শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফুল পাখি নদীর কবি আল মাহমুদ

মো. ওবায়দুল হক
  ১৩ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

আধুনিক কবিতার রূপকার, সোনালি কাবিনের স্রষ্টা! কবিতার রাজপুত্র, বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূণর্ প্রতিভাবান ও শক্তিমান কবি, এক প্রবাদতুল্য কিংবদন্তি নাম, আল-মাহমুদ। শত বাধাবিঘœতা পেরিয়ে তিনি জয় করে নিয়েছেন আধুনিক বাংলা কবিতার সবের্শ্রষ্ঠ আসন! মেঘ যেমন সূযের্ক কখনোই আড়াল করতে পারে না। তেমনি সোনালি কাবিনের কবিকেও কেউ আটকে রাখতে পারেনি। বাংলা সাহিত্যে আল-মাহমুদ এক সোনালি সূযের্র নাম। সাহিত্যের সকল শাখাতেই তার সমান পদচারণা। তার লেখনীর ব্যতিক্রম স্বাদের জন্য তিনি বারবার আলোচিত হয়েছেন।

আল মাহমুদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের একটি ব্যবসায়ী পরিবারে ১১ জুলাই ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। একুশ বছর বয়স পযর্ন্ত এ শহরে এবং কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার অন্তগর্ত জগতপুর গ্রামের সাধনা হাইস্কুলে এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুÐ হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। এ সময়েই লেখালেখি শুরু। তিনি ১৯৭১-এর স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৫-এ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহ-পরিচালক পদে যোগদান করেন। পরে ঐ বিভাগের পরিচালকরূপে ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে তিনি অবসর নেন। কবিতা, ছোট গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের বই মিলিয়ে শতাধিক। আল মাহমুদ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকসহ বেশ কিছু সাহিত্য পুরস্কারে ভ‚ষিত হয়েছেন।

‘কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হঁাটুজল নদী

কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিংবা নাড়ার দহন

পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ

মাছের অঁাশটে গন্ধ, উঠোনে ছড়ানো জাল আর

বঁাশঝাড়ে ঘাসের ঢাকা দাদার কবর!’

এমন অসংখ্য কবিতায় তিনি ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনিভর্র জনপদ, চরাঞ্চলের কমর্মুখর জীবনচাঞ্চল্য ও নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহের বিষয়কে অবলম্বন করে আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোয় অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বতঃস্ফ‚তর্তায় আঞ্চলিক শব্দের সুন্দর প্রয়োগে কাব্যরসিকদের মধ্যে নতুন পুলক সৃষ্টি করে আধুনিক কবিতায় দিয়েছেন তিনি নতুন মাত্রা।

প্রকৃতির সঙ্গে তার আত্মীয়তা! ফুলের কবি, পাখির কবি নদীর কবিÑ আল-মাহমুদ।

১৯৫২ সালের পরবতীর্ সময় থেকে তিনি (ঢাকায়) নগর জীবনে বসবাস করলেও। মন ও মননে দারুণ করেছেন গ্রাম্যজীবন। আজন্ম গ্রাম্য ছিলেন এবং থাকার চেষ্টা করেছেন। কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই অকপট স্বীকার করেছেন এবং তার গ্রাম্যতার স্বরূপ বণর্না করেছেন বেশ স্পষ্ট ভাষায়।

‘এই গ্রাম্যতা আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পাইনি। আমার পিতা-মাতা ও আমার সাবেক পরিবেশ, যা আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফেলে চলে এসেছিলাম, তাছিল পরিপূণর্ভাবে নাগরিক স্বভাবের। তৎকালীন কলকাতাইয়া চালচলন তাদের মধ্যে প্রকট ভাবেধরা পড়ত। আমার পিতা এবং নানার ব্যবসা-বাণিজ্য সব কিছুই ছিল কলকাতার সঙ্গে সম্পকির্ত। বাড়ির পরিবেশ সেভাবেই তারা গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু আমি আশ্বযর্জনকভাবে ছিলাম গ্রামের লোক। এই গ্রাম্যতা মূলত এক ধরনের মানবিক সরলতারই নামান্তর মাত্র।’ (গ্রন্থ, ‘কবির মুখ’ পৃষ্ঠা: ২৯২)

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ কবি আল মাহমুদের ভাষায় এই নদী মেঘনার শান্ত মেয়ে। যে নদীটি তার বেশ গল্প কবিতা উপন্যাসে ফুটে উঠেছে।

ফুল পাখি নদীর প্রেমিক তিনি, তাইতো তিনি আমরত্ব দিয়েছেন তিতাস নদীকে তার কবিতায়।

‘মেঘনার শান্ত মেয়ে তিতাসে

মেঘের মতো পাল উড়িয়ে কি যে ভাসে’

(কবিতা, ভর দুপুরে)

‘সারাদিন তীর ভাঙে, পাক খায়, ঘোলা স্রোত টানে

যৌবনের প্রতীকের মতো অসংখ্য নৌকার পালে

গতির প্রবাহ হানে। মাটির কলস জল ভরে

ঘরে ফিরে ছলিমের বউ তার ভিজা দুটি পায়।’

(কবিতা: তিতাস)

‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে

হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।

নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?

-হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।

বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বঁাকে

শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে।’

(কবিতা: নোলোক)

‘তোমার গোসুল আমি দেখেনি কি একদা তিতাসে?

মনে পড়ে? শ্মাশান ঘাটের সেই সিঁড়ি ছুঁয়ে নেমে যায় জল

ডোবা সে পাদপদ্ম। সাফরী পুঁটির ঝঁাক আসে আঙুল ঠুকরে খেতে। নদী যেন নদীতে পাগল।’

(কবিতা: নদীর ভিতরে নদী)

জীবন নিয়ে তার উপলব্ধি:

‘পৃথিবীকে দেখার দুটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে বলে আমি

উপলব্ধি করি। একটা হলো বৈষয়িক দৃষ্টিভঙ্গি। আরেকটা হলো কবির উদাসী স্বপ্ন ও কল্পনার যুক্তি, অবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি। যারা বাস্তবতার মধ্যে হিসাব করে বেঁচে থাকেন তারাই ভালো থাকেনÑ এটা মনে করা হয়। কিন্তু আমি অবাস্তব স্বপ্নদ্রষ্টা, অসহায়ের দলে পড়ি। বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ কিছু হারালে হা-হুতাশ করে। কিন্তু আমার শত দিক থেকে হারানোর ভয় থাকলেও আমি হা-হুতাশ করি না। আর যদি দীঘর্শ্বাস ধরে না রাখতে পারি তাহলে তা কবিতা হয়ে বের হতে থাকে। এটাই আমার অদৃষ্টলিপি।’ (গ্রন্থ,‘কবির মুখ’ পৃ.২৯৬)

সত্যিকারের কবিকে ধন-সম্পদ-খ্যাতির মোহ আটকাতে পারে না। কারণ তারা জানে এগুলো কত ক্ষণস্থায়ী। মহাকালের পটে শ্রেষ্ঠ কবিতা-ই টিকবে, ধন-সম্পদ কালের ধূলায় মিশে যাবে।

‘ধন-সম্পদ আগলে কোনো মানুষই তা শেষ

পযর্ন্ত ধরে রাখতে পারে না। মানুষের পরমায়ু আর কত দিনের। আমি এ ব্যাপারে অজ্ঞ না হলেও বিজ্ঞও নই। আমি একটি কবিতা রচনা করে জীবনে যে আনন্দ পেয়েছি অন্য কোনো কিছু আমাকে তা দিতে পারেনি।’ (‘কবির মুখ’পৃষ্ঠা: ৩০২)

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<3229 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1