শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
জন্মদিনের শুভেচ্ছা

‘বাতাস যেমন পরিচিত’ তিনি আসাদ চৌধুরী আতা সরকার

কবি আসাদ চৌধুরী যখন মঞ্চে এসে দঁাড়ান, দরাজ কণ্ঠে উচ্চারণ করেন তারই পঙ্ক্তিমালা তখন দশর্ক-শ্রোতা উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। তাদের চোখে স্বপ্ন জাগে। আসাদ চৌধুরীই মুক্তকণ্ঠে বলতে পারেন : ‘কিছু বোবা প্রাণী আছে-/মনে হয় এদেরে কিছুটা বুঝি, জানি, চিনি।/আশৈশব ঘিরে থাকা এত যে মানুষ/নিসগের্র নিয়মের পাশে চেপে দঁাড়িয়ে থাকে/শতাব্দীর অভিজ্ঞতা নিয়ে-/ কেউ চঁাদে যায়, কেউ না-খেয়ে শুকায়/এদের সম্পকের্ আমার সকল জানা/এতো হাস্যকর মনে হয় কেন?/ ফুল, পাখি, নদী, মাছ এক সব কিছুর ঊধ্বের্/এইসব মানুষের প্রতি এতো কেন আগ্রহ আমায়।’
নতুনধারা
  ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

‘লাল সবুজে ঝিলিক মারে কৃষ্ণচ‚ড়া/পাগল হয়ে ডাকতে থাকে কালো কোকিল /বাড়তে থাকে গাছের মতো শহীদ মিনার/বুকের ভিতর শেকড়গুলো আলাপ করে।’

শেকড়গুলো ছড়িয়ে পড়ে মাটির গভীরে। আত্মাকে করে তোলে মৃত্তিকাসংলগ্ন। আর ভেতর থেকে এই জনারণ্যের নগর আরহে খুঁজে পাই চেনা বাউলকে। কবি আসাদ চৌধুরী। শুনি তার কবিতায় উদাস হাওয়ার গান। ধাতব যান্ত্রব আওয়াজ ছাপিয়ে উঠে আসে আবাহমান বাংলার চিরায়ত মরিমিয়া, প্রাত্যহিকতায় ছড়াগানের সাহিত্য এমনকি মুখর মিছিলের বজ্র ¯েøাগানও।

‘হঠাও দেখা পথের মাঝে’

কবিতা কি তার প্রেম? কবিতার সঙ্গে লতায়পাতায় যারা জড়িয়ে থাকে তাদেরও তা না হলে তাদেরও আত্মীয় করে নেন কীভাবে? বঁাধেন কেমন করে আত্মার নিবিড় বন্ধনে?

বাংলা একডেমির চত্বরে যেদিন প্রথম দেখাÑ মফস্বল শহর থেকে আসা আমরা কজন কবিতায় আন্দোলনকমীর্ তাদের সঙ্গে সঙ্গে আমিও কবি আসাদ চৌধুরীর বাহুবন্ধনে চলে গেলাম। সেই সত্তর দশকের দোরগোড়ায়। তখন কবিতা ও লিটল ম্যাগাজিনের পতাকা সারা দেশে। স্বাধীন বাংলাদেশের গবির্ত পতাকার ছায়ার বাঙালির নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতি গান কবিতা নাটকের নতুন উত্থান। বিশেষ করে কবি ও কবিতার উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা।

বিশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের শক্তিমান ও প্রভাবশালী কবিদের গড়া সৌধ প্রতিষ্ঠানকে পাশ কাটিয়ে খুরধ্বনি তুলেছে ষাট দশকের তুরন্ত ও দুরন্ত তরুণ কবিদের। তারা পাঠকদের কাছে পেঁৗছে দিচ্ছেন কবিতা। সে কবিতায় কাম, ক্রোধ, ভালোবাসা, অহংকার একাকার হয়ে গিয়েছে। ‘স্বাক্ষর’-এর গভর্ থেকে বেরিয়ে আসা কবিরা মুক্তিযুদ্ধ করে ফিরেছেন। কবিতাতেও তাদের যুদ্ধের মেজাজ। প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে। জরাজীণর্ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। ইরান তুরান খেজুর চচির্ত পাকসাদবাদ সংস্কৃতির বিরুদ্ধেও। সেই উন্মাত্তাল হাওয়ায় ঝঁাকে ঝঁাকে জামিন হয়েছে তরুণতর সত্তরে কবিতা। বাংলা সাহিত্যে বিশের শতক এভাবেই কবিতায় তাৎপযর্মÐিত হয়ে ওঠে।

সত্তরের আগেই ষাটের কবিদের নাম পতাকা উড়ছে। তাদের প্রতিস্বর তরঙ্গ তুলছে। বই বেরোয়নি কারও। দু’একজন ছাড়া। যাদের বই বেরিয়েছে তাতেও লিটল ম্যাগাজিনের চারিত্র। কোনো কবির গল্পের বইও প্রতিষ্ঠানিক দাপটতার নিষিদ্ধ হয়ে আলোড়ন তুলছে।

স্বাধীন দেশে প্রথম প্রহরে কবিতার কোনো নিদির্ষ্ট গ্রন্থ নয়। বেরুনো দুজনের নিবাির্চত কবিতা। রফিক আজাদ ও আব্দুল মান্নান সৈয়দের। কোনো কবিতার বই নেই, কিন্তু বাছাই হলো নিবাির্চত কবিতা। প্রতিষ্ঠা প্রাপ্ত কবির মেজাজে।

তাদের মাঝে আসাদ চৌধুরী। লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্য কাগজ দৈনিক পত্রিকার সাময়িকী পাতাগুলো তার সদাপট উপস্থিতি। অন্যদিকে উদাও কণ্ঠে কবিতায় কঁাপাচ্ছেন মঞ্চ। একেকটি হালপ্রস্থ কঁাপিয়ে দিচ্ছে কবিতায় সনাতনী ভিত।

কঁাপাচ্ছেন বটে, কিন্তু বাংলা কবিতা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে ধারণ করে রেখেছেন পুরোপরি। চমক শব্দচয়নে উপমা নিমাের্ণ উৎপ্রেক্ষা নিক্ষপণে উচ্চারণ ভঙ্গিতে বাক্য বিন্যাসে। লোকজ ঐতিহ্যকে ছেঁকে তুলে বিশ শতকের মুক্ত দেশের অধুনা- সংস্কৃতির ছঁাচে নতুন করে নিমার্ণ করছেন। এমন কবির কাছে তরুণতর কবিতাপাগল কবিরা না ঘেঁষে পারেন! মফস্বল তরুণদের কাছে তখন তীথের্কন্দ্র বাংলা একাডেমি চত্বর। আর প্রবল স্রোতে আকষর্ণ করে কাছে টেনে নেন একজন উদার ব্যক্তিত্ব। আসাদ চৌধুরী। তার চারপাশেই ভিড়টা বেশি।

সৃজনশীল উঠতি ব্যক্তিত্বদের উন্নাসিকতার বৃত্তের বাইরে তার সরল অবস্থান। আন্তরিকতায় বুকে টনে নেন অনুজ সৃজন-ঘরানার লোকদেরÑ সে যেখানকারই হোক। তার এই গুণটি বোধ হয় জন্মাবধি। পরম ঔদাযের্ তরুণতর কবি লিখিয়ে লিটল ম্যাগাজিনগুলোর প্রশ্রয় দেন। খুঁজে পেতে খুঁত চোখে আঙুল দেখিয়ে দিয়ে খাটো করার প্রবণতা নেই। বরং খুঁজে বের করেন ভালো দিকগুলো, মুক্তকণ্ঠে সেগুলোরই প্রশংসা করে তরুণের চিত্তকে প্রসারিত করে দেন।

আজাদ চৌধুরী যদি কবি না হতেন? সাহিত্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে চাকরি না করতেন? তাহলে কী তিনি তরুণ ও তারুণ্যকে এভাবে কাছে টেনে নিতে পারতেন?

মনন ও মননে যার সবুজ ও সজীবের হাওয়া, তিনি যেখানেই থাকুন সজীব প্রাণবন্ততা তার পরিপাশ্বের্ বিরাজ করবেইÑ তা ঠেকায় কে?

যখন কলেজে শিক্ষকতা করতেনÑ ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজেÑ সে সময় জনপ্রিয় শিক্ষক। তরুণ ছাত্রদের তিনি শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন বন্ধু ও বড়ভাই। ছিলেন শব্দসৈনিক। মুক্তিযুদ্ধে। বাচিক যোদ্ধাও। দৈনিক জয়বাংলায় সাংবাদিকতা করেছেন মুক্তিযুদ্ধকালে। পরে স্বাধীন দেশে আবদুল গাফফার চৌধুরীর সম্পাদিক দৈনিক জনপদে। যুক্ত ছিলেন ভয়েজ অব জামাির্নর বাংলা বিভাগে।

রাজনীতিও করেছিলেন। কাজ করেছিলেন তৃণমূলে। কৃষক সমিতিতে। টিভির অসংখ্য অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন।

সবর্ত্র তিনি জনপ্রিয় সফল সংগঠক। তরুণদের তীথির্বন্দু। ভালোবাসার পুরুষ। যেখানেই অবস্থান করেছেন তরুণরা ঘিরে রেখেছে তাকে।

সেই কৈশোরে কবি আসাদ চৌধুরীর কমর্স্থল ছাড়াও বাসভবনে হানা দিয়েছি বারবার। কাটিয়েছি দীঘর্ সময়। আসাদ চৌধুরী ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। আলোচনা সাহিত্য থেকে ছড়িয়ে গিয়েছে বিভিন্ন প্রসঙ্গে। অপ্রসন্ন দেখিনি তাকে। তার পরিবারকে। নাগরিক জীবনের ভেতরে বসবাস করেও অনাহূত এ অতিথির এমন বিড়ম্বনায় কখনোই বিরক্তির আভাস চোখে পড়েনি। এতখানি প্রশয় দেয়ার উদারতা দেখাতে পারেন কজনা!

এ গল্প যে আমার একার একজনের তাতো নয়। কতজনের সঙ্গে এমন কত সময় দিয়েছেন তার লেখাজোখা নেই। নিজের বই বেরোয়নি। বয়সে বড়। বেরিয়েছে সতীথের্দর বই। সেই বই নিয়ে রাতে পানোৎসব ছাড়াও মাতামাতি ক’জনা করতে পারে? বইয়ের স্তূতি? কবি ও লেখক হিসেবে সতীথর্ বন্ধুদের বড় করে তোলায়? এমন পরম পুরুষ বন্ধু আসাদ চৌধুরী। লেখকদের সমবায় সমিতি গড়ে তুলে বন্ধুদের বই প্রকাশের দায়িত্বও নিতে পারেন আসাদ চৌধুরী।

এভাবেই বুঝি না তিনি পথের মানুষ হয়েও প্রাণের মানুষ হয়ে উঠতে পারেন সবাকার।

তাই একজন আসাদ চৌধুরীর ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয় : ‘প্রয়োজনের রূঢ় গদ্যে/নেই রে স্মৃতির ধুলো।’

এই তো ভেসে উঠছে তার সদা হাস্যমুখ। স্মৃতির পর স্মৃতি। এমনকি তার কবিতাগুলোও।

তাকে কেন্দ্র করে বই হচ্ছে, তখনি কবি আসাদ চৌধুরী নাকড়া বাজিয়ে যাচ্ছেন : ‘পথের মাঝে হঠাৎ যখন দ্যাখা/তার দুটি ঠেঁাট কঁাপলো কিছুক্ষণÑ/আমি ভাবলাম ঝরলো বুঝি প্রীতি/কঁাপলো বুঝি স্মৃতি,/নামলো বুঝি উথাল-পাতাল/সাবেক দিনের গীতি।’

‘গোলাপের কঁাধে হাত রেখে’

‘শস্যের পথরেখা ধরে’

মানুষের প্রতি মমত্ব আসাদ চৌধুরীকে টেনে নিয়েছিল বাম রাজনীতির ধারায়। মুক্তিযুদ্ধে। চ‚ড়ান্ত পযাের্য় কবিতায়। কবি পরিচয় বা কবিবৃত্তির জন্য নয়, মানুষের ভিড়ে মিশে যাওয়ার ডুব দেয়ার ভালোবাসার গভীরতায় পেঁৗছে যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে। হাতিয়ার হিসেবেও।

রাজনৈতিক চৈতন্য ও বৈদগ্ধ তার সত্তায় মিশে আছে। কবিতা লেখার শুরুতেই সে বোধ কাজ করেছে তার ভেতরে। আসাদ চৌধুরীর নিজের কথা-কবিতা লেখার শুরুটার বণর্নায় : “জনাব সালাহউদ্দিন চৌধুরী আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় হান্টু ভাই, সাপ্তাহিক চিত্রাকাশ-এ আমার প্রথম লেখাটি ছাপেন, পঞ্চাশের শেষের দিকে, জনাব আজাদ সুলতান তাগিদ দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন সদ্য নিহত প্যাট্রিস লুমুম্বার প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি ‘ইতিহাসের আরেক নায়ক’ শ্রদ্ধেয় রণেশ দাশগুপ্ত সেদিনই লেখাটি পকেটে করে নিলেন, পরদিন দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পৃষ্ঠায় নয়, সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় ছেপে দিলেন, কৃতজ্ঞতা জানানোর যোগ্য শব্দ আমি এখনও খুঁজে পাইনি। আর কবি রফিক আজাদ পিতৃদত্ত নামটি কেটে-ছেঁটে দিলেন। ‘স্বাক্ষর’-এ। এখন তার দেয়া নামেই আমি পরিচিত।”

সাহিত্যে আসাদ চৌধুরীর এই আগমন জনমানুষের মুক্তি চেতনায় ঋদ্ধ। এদেশের সবার্ধুনিক কবিতা-চচার্র সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু আধুনিকতা ও সমকালীনতায় তিনি নিজেকে বৃত্তাবদ্ধ করেননি, তার সতীথের্দর মননের থেকে তিনি ভিন্নতার গÐি তৈরি করেন যাতে রয়েছে ঐতিহ্য অনুরাগ। গ্রামীণ জনপদের লোকজ উপকরণ, ছড়াগানের মাধুযর্, বাউলের উদাস সুর, ভাটিয়ালির টান, তার সঙ্গে মিশেছে দ্রোহ ও বিপ্লবের মহামন্ত্র। প্রাচীন প্রবাদ, আদি বাক-প্রণালী, শাস্ত্র-ভাষার সমান্তরাল প্রয়োগ করেছেন আধুনিক বাকধারা উপমা উৎপ্রেক্ষা। এ থেকে সৃষ্টি হয়েছে স্বতঃউৎসারিত ব্যঞ্জনা।

কবি আসাদ চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তবক দেওয়া পান’ প্রকাশিত হয় তার কবিতা লেখার পরিণত বয়সেই। ১৯৭৫-এর শেষে। স্বভাবতই সে সময় তার কবি-বন্ধু ও সতীথর্ এবং সমকালীন কবিদের মধ্যে বইটি নিয়ে উচ্ছ¡াস ছিল। কবিতার ভেতরে ঢুকে বাণীর গভীরতা ও তাৎপযর্ অšে¦ষণার চাইতে একজন ভালো মানুষ কবির প্রতি অনুরাগ আবেগটাই কাজ করেছিল বেশি। কিন্তু বাংলা কবিতায় তার নিজস্বতার সুস্পষ্ট ছাপ তিনি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থেই রেখে দেন। পযার্য়ক্রমে ধাপের পর ধাপ তিনি তার অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন।

ড. সরদার আবদুস সাত্তার বিষয়টির উপর আলোকপাত করেছেন, ‘আবেগ নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন, সহজবোধ্য শব্দের শিল্পত কারুকাজে তাকে সমৃদ্ধ করে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন এবং নিছক বণর্নার মধ্যে তাকে সীমাবদ্ধ না রেখে দশের্নর আভায় আলোকিত করে তুলতে চেয়েছেন। ষাটের নানান বিচ্যুতির ক্ষণিক জোয়ার তাকে শালীন রুচি ও স্নিগ্ধ বিশ্বাসের জগৎ থেকে ভাসিয়ে নিতে কিংবা স্বভ‚মিচ্যুত করতে পারেনি। কখনো প্রতিবাদী হয়েছেন তিনি, কখনো প্রশান্ত। কিন্তু উগ্র স্বাতন্ত্র্য অথবা নব নিরীক্ষার নামে রুচি, বিকারের প্রশ্রয় দেননি। বাঙালির শাশ্বত জীবনবোধ কখনো অন্তহির্ত হয়নি তার কবিতা থেকে। ফলে প্রকাশের প্রথম থেকেই তার কবিতা এক স্বতন্ত্র মাধুযর্ নিয়ে পাঠককে কাছে টেনেছে এবং পাঠকও দুহাত বাড়িয়ে তা গ্রহণ করেছে। সতীথর্ কবিদের মধ্যে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ নৈব্যক্তিক নিরাবেগ সমালোচকের দৃষ্টি নিয়ে আসাদ চৌধুরীর কবিতাকে বিশ্লেষণ করেছেন। ‘কী সেই আত্মতা, পাঠক অনায়াসেই তাকে নিজেই আবিষ্কার করে নিতে পারেন। ‘তবক দেওয়া পান’-এর নাম থেকেই কবি পরিকল্পিত প্রচ্ছদের সুদশর্ন জামদানি শাড়ির লাল-সবুজ কাজ থেকেই ভিতরের কবিতাগুলোর মমর্ বিচ্ছুরিত, দেশজতা। দেশজতা-এই একটি শব্দে আসাদের কবিতাকে নিহ্নিত করে নেয়া যায়। এ দেশের লোক-ঐতিহ্যকে আসাদের কবিতা খুব প্রবল উজ্জ্বলভাবে অঁাকড়ে ধরেছে, প্রাচীন লোক-সাহিত্য, বৈষ্ণব পদ, লালন শাহ থেকে আসাদ তার কবিতার উপকরণ খঁুজে পেয়েছেন। এসবের উল্লেখ তাই তার কবিতার ভিটেমাটি থেকেই (‘স্বীকারোক্তি’, ‘আয়না’, ‘বৃক্ষের স্বভাবচরিত্র’ ইত্যাদি), লোক কবিতার আরেক উপকরণ ছড়ার ব্যবহার আসাদের কবিতায় তাই পৌনঃপনিক (সন্দেহ, আয়না, ধান নিয়ে ধানাই পানাই, চোর ইত্যাদি)। আসাদের এইসব ছড়ায় অঞ্চল ভাষার বুনন তাই খুব স্বভাবশোভন; পূবর্ বাংলার লোকভাষার সঙ্গে আসাদ মিশিয়েছেন আবেগের আন্তরিক তাপ।

‘স্বপ্নটা তো ভালোই ছিলে’

স্বপ্ন কল্পনা কল্পলোক এ ঘোর জীবনের অংশ। সরে গেলেই পায়ের নিচে ঠনঠনে মাটি রূঢ় বাস্তবতা। এই দুইয়ের প্রতিযোগিতা ও দ্ব›দ্ব সৃষ্টি করে জীবনের গতিবেগ।

আসাদ চৌধুরী প্রেমকে দেখেছেন নানান মাত্রায়। বণর্না করেছেন বিবিধ ভাষায়Ñউপমা উৎপ্রেক্ষাসহ বণর্নায়, প্রবাদবাক্যে, শ্লোকে। পাশাপাশি দেখিয়েছেন জীবনের বাস্তব পিঠ। তার স্বভাবসিদ্ধতায় তিনি চযার্পদ থেকে শুরু করে সবার্ধুনিক শব্দমালা প্রয়োগ করেছেন। রক্তকষহীন শব্দ ও শব্দগুচ্ছকেও করে তুলেছেন প্রাণবন্ত রক্তগ্রাহী।

স্বপ্নটা তো ভালোই ছিলে/মিছিমিছি ভাঙলে।/শোকের হবে, দুঃখের হবে/কেমন করে জানলে?

ঘরে অভাব, বিশ্রী স্বভাব,/এসব টেনে আনলে।/স্বপ্নটাই তো ভালো ছিলে/মিছিমিছি ভাঙলে।’

স্বপ্ন তো ভাঙারই। এ ভাঙন ব্যক্তিজীবনের প্রাত্যহিকতার সাথে যুক্ত। ভাঙনের আওয়াজ তো সবর্ত্রই। সভ্যতায়। সমাজে। মূল্যবোধে। এর মধ্য দিয়েও মানুষের উত্থান ঘটে। জেগে ওঠে নতুন স্বপ্ন। স্বপ্ন-মোর নয়, বাস্তব। জীবনের নতুন সৌন্দযর্।

আসাদ চৌধুরীর কবিতায় আমাদের দেশের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় যেমন বাক্সময় হয়ে উঠেছে। তেমনি সমকালীন ভÐ রাজনীতির কুৎসিত চরিত্রকেও উন্মোচিত করতে দ্বিধান্বিত হন না।

‘কিছু কথা থেকেই যায়’

কবি আসাদ চৌধুরী যখন মঞ্চে এসে দঁাড়ান, দরাজ কণ্ঠে উচ্চারণ করেন তারই পঙ্ক্তিমালা তখন দশর্ক-শ্রোতা উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। তাদের চোখে স্বপ্ন জাগে। আসাদ চৌধুরীই মুক্তকণ্ঠে বলতে পারেন : ‘কিছু বোবা প্রাণী আছে-/মনে হয় এদেরে কিছুটা বুঝি, জানি, চিনি।/আশৈশব ঘিরে থাকা এত যে মানুষ/নিসগের্র নিয়মের পাশে চেপে দঁাড়িয়ে থাকে/শতাব্দীর অভিজ্ঞতা নিয়ে-/ কেউ চঁাদে যায়, কেউ না-খেয়ে শুকায়/এদের সম্পকের্ আমার সকল জানা/এতো হাস্যকর মনে হয় কেন?/ ফুল, পাখি, নদী, মাছ এক সব কিছুর ঊধ্বের্/এইসব মানুষের প্রতি এতো কেন আগ্রহ আমায়।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<36690 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1