শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশীয় ভাষা, পুরে কি আশা?

আলী এরশাদ
  ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

মায়ের কাছে শেখা বুলি পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর। এর চেয়ে মধুর আর কোনো ভাষা হতে পারে না।

যে যতো বড় শিক্ষিত, ডিগ্রিধারী পÐিতই হোক না কেন, মাতৃভাষা ছাড়া তার পক্ষে মনের আবেগ-অনুভ‚তিটুকু সূ²ভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই সহজ ও সাবলীলভাবে মায়ের ভাষায় তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ!’ এর অভাবে শিক্ষা পরিপুষ্টি লাভ করে না, সবার্ঙ্গীণ হয় না সবোর্পরি প্রতিদিনের জীবনযাত্রা।

তার এই উক্তিটি যে কতটুকু সত্যি তা আমরা মহাকবি মাইকেল মধুুসূদন দত্তের জীবনীতে দেখি, তিনি রাতারাতি নাম, যশ খ্যাতি অজের্নর আশায় নিজ ভাষা পরিত্যাগ করে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন, কিন্তু কিছুদিন যেতেই তার ভুল ভাঙে। তাইতো তিনি লিখেছেনÑ

‘হে বঙ্গ, ভাÐারে তব বিবিধ রতন;Ñ

তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,

পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ

পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।’

আজ যে বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি, সেই প্রাণের ভাষা, গানের ভাষার জন্য আমার ভাইয়ের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে হয়েছে রাজপথে। বিশ্বের বুকে বাংলা হচ্ছে একমাত্র ভাষা যার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে।

বতর্মানে জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৭ম, বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি লোক এ ভাষায় কথা বলে। বাংলা ভাষা বিশ্বের সবাির্ধক প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে চতুথর্ স্থান অধিকার করেছে।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়েছে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হয়। কিন্তু পাকিস্তানের দুটি অংশÑ পূবর্ পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত

বিষয়ে মৌলিক পাথর্ক্য ছিল স্পষ্ট, সাদৃশ্য যা ছিল তা হচ্ছে ধমর্।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিস পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে? বাংলা নাকি উদুর্? নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যেখানে সবর্প্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার দাবি করা হয়। উল্লেখ্য, সেই সময়ে সরকারি কাজকমর্ ছাড়াও সব ডাকটিকেট, পোস্টকাডর্, ট্রেন টিকেটে কেবলমাত্র উদুর্ এবং ইংরেজিতে লেখা থাকতো, অথচ হাস্যকর হলেও সত্য, উদুর্ ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ লোকের ভাষা। অপরদিকে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ ভাগ লোকের ভাষা ছিল বাংলা।

মাথামোটা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে বাদ দিয়ে নিজেদের আধিপাত্য বিস্তারের জন্য উদুের্ক একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।

ডিসেম্বরের শেষের দিকে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং তমদ্দুন মজলিশের আহŸায়ক অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়া এর আহŸায়ক নিযুক্ত হন ।

জানুয়ারি ১৯৪৮ পূবর্ পাকিস্তান স্টুডেন্টস লিগের জন্ম। এর প্রথম সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তখন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ।

১১ মাচর্ ১৯৪৮, এইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবিতে একটি বড় সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশ শেষে বের হওয়া মিছিলে মুসলিম লীগ সরকারের পেটোয়া পুলিশবাহিনী হামলা চালায় এবং মিছিল থেকে শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী, অলি আহাদসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি হিসেবে অভিহিত করে পূবর্ পাকিস্তানের জনগণকে ইসলামীকরণের অংশ হিসেবে উদুের্ক রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নামেন।

২১ মাচর্, ১৯৪৮, রেসকোসর্ ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূবর্ পাকিস্তান সফর উপলক্ষে আয়োজিত একটি বিশাল সমাবেশে জিন্নাহ স্পষ্ট ঘোষণা করেন যে ‘উদুর্ই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’। সমাবেশস্থলে উপস্থিত ছাত্র নেতারা ও জনতার একাংশ সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ করে ওঠে। জিন্নাহ সেই প্রতিবাদকে আমলে না নিয়ে তার বক্তব্য অব্যাহত রাখেন।

২৪ মাচর্, ১৯৪৮, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজর্ন হলে অনুষ্ঠিত সমাবতর্ন অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ‘স্টুডেন্টস রোল ইন নেশন বিল্ডিং’ শিরোনামে একটি ভাষণ প্রদান করেন। সেখানে তিনি ক্যাটেগরিক্যালি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিকে নাকচ করে দিয়ে বলেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি উদুর্, একমাত্র উদুর্ই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয়কে তুলে ধরে।

জিন্নাহর এই বক্তব্য সমাবতর্ন স্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং ছাত্ররা দঁাডিয়ে ‘নো নো’ বলে প্রতিবাদ করেন। জিন্নাহর এই বাংলাবিরোধী স্পষ্ট অবস্থানের ফলে পূবর্ পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে এবং আন্দোলন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।

২৬ মাচর্, ১৯৪৮, জিন্নাহ ছাত্র নেতারা সঙ্গে রাষ্ট্র্রাষা বিষয়ে বৈঠক করেন এবং বৈঠকে তিনি উদুের্ক রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তার অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে দেন। সেই সঙ্গে ১৫ মাচর্ স্টুডেন্টস একশন কমিটির সঙ্গে খাজা নাজিমুদ্দিনের বাংলাকে পূবর্ পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির অঙ্গীকারনামা বাতিল ঘোষণা করেন।

২৮ মাচর্, ১৯৪৮, ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে এক রেডিও ভাষণে জিন্নাহ উদুের্ক পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তার মনোভাব পুনবর্্যক্ত করেন।

৬ এপ্রিল ১৯৪৮, জিন্নাহর ঢাকা ত্যাগের পর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে ওঠে।

কবি বলেছেন, ‘নানান দেশের নানান ভাষা।

বিনে স্বদেশীয় ভাষা,

পুরে কি আশা?’

তাই তো পূবর্ পাকিস্তানের সমস্ত শ্রেণি পেশার লোক মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে দিন দিন আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে।

১৯৫২ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলন চ‚ড়ান্ত রূপ ধারণ করে।

১৮ ফেব্রæয়ারি ১৯৫২, পাকিস্তান সরকার, ২১ ফেব্রæয়ারি ডাকা সাধারণ ধমর্ঘটের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সকল সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ।

২১ ফেব্রæয়ারি ১৯৫২, সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তগর্ত) গেটের পাশে ছাত্রছাত্রীদের জমায়েত শুরু ।

সকাল ১১টা কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশ শুরু হয়।

সাধারণ ছাত্ররা স্বতঃস্ফ‚তর্ভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মিছিল নিয়ে পূবর্ বাংলা আইন পরিষদের (বতর্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তগর্ত) দিকে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। এ সময় পুলিশ লাঠিচাজর্ এবং গুলিবষর্ণ শুরু করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাস্টাসের্র ছাত্র), রফিকউদ্দিন আহমদ, এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মৃত্যুবরণ করেন। পরে হাসপাতালে আব্দুস সালাম যিনি সচিবালয়ে কমর্রত ছিলেন মৃত্যুবরণ করেন। অহিউল্লাহ নামে ৯ বছরের একটি শিশুও পুলিশের গুলিতে মারা যায়। পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের ৩ ঘণ্টাব্যাপী সংঘষর্ চলতে থাকে কিন্তু পুলিশ গুলিবষর্ণ করেও ছাত্রদের স্থানচ্যুত করতে ব্যথর্ হয়।

২২ ফেব্রæয়ারি ১৯৫২, হাজার হাজার ছাত্র জনতা সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জড়ো হতে থাকে । উপস্থিত ছাত্র-জনতা ২১ ফেব্রæয়ারি নিহতদের স্মরণে কাজর্ন হল এলাকায় একটি জানাজা আদায় করে এবং একটি শোকমিছিল বের করে। শান্তিপূণর্ মিছিলের ওপর পুলিশ পুনরায় গুলি চালালে শফিউর রহমানসহ চারজন ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। উত্তেজিত জনতা রথখোলায় অবস্থিত সরকারপক্ষীয় পত্রিকা ‘দি মনির্ং নিউজ’-এর অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। নুরুল আমিন পুলিশের পাশাপাশি আমির্ নামিয়ে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। আমির্ ও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা ভিক্টোরিয়া পাকর্ (বতর্মানে বাহাদুর শাহ পাকর্) এ জমায়েত হয় এবং সেখানে অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব বক্তব্য রাখেন ।

উপায়ন্তর না দেখে নুরুল আমিন তড়িঘড়ি করে আইন পরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়াসংক্রান্ত একটি প্রস্তাব আনেন এবং প্রস্তাবটি সবর্সম্মতভাবে পাস হয়।

সারা বাংলা অগ্নিগভের্ পরিণত হয়। ব্যাপক আন্দোলন-সংগ্রাম ও বাঙালিদের ইস্পাত কঠিন ঐক্যের কাছে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়।

অবশেষে ১৯৫৬ সালের ২৩ মাচর্ পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। শহীদের আত্মদান বৃথা যায়নি।

২১ ফেব্রæয়ারি এখন শুধু বাঙালির মহান ভাষা দিবস নয়। ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে, ২১ ফেব্রæয়ারিকে আন্তজাির্তক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

২১ ফেব্রæয়ারি এখন সারাবিশ্বের মানুষ ‘আন্তজাির্তক ভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করে। ইতিমধ্যে বাংলাকে জাতিসংঘের ৭ম দাপ্তরিক ভাষার মযার্দা দেয়ার জোর দাবি জানানো হয়েছে, তা যদি হয় বাংলা ভাষা এবং বাঙালিরা বিশ্বের বুকে স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে নিজেদের স্থান করে নেবে, শহীদের আত্মা পাবে তৃপ্তি।

ভাষার কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে সগৌরবে স্বীকৃত। শুধু তাই নয়, আফ্রিকান রাষ্ট্র সিয়েরালিওনে বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষার মযার্দা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ সারা বিশ্বে বতর্মানে প্রায় ৩০ কোটিরও বেশি লোকের মাতৃভাষা ‘বাংলা’।

তবে, শুধু আন্তজাির্তক স্বীকৃতি আর বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা এই ভেবে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুললে হবে না। সবর্ত্র শুদ্ধ বাংলা ভাষার চচার্ করতে হবে। একুশের চেতনাকে মনেপ্রাণে লালন করতে হবে, তবেই ভাষা আন্দোলন তথা শহীদের আত্মদান সাথর্ক হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<35658 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1