রেমে বিদায় সত্য। বিদায়ী প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য আসাদের পরামশর্ এরকমÑ ‘মনে রেখো,/ তোমার কোমল ছায়াটিকে/ অন্ধকারে আমি শুধু চিনি।’ প্রেমের গল্প সত্যিই যেন অমোঘ কোনো অপারগতায় গঁাথা। অবজ্ঞার হুল প্রেমের অবিরল বারতা। দিগন্ত কখন, কীভাবে যেন চৌকির সীমানায় মিলায়। ‘আমার একান্ত আপন আকাশখানি/ দ্যাখো, দ্যাখো, কঁাথায় মিশেছে।’ অবশেষে আমরা ‘বেদনা তুলে নিই ঠেঁাটে।’ মানুষের অবস্থা ও অবস্থানের সরল পাঠ নিতে দেখি এই কবিকে। তিনি প্রেমিকার ‘চোখ’কে বলেছেন ‘অভিধান’। তারপরও প্রেমিকারা যে ‘করুণা শব্দের অথর্’ জানে না, সে বিষয়ে তিনি সতকর্ ছিলেন। তার অনুভবকে ছঁুয়ে দেখার জন্য প্রেম-বিষয়ক অন্তত দুটি কবিতা থেকে পাঠ নিচ্ছিÑ

তুমি তো ডেকেছিলে

ফুলের নিঃশ^াসে;

সরল বিশ^াসে

যায়নি কাপুরুষ।

(‘অক্ষমতা’)

ফুল কুড়াতে নয় গো বালা

প্রেম কুড়াতে যাই,

আছাড়-বিছাড় খাই।

(‘প্রেম কুড়াতে যাই’)

অঁাটোসঁাটো জীবন-যাত্রায় অন্যের প্রয়োজনে নিজের ভুবন তৈরির সময়ও সমপর্ণ করি আমরা। নিজের জগতে প্রবেশের প্র্যাকটিক্যালি কোনো অবসর নেই আমাদের। ‘ছক পেরোতে পেরোতে স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেল।’ আসাদের কবিতায় আছে লোক-বিশ^াস। ‘আহ, আমার গায়ে কেন,/ প্রজাপতি তুমি অন্য কোথাও গিয়ে বসো’, ‘আমার জানালায়/ শুধু একটি শালিক’।Ñ এইসব গ্রামীণ ধারণার কথা লিখেছেন তিনি। তার কবিতায় আছে বঞ্চিতের জন্য কথামালা। আছে প্রবল আত্মোপলব্ধি। ‘আমি কখনও ঠিকভাবে আমাকে দেখিনি।’, ‘ডাঙায় আমি হঁাটতে ভুলে গেছি।’ আত্ম-বিবরণে তিনি খুব খোলামেলাÑ ‘আজীবন হঁাটতে গিয়ে উড়লাম,/ আর আমার নখ গেল ভেঙে।’ তবে, কিছু আশাবাদের কথাও লালন করেন আসাদ চৌধুরী। যাপন করেন স্বপ্ন-কাতরতা। আশা করেন ‘প্রগাঢ় চুম্বনে মেঘটা কেটে যাক’। যেন এই ভরসায় বলতে পারেনÑ ‘চোখের কোল থেকে মোছো তো দুখটুকু’। ‘পুরোনো দীঘর্শ^াস’ মুছে ক্লান্তিমোচনের শান্তি প্রতিষ্ঠা-চিন্তায় তিনি অগ্রগামি। ‘অডাসিটি অফ হোপ’-এর জন্য বারাক ওবামা দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। আমাদের তো স্বপ্ন দেখার সাধও থাকে না। স্বপ্ন আর বাস্তবতা আলাদা। যেমন প্রেম ও দাম্পত্য। ‘ঘরে অভাব, বিশ্রী স্বভাব,/ এ-সব টেনে আনলে!/ স্বপ্নটাই তো ভালো ছিল/ মিছিমিছি ভাঙলে।’ রবিঠাকুরের মতো আসাদও কি কোনো মহামানবের জন্য প্রতীক্ষারত? তা না হলে, কাদের উদ্দেশ্যে বলছেনÑ ‘লও গো তোমরা কঠিন মালা/ ঘুচাও অন্ধকার’। আসাদ চৌধুরীর কবিতা থেকে আরো খানিকটা উদ্ধৃতি দেয়া যাকÑ

স্বপ্ন কি সাদা-কালো?

সকলেই আমার মতন

সাদা-কালো স্বপ্ন দেখে থাকেন?

তবু স্বপ্ন বললে, অন্তত আমার,

লোকে কেন রঙিন ভাবেন?

সত্যি, আমি কোনো রঙিন স্বপ্ন

এ পযর্ন্ত দেখিনি।

(‘আমার সাদা-কালো স্বপ্নগুলো’)

কিন্তু অগ্রগমণ কি কোনো খেলনা-কথা? মানুষ কি এগিয়েছে সত্যি সত্যি? আমরা বড় অসহায়। ‘শতর্ আরোপ করার ক্ষমতা’ও নেই আমাদের। প্রি-পেইড কলের কৌশলে আটকে পড়েছি যেন। প্রাপ্তির সাহস এবং যোগ্যতাও হারিয়েছি। আসাদের কবিতায় তার কিছু কথা লেখা আছেÑ

এতো ক’রে ক’রে

সেই চালতা-মাখা দুপুরগুলো পেরিয়ে

লেখাপড়াময় কেরোসিনের

আলো-ঘেরা সন্ধ্যাগুলো পেরিয়ে

অরণ্যের গন্ধে ভেজা কঁাপা-কঁাপা প্রহরগুলো থেকে

এক পা-ও নড়তে পারলাম না যে।

যেখানে ছিলাম

সেখানেই আছি।

যেখানে আছি

ঠিক সেখানেই তো ছিলাম।

(‘যেখানে আছি’)

উন্নয়ন কি শুধু উঁচু উঁচু দালান আর উড়ালসেতু? প্রশস্ত রাস্তা কিংবা বিদ্যুতের ঘাটতিপূরণ? নারীরা মযার্দা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা, যুব-সমাজের অস্থিরতা-উত্তরণের আভাস সৃষ্টি কি প্রয়োজন নেই? ‘বস্তি’ ও ‘বসতি’র ভেদ-বিভেদ কি আমরা আজও বুঝতে শিখেছি? মানুষের পাথর্ক্য কি কেবল ক্লোজ অ্যান্ড রিল্যাক্সড সম্পকের্? শহরের জীবনে আমরা তো কতকিছুই মেনে নিইÑ মানিয়ে নিই। আসাদের একটা বিবরণ এখানে তুলে ধরতে চাই, আমাদের নাগরিক মন ও চিন্তাকে প্রকাশ করার অজুহাতেÑ

সামনে-পেছনে বস্তি

এখানে আটতলা ভবন কি মানায়?

মানায় না অনেক কিছুই

সাদা শাড়ি-পরা নতুন বৌ

গালে-হাত-দিয়ে ব’সে-থাকা

টগবগে যুবকের ঝিমুনি...

(‘অনেক কিছুই মানায় না’)

অজির্ত অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধির গাঢ়তা থেকে তার কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে কিছু পৌঢ়োক্তি। যেমনÑ ‘ব্যথর্তা নতুন কিছু নয়’, ‘এড়াতে চাইলেই কি সব এড়ানো যায়?’ নিজেকে জানার তো কোনো শেষরেখা নেই। কবিরাও আত্ম-আবিষ্কারের নেশায় মত্ত থাকেন। আর এক ধরনের ভুল বোঝাবুঝি এবং আত্ম-অহমিকায় আচ্ছন্ন থাকে মানুষের মন। আসাদ চৌধুরী তা টের পেয়েছেন। খামখেয়ালিময় এই জীবনের অন্ধকারের অন্বেষা আর আলোর ভুবনে পরিভ্রমণ তো আমাদের সমাপ্ত হলো না। এই রকম এক অনুভবে কবি বলছেনÑ

তোমার অতো গরজ দেখে ভুল বুঝেছি।

নিজের মেকি যোগ্যতাকে পাহাড় ভেবে তুষ্ট ছিলাম,

রুষ্ট ছিলাম চারদিকের এই ঈষার্ দেখে,

সবর্নাশের শেষ গেলাশে হাত রেখেছি যেইÑ

সঙ্গীরা সব হাওয়ায় মিলায়

তুমিও আর নেই।

(‘আমি তোমার কতোখানি অঁাধার’)

বাংলা সিনেমার প্রখ্যাত অভিনেতা আনোয়ার হোসেন একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেনÑ ‘আমি যাবার জন্য প্রস্তুত হতে পারলাম না। বড় মায়া লাগে এই পৃথিবীর জন্য। আমার মা, আমার বড় ভাই তো বিদায়ের জন্য প্রস্তুত। আমি তো পারলাম না রেডি হতে!’ আসাদ চৌধুরী জানেন, ‘ঘরে ফেরা সোজা নয়’। তবু মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত তিনি। কোনো আলসেমি, ভীতি কিংবা গড়িমসি নেই। ‘আমি তো কাফন প’রেই ব’সে আছি।/ ডাক এলেই যাব। ঠিকই যাব।’ বেঁচে আছেন কবি আসাদ চৌধুরী। বেঁচে আছি আমরাÑ টিকে-থাকার সংগ্রামে প্রতিদিন লিপ্ত। ‘আগলে রাখি স্বপ্ন, ঘরে হাজার অভাব ঘোরে।/ স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন আজও দিইনি বিক্রি করে।’ অতঃপর, কী এক ‘গভীর গভীরতর অসুখে’ যেন নিমজ্জিত আমরা!Ñ

তুমিই আমার আসল এবং

লোভনীয় সুদ,

তুমিই আমার সকল ব্যারাম

আর তুমিই ওষুধ।

(‘খঁাটি কথা’)

Ñ কে এই ‘তুমি’? কোনো নারী, কবি-কল্পনায়? না-কি বিধাতা? সে-কথা জানেন কেবল কবি আসাদ চৌধুরী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<36691 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1