শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা ভাষার সেরা উপন্যাস প্রদোষে প্রাকৃতজন

ড. রাশিদ আসকারী
  ৩০ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

বিগত অধর্শতকজুড়ে ইঙ্গ-মাকির্ন সমালোচনা ভুবনে সাহিত্যেকমের্র ঐতিহাসিক প্রকৃতি বিবেচনার ধারা মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত হয়ে আসছিল। নয়া সমালোচকদের প্রবল কাঠামোবাদী ভাবনা এবং টেকস্ট-অন্ধ দৃষ্টিভঙ্গি যখন ‘লেখকের মৃত্যু’ ঘোষণা করে পাঠ্যপূজা শুরু করে, তখন কনটেকস্টের প্রাসঙ্গিকতা অনেকখানি গৌণ হয়ে পড়ে। গ্রন্থঘনিষ্ঠ নিবিড় পঠন লেখকের পটভ‚মি কিংবা প্রতিক্রিয়াকে অপ্রাসঙ্গিক মনে করে। উদ্দেশ্যমূলক হেত্বাভাস (ওহঃবহঃরড়হধষ ভধষষধপু) এবং প্রভাবক হেত্বাভাস (ধভভবপঃরাব ভধষষধপু)-এর ধোয়া তুলে তারা লেখক এবং পাঠক উভয়কেই টেকস্ট থেকে দূরে রাখতে চান। স্টো-এর আঙ্কেল টমস ক্যাবিনকে তারা দাসপ্রথাবিরোধী উপন্যাসের তকমা ছেড়ে মুক্তভাবে পাঠ করার উপদেশ দেন। টেকস্টের ভেতরে সিগনিফায়ার-সিগনিফায়েডের দ্ব›দ্ব, বাইনারি অপজিশনের টানাপড়েন আত্মছলনার উপকরণ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে পোস্টমটেের্মর পরামশর্ দেন। সমালোচনা ধারার এই জটিল, নিরীক্ষাধমীর্ প্রবণতা-সাহিত্যিকদেরও রকমারি জানরা (মবহৎব) সৃষ্টির প্রেরণা দেয়। মহান আখ্যান ভেঙে ক্ষুদ্র উপাখ্যান বানানোর কৌশল শেখায়। উৎসাহিত হয় নয়া উপন্যাস, প্রতিউপন্যাস, জাদুবাস্তবতা, গোথিক সাহিত্য প্রভৃতি, যার ব্যাখ্যানের জন্য ঐতিহাসিকতার তেমন একটা প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু তাই বলে, উপন্যাসের প্রতিপাদ্য হিসেবে ইতিহাসের কণ্ঠস্বরকে বেশিদিন চেপে রাখা যায় না। ‘একটি সাহিত্য রীতি যত বেশি বিকশিত হয়, এবং তার কাঠামো যত বেশি জটিল হয়, তা তত বেশি পরিপূণর্ভাবে তার অতীতকে স্মরণ করে’ বলে ঘোষণা দেন মিখাইল বাখতিন। সেই বিবেচনায় অতীত কিংবা ইতিহাসের সবাির্ধক ভবিষ্যৎদশীর্ আবাহন হলো উপন্যাস। একটি উপন্যাসের উপন্যাসত্ব সেই উপন্যাসের অ-উপন্যাস অংশটুকুর ওপর নিভর্র করে, যাকে বলা যেতে পারে অতীত। একটি উপন্যাস আমাদের অতীত অভিজ্ঞতার সঙ্গে এতটাই অবিভেজ্য যে, ইতিহাসের মতোই তা অতীত এবং বতর্মানের মধ্যে এক শৈল্পিক সংযোগ সেতু স্থাপন করে। অন্যান্য সাহিত্য রীতির তুলনায় উপন্যাসই বেশি অসমসত্বতার ভেতর দিয়ে তার ঐক্য খেঁাজে এবং তাতে ঐতিহাসিকতার প্রয়োজনীয়তা অনিবাযর্ হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক উপন্যাস তাত্তি¡কেরা তাই পাঞ্জল ঐতিহাসিকতার বিষয়টি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন। শওকত আলীর কালজয়ী উপন্যাস প্রদোষে প্রাকৃতজন (১৯৮৪) নয়া সমালোচকদের (ঘবি পৎরঃরপং) ভাবনার খোরাক যতটুকু জোগাবে, তারচেয়ে অনেক বেশি জোগাবে নিউ হিস্টরিসিস্টদের (ঘবি যরংঃড়ৎরপরংঃং) । বাঙালির প্রদোষের ইতিহাস এবং প্রাকৃতজনের নৃতত্তে¡র ভিত্তিমূলে নিমির্ত এই সাহিত্য সৌধের স্তরে স্তরে লুকিয়ে আছে নব্য ইতিহাসবাদের বিচরণ ক্ষেত্র। চলমান সাহিত্য সমালোচনা তত্তে¡ নব্য ইতিহাসবাদ একটি দুদান্ত? সংযোজন। ১৯৭০-এর দশকে ক্যালিফোনির্য়ায় বিভিন্ন ডিসিপ্লিন থেকে আগত একঝঁাক টকবগে তরুণ একাডেমিক-যাদের মধ্যে ছিলেন সাহিত্য সমালোচক, শিল্প-ইতিহাসবিদ, ইতিহাসবিদ এবং নৃ-তত্ত¡বিদ অকস্মাৎ এক পিৎসা পালাের্র আড্ডায় বসেন এবং প্রাণ ভরে ছোটমাছের চাটনি দিয়ে আনারস খান। পেট ভরে গেলে তাদের আলোচনায় উঠে আসে সাহিত্য ও ইতিহাস, শিল্প ও ইতিহাস এবং নৃ-তত্ত¡ ও ইতিহাসের সম্পকর্ নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা। বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের মধ্যে ভেদ সৃষ্টিকারী বড় বড় দেয়ালগুলোকে ভাংতে চাইলেন এই তরুণ চিন্তকেরা। দীঘর্ আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত? এলো, জবঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হং নামে একটা জানার্ল তারা বের করবেন যা বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পকর্ এবং তার সূত্রগুলো উদ্ঘাটন করবে। জ্ঞানকাÐে ঐতিহাসিকায়নের (যরংঃড়ৎরপরুরহম) এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। নয়া ইতিহাসবাদের অন্যতম প্রধান পুরোহিত প্রখ্যাত শেক্সপিয়র গবেষক স্টেফেন গ্রিনবøাট উদ্ভাবিত আত্মরূপায়ণের (ংবষভ-ভধংযরড়হরহম) তত্ত¡টি সাহিত্যের ঐতিহাসিকতা আবিষ্কারের একটি চাবি তত্ত¡। এর আলোকে শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজনের ঐতিহাসিকতার একটি ভিন্নতর দিক উন্মোচন করা যায়। গ্রিনবøাট চমৎকার করে দেখিয়েছেন কীভাবে শেক্সপিয়র তার কেতাদুরস্ত নাটকীয় চরিত্রগুলোকে রূপায়িত করেছেন। হ্যামলেট চরিত্রটিকে আজ আমরা যেভাবে ভ‚তদশীর্, চাচা-নিন্দুক, বক্তৃতা-নিমার্ণকারী, অহংকারী, অভিমানী হিসেবে পাই, তা অবশ্যই নাট্যকারের আত্মরূপায়ণ শৈলীর সাক্ষ্য বহন করে। গ্রিনবøাট তার তত্তে¡ দেখিয়েছেন, শেক্সপিয়র এবং মালোর্র মতো রেনেসঁা নাট্যকারেরা তাদের সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কোড অনুযায়ী নিজেদের এবং নিজেদের সৃষ্ট চরিত্রাবলির জন্য পরিচয় সৃষ্টি করেছিলেন। ইচ্ছে করেও তারা সময়ের কোডকে উপেক্ষা করতে পারেন নাই। শওকত আলীও তার উপন্যাসে এই ংবষভ –ভধংযরড়হরহম-এর কাজটি নিতান্ত অসচেতনভাবেই করেছেন। সমকালিন এবং অতীতের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কোডগুলোর আলোকে নিজের জন্য এবং সৃষ্ট চরিত্রাবলির জন্য স্বতন্ত্র পরিচয় রূপায়িত করেছেন। প্রদোষে প্রাকৃতজনের প্রোটাগনিস্ট মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গকে খ্রিস্টপূবর্ বারো-তেরো শতকের পুন্ড্রবধের্নর এক গুরুত্বপূণর্ জনপদের সামাজিক-রাজনৈতিক কোডগুলোর আলোকে কৃষিজীবী/শ্রমজীবী মানুষের চেতনার প্রতীক হিসেবে পরিচিত করতে চেয়েছেন। তার কথাবাতার্, চালচলন, পোশাক-আশাক প্রভৃতির মাধ্যমে প্রাচীন বাংলার প্রদোষকালের সমাজ, সংস্কৃতি, ধমর্, সংস্কার, নারী, প্রেম, কাম, ভোগ, দ্রোহ প্রভৃতির প্রদশের্নর এক প্রক্ষেপণ যন্ত্র (ঢ়ৎড়লবপঃড়ৎ) হিসেবে পরিচিত করাতে চেয়েছেন। একটি সংঘবদ্ধ শক্তির প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। অবশ্য রেনেসঁা নাট্যকারদের ংবষভ-ভধংযরড়হরহম-এর সঙ্গে আধুনিক উপন্যাসের ংবষভ-ভধংযরড়হরহম-এর খানিকটা দূরত্ব লক্ষ্য করা যায়। রেনেসঁার ওপর তলার মানুষের আত্মনিমার্ণ এখন অন্ত্যজ শ্যামাঙ্গদের ওপরও প্রয়োগ করা যায়। ডক্টর ওয়ালেস্কা শোরান্দ তার ঞযব ওসঢ়ড়ৎঃধহপব ড়ভ জবরহাবহঃরহম ঙংপধৎ গ্রন্থে প্রখ্যাত আইরিশ নাট্যকার, ঔপন্যাসিক এবং কবি অসকার ওয়াইল্ডের সাহিত্যকমের্ ংবষভ-ভধংযরড়হরহম তত্তে¡র প্রয়োগ করে এক বিকল্প ডিসকোসর্ রচনা করেন।

প্রদোষে প্রাকৃতজনের একটি নব্য ইতিহাসবাদী পঠনে আগ্রহী পাঠক/সমালোচকেরা প্রধানত দুটো কাজ করতে চাইবেন। প্রথমত: উপন্যাসটি কীভাবে তার ঐতিহাসিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক পটভ‚মিকে প্রতিবিম্বিত করে, তা দেখানো এবং দ্বিতীয়ত: কীভাবে সাহিত্যকমির্ট তার পটভ‚মির ওপর মন্তব্য করে এবং তার সঙ্গে সম্পকির্ত হয়, তা বোঝা। নিউ হিস্টরিস্টদের এই ইতিহাস অন্বেষা বলতে কেবল ঘটনা সংঘটনের দিনক্ষণ বোঝোবে না, বরং সেই নিদির্ষ্ট সময়ে বাস করতে কেমন লাগতো, সেই প্রত্যক্ষ অনুভ‚তির অনুপুঙ্খতা কিংবা তীব্রতা বোঝাবে। প্রদোষে প্রাকৃতজন কেবল দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের বাংলার জনজীবনের দিনপঞ্জি নয়, বরং শ্রেণিবিভক্ত বৈষম্য-পীড়িত, জনজীবনের করুণ বাস্তবতা উপলব্ধির এক সুবিশাল আধার। মৃৎশিল্পী হাটে-মাঠে-ঘাটে, গ্রামে-গঞ্জে, নদীতীরে, অরণ্যে নিরন্তর ছুটে-চলা শ্যামাঙ্গের জীবন, সামন্ত-মহাসামন্তদের দোদর্Ðপ্রতাপ, কৈবতের্র পুঞ্জীভ‚ত ক্ষোভ, চÐালদের দ্রোহ, মৃৎ-রমণীদের জীবনের অনিশ্চয়তা, হাহাকার প্রভৃতির এক জীবন্ত কোলাজ হয়ে উঠেছে শওকত আলীর এই উপন্যাস। তবে দলিল- শিকার কিংবা অতীত-খনন ছাড়াও নব্য ইতিহাসবিদ এই উপন্যাসে আন্তঃশাস্ত্রীয় কিংবা বহুশাস্ত্রীয় ভাবনার সম্মিলন ঘটানোর রসদ খুঁজে পেতে পারেন। ইতিহাস, সাহিত্য, নৃ-তত্ত¡, সমাজতত্ত¡, অথর্নীতি, রাজনীতিসহ পছন্দমতো সব কিছুরই আলো ফেলে দেখা যেতে পারে প্রদোষকালে প্রাকৃতজনদের। এভাবে এ উপন্যাসের পঠনে সাহিত্যিক টেকস্ট এবং অসাহিত্যিক টেকস্টের সমান্তরাল পঠনের একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। ভিন্ন ভিন্ন সহায়ক উৎসের মিথোস্ক্রিয়ায় একটি সাহিত্যিক টেকস্ট হিসেবে প্রদোষে প্রাকৃতজনের সাহিত্য মূল্য এবং পরিপ্রেক্ষিত উপলব্ধির ক্ষেত্র প্রশস্ততর হবে।

প্রদোষের প্রাকৃতজনেরা গ্রামসির (অহঃড়হরড় এৎধসংপর) কালচারাল হেজিমনি তত্তে¡র ‘নিচ থেকে বলা’ ইতিহাসের সাবঅলটানর্। উত্তর/ ঔপনিবেশিক তত্ত¡ অনুযায়ী, প্রাচীন বাংলার সেই মৃত্তিকা-সংলগ্ন জনগোষ্ঠী, শ্যামাঙ্গ যাদের প্রতিনিধি, সেই পুন্ড্র এবং নি¤œবঙ্গের শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষ, সেই ডোম্বী, শবরী, গুÐিণী আদিবাসী, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে আধিপত্যবাদী ক্ষমতাকাঠামোর বাইরের মানুষ। তারাই নি¤œবগর্ বা সাবঅলটানর্। তারা সামাজের নিচতলার মানুষ, সমাজের সেই জনগোষ্ঠী যাদের অবস্থান একেবারেই প্রান্তিক। সাবঅলটানর্ তত্ত¡ মতে সামাজিক মানদÐগুলো ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরকার মানুষের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ক্ষমতা-বহিভ‚তর্ অন্যদের (ঙঃযবৎ) ওপর চাপানো হয়। জাতি, শ্রেণি এবং লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে তাদের কোনো সামাজিক কণ্ঠস্বর (াড়রপব) থাকে না। যেমন শ্যামাদের গুরু বসুদেব। তিনি অসংস্কৃত সামন্ত প্রভ‚দের অনুশাসনের বেড়াজালে বন্দি। শুধু তাই নয়/রীতিমতো তাদের মুখপাত্র। তাই শ্যামাঙ্গ তার এবং সামন্ত মহাপতিদের রুচির তোয়াক্কা না করে স্বাধীনভাবে শিল্পচচার্ করতে চাইলে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাধ, শবর, ধীবর, ডোম্বীকে তার শিল্পকমের্র অন্বিষ্ট করতে চাইলে, কিংবা ব্রাত্য মানুষের মুখাবয়ক আর দেহকাঠামো শিল্পে ধরতে চাইলে কতার্ভজা বসুদেব তীব্র ভৎর্সনা করেন: “মূখর্ তুমি শ্যামাঙ্গ, একেবারেই মহামুখর্ ... এসব নিমির্ত হচ্ছে তোমার পিতৃধনে নয়। এসব নিমাের্ণর বিপুল ব্যয়ভার বহন করেছেন কায়স্থ কুলতিলক মহাসামন্ত সুধীমিত্র তার আদেশ পালনের জন্যই তোমাকে অথর্ দেয়া হচ্ছেÑ প্রতিমা নিমার্ণ শাস্ত্র ব্যাখ্যার জন্য নয়।’ বসুদেবের এই কণ্ঠস্বর নি¤œবগীর্য় ঙঃযবৎ-এর কণ্ঠস্বরহীনতারই নামান্তর। এই কণ্ঠস্বর অথর্ দিয়ে ক্ষমতা দিয়ে কেনা।

প্রতিবাদহীন সাবঅলটানর্ ঙঃযবৎ-এর অংশ হলেও শিল্পীর সৃজনকমের্ অসৃজনশীল অভিজাত শ্রেণির অযাচিত হস্তক্ষেপে এবং গুরু বসুদেবের এই আত্মমযার্দাহীনতায় ক্ষতবিক্ষত হয় শ্যামাঙ্গের সংবেদনশীল শিল্পীমানস: ‘শিল্পী কি ক্রীতদাস? রাজানুগ্রহ ব্যতিরেকে কি শিল্পীর অস্তিত্ব নেই?’ নীরব প্রতিবাদে ফেটে পড়ে শ্যামাঙ্গ। প্রথা ও অনুশাসন ছিন্ন করে স্বাধীন শিল্পচচার্র অন্বেষায় বিল্বগ্রাম পেছনে ফেলে অভিযাত্রী হয় অনিশ্চিত পথের। এভাবে শোষিতের মৌন প্রতিবাদ অদৃষ্ট অশ্রæত থেকে যায়, চাপা পড়ে যায় ক্ষমতাসীনদের ডমিন্যান্ট ডিসকোসের্র অন্তরালে।

প্রখ্যাত উত্তর ঔপনিবেশিক তাত্তি¡ক গায়ত্রী স্পিভাক তার ঈধহ ঃযব ঝঁনধষঃবৎহ ঝঢ়বধশ? প্রবন্ধে নি¤œবগীর্য়দের প্রতিনিধিত্ব করার কিংবা তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার অক্ষমতার কথা বলেছেন। প্রতিনিধিত্বহীন, ভাষাহীন সাবঅলটানের্দর সীমাহীন অসহায়ত্বের কথা বলতে গিয়ে তিনি মৃত স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যাওয়া সতীদের কথা বলেছেন। স্পিভাক তার তত্তে¡ সতীদের সহমরণের প্রপঞ্চটিকে প্রতিনিধিত্বকরণ এবং স্বচ্ছতার সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। হিন্দু ধমর্গুরুরা সতীদাহকে চরিত্রবতী হিন্দু নারীদের এক স্বেচ্ছাকৃত, আনন্দদায়ক উপলব্ধি হিসেবে ব্যাখ্যা করতেন এবং ব্রিটিশ সরকার দেখতেন দÐনীয় অপরাধ হিসেবে। কিন্তু যারা এই অমানবিক প্রথার নিমর্ম বলি, সেই নীরব, নিবির্বাদী সহমরণযাত্রী সতীরা ব্যাপারটাকে ঠিক কিভাবে দেখতেন তার কোনো সত্যিকার ভাষ্য কি পাওয়া গেছে? স্পিভাক কি যথাথর্ প্রশ্ন তোলেননি? সাবঅলটানর্রা কি তাদের মনের কথা বলতে পারে?

স্পিভাকের সাবঅলটানর্ তত্ত¡ অনুযায়ী সহমরণগামী ভারতীয় সতীদের নিজস্ব কোনো ভাষ্য না থাকলেও প্রদোষের প্রাকৃত নারীদের নিজস্ব ভাষ্য লক্ষ্য করা যায়। উজুবট গ্রামে লম্পট অভিমন্যুর পরিত্যক্ত স্ত্রী লীলাবতীর সঙ্গে শ্যামাঙ্গের প্রণয় ঘনিষ্ঠ হলে লীলাবতী শ্যামাঙ্গকে নিয়ে ধমর্ত্যাগ করে যবন কেন্দ্রে স্থায়ীভাবে থেকে যেতে চাইলে জাত্যাভিমানী শ্যামাঙ্গ আপত্তি করে। লীলাবতী ফুঁসে ওঠে: ‘বলো আমার কী অপরাধ? আমি কেন সমস্ত দিক থেকে বঞ্চিত হবো জীবনে আমি পরিপূণর্ভাবে চাই। আমি সংসার চাই, স্বামী চাই, সন্তান চাই প্রত্যেকটি আমার প্রয়োজন, একটি ন্যূন হলে চলবে না। যদি আমার পরিপূণর্ জীবন হয় উত্তম, না হলে জীবনকে আমি প্রত্যাখ্যান করবো।’ নিরুপায় শ্যামাঙ্গ শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করে: “তাই বলে তুমি নিজ ধমর্ ত্যাগ করতে চাও?’ লীলাবতীর ঝঁাঝালো উত্তর ‘হ্যঁা, চাই। আমার ধমর্ কোথায়? আমি তো বুঝি না, সত্য সত্যই আমর ধমর্ বলে কোনো বস্তু কখনো ছিল কিনা। যদি ছিল ধরে নিই, তাহলে সে ধমর্ আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এমন বিবাহ ঘটেছে, যা আমি চাইনি- সে ধমর্ আমার জীবনকে বিপন্ন করেছে; সে ধমর্ আমাকে পিতৃহীন করেছে বলো, তাকে আমি ধমর্ বলবো?’ সমাজ, ধমর্, জীবন, বিবাহ প্রভৃতি নিয়ে প্রদোষের প্রাকৃত রমণীদের এই স্পধির্ত উচ্চারণ নিশ্চয়ই প্রমাণ করবে যে সাবঅলটানর্রাও কথা বলতে পারে। অবশ্য স্পিভাক যদি সাবঅলটানের্দর সংজ্ঞা সীমানা ছকে বেঁধে তাদের সবর্দাই নিবার্ক রাখতে চান, তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু প্রদোষের সাবঅলটানের্দর ভাষা ছিল,Ñ যদিও তা কখনো কারও কারও কাছে স্তব্ধ থেকেছে, আবার কারও কারও কাছে উচ্চারিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমের মতো বাংলা সাহিত্যের প্রামাণিক (পধহড়হরপধষ) সাহিত্যিকদের পাশাপাশি শওকত আলীর মতো অপ্রামাণিক (হড়হ পধহড়হরপধষ) সাহিত্যকমের্র সমান্তরাল পঠন নিউ হিস্টরিসিস্টদের অন্বিষ্ট। প্রামাণিক সাহিত্যিক বলতে আমরা কোনো ভাষার সবোর্ত্তম সাহিত্যকমর্গুলোকে বোঝাতে চাই। যেমন শেক্সপিয়র ইংরেজি ভাষার একজন ক্যাননিকাল লেখক যার রচনা ইংরেজদের শিক্ষাজীবনের সব স্তরে অবশ্য পাঠ্য। শেক্সপিয়রের রচনাবলি পড়ে পড়ে ক্লান্ত ইংরেজরাও তার থেকে নিস্তার পায় না। কারণ ইংলিশ ক্যাননের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো শেক্সপিয়র। স্টেফেন গ্রিনবøাট এবং হ্যারল্ড বøুমের মতো শেতাঙ্গ , পৃংতান্ত্রিক বুড়ো পÐিতেরা যখন ক্যাননের সঙ্গে গ্যঁাট হয়ে থাকার ফতোয়া দেন, তখন কালচারাল স্টাডিজ, নারীবাদী তত্ত¡, উত্তর/ঔপনিবেশিক তত্ত¡ এবং অদ্ভুত তত্ত¡ (য়ঁববৎ ঃযবড়ৎু) আমাদের শেখায় কীভাবে আমরা ক্যাননকে চ্যালেঞ্জ করতে পারি এবং দেখাতে পারি কীভাকে তা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এবং প্রান্তিক সংস্কৃতিকে মূলধারার সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। প্রদোষে প্রাকৃতজন এবং তার লেখক শওকত আলী রবীন্দ্রনাথ কিংবা বঙ্কিমের তুলনায় অপ্রামাণিক লেখক। চিত্তাকষর্ক পরিভাষাগবীর্ বরেণ্য পÐিতেরা এখনো তার শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপ করে তোলেননি। সম্ভবত অপ্রামাণিত বলে বাংলাদেশেও শওকত আলীকে নিয়ে কিংবা তার প্রদোষে প্রাকৃতজন নিয়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ডিসকোসর্ গড়ে ওঠেনি। অথচ আবহমান বাংলার ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে জাতি-ধমর্-বণর্ সঙ্কটের এক ঐতিহাসিক লগ্নে শিল্পী, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক এবং নৃতাত্তি¡কের নিপুণ দৃষ্টি নিয়ে গড়ে তোলা এই উপন্যাস খুব সহজে/ তাত্তি¡ক সমালোচকদের নজর কাড়তে পারে। তবে নব্য ইতিহাসবাদীরা রবীন্দ্র-বঙ্কিমের উচ্চ সাহিত্যর (যরময ষরঃবৎধঃঁৎব)পাশাপাশি শওকত আলীর ‘নি¤œ সাহিত্য’ (ষড়ি ষরঃবৎধঃঁৎব) পঠনে স্বচ্ছন্দ বোধ করবে এবং এ-দুয়ের মধ্যকার পাথর্ক্য অথর্হীন জ্ঞান করতে চাইবে। আপাত অপ্রামাণিক হলেও শওকত আলী নয়া ইতিহাসবাদীদের আগ্রহ জাগাবে এবং পৌনঃপুনিক পঠনের মধ্যদিয়ে নিঃশব্দে প্রামাণিকতা অজর্ন করবে।

প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসে নারীবাদী সাহিত্যতাত্তি¡ক ভাবনার প্রচুর উপাদান খঁুজে পাওয়া যেতে পারে। সন্ধান করা যেতে পারে কীভাবে সাহিত্যবস্তু সামাজিক, অথৈর্নতিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্তি¡কভাবে অবদমিত নারীর আখ্যান চিত্রিত করে। আধুনিক ইউরোপের অবমূল্যায়িত নারী সমাজের প্রতীকী প্রতিনিধি প্রখ্যাত নরওয়েজিয়ান নাট্যকার অ উড়ষষদং ঐড়ঁংব (১৮৭৯) মুখ্য চরিত্র নোরা আত্মোপলব্ধির মধ্য দিয়ে আত্মমযার্দার অন্বেষায় যেভাবে পুংতান্ত্রিক সমাজের কোড উপেক্ষা করে স্বামীর মুখের ওপর ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। নোরার দরজা বন্ধ করার এই প্রচÐ শব্দ পুরো ইউরোপের পুংতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত কঁাপিয়ে তোলে। কিন্তু তার বহু আগেই মধ্যযুগের বাংলায় নিগৃহীত নারী সমাজের প্রতীকী প্রতিনিধি প্রদোষে প্রাকৃতজনের মৃৎরমণী লীলাবতীকে দেখতে পাই পুংতান্ত্রিক ধমর্, সমাজ, সংস্কার ভ্রæকুটি করে নারী সমাজের পুতুল নিয়তি অগ্রাহ্য করে নারীর আতœঅধিকারের ইশতোহার ঘোষণা করতে : ‘আমি তোমার পুত্তলিটি নই শ্যামাঙ্গ। আমি জীবন্ত নারী, আমার স্বামী চাই, সংসার চাই, সন্তান চাইÑ ওইগুলোই আমার ধমর্, অন্য ধমর্ আমি জানি না’। ডলস হাউসের নোরা স্বামী সন্তান ছেড়ে চলে যায় অধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে আত্মমযার্দা প্রতিষ্ঠা করতে। প্রদোষে প্রাকৃতজনের লীলাবতী স্বামী সন্তান গ্রহণ করতে চায়Ñ সামাজিক অধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে আত্মমযার্দা প্রতিষ্ঠা করতে। দুজনের প্রত্যাশার জায়গাটা ভিন্ন হলেও উপলব্ধির জায়গাটা এক ও অভিন্ন। তবে পাথর্ক্য এই যে, নোরা যা ভেবেছে উনিশ শতকে/ লীলাবতী তা ভেবেছে অনেক অনেক আগেই।

ফরাসি তাত্তি¡ক রেঁালা বাতের্র ঝ/ত (১৯৭০) গ্রন্থে সংজ্ঞায়িত দু-ধরনের সাহিত্যিক টেকস্টের [পাঠকী (ৎবধফবৎষু) এবং লেখকী (ৎিরঃবৎষু)] মধ্যে প্রদোষে প্রাকৃতজনকে একটি পাঠকী টেকস্ট হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। এটি, বাতের্র তত্ত¡ানুযায়ী, সহজ শনাক্তযোগ্য এবং সহজবোধ্য চরিত্র এবং ঘটনাবলি চিত্রিত করে এবং এর অথোর্দ্ধারের উপকরণগুলো টেকস্টের ভেতরেই উপস্থিত থাকে। এটি জেমস জয়েসের টষুংংবং কিংবা উইলিয়াম ফকনারের ঞযব ঝড়ঁহফ ধহফ ঋঁৎু-এর মতো কোনো জটিল নিরীক্ষাধমীর্ দুবোর্ধ্য উপন্যাস নয় যার অথর্ তাৎক্ষণিকভাবে সুস্পষ্ট হয় না এবং সততই পাঠকÑ সমালোচক কতৃর্ক বৈচিত্র্যপ্রাপ্ত হতে থাকে। প্রদোষে প্রাকৃতজন বাংলা ভাষার পাঠকী টেকস্টের এক প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এখানে ঔপন্যাসিকের বোধ , বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি, তার চরিত্রাবলির অবস্থান, ঘটনাবলির ঐতিহাসিকতা/ প্রাগৈতিহাসিকতা সবকিছুই সহজবোধ্য এবং সাবির্ক পাঠোদ্ধার সহজসাধ্য।

বড়মাপের ঔপন্যাসিকেরা তাদের উপন্যাসকে প্রস্তুত করে তোলেন সমাজের পরিবতর্নগুলো ধারণ করার জন্য। সাভেির্ন্তস এমন এক পৃথিবীর মুখোমুখি হয়েছিলেন যা তার নিশ্চয়তাবোধ হারিয়ে ফেলেছিল। মধ্যেযুগের জীবনযাত্রার অনিশ্চয়তা এবং তজ্জনিত অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা বোধ ডন কুইক্সোটের ভুবনকে রোমাঞ্চকর, দুঃসাহসিক ও বিপদসঙ্কুল করে তুলেছে। শতবষর্ পরে স্যামুয়েল রিচাডর্সন মানুষের অন্তজীর্বন নিয়ে নিরীক্ষা চালিয়েছেন। উনিশ শতকে গুস্তাভ ফ্লবেয়ার প্রতিষ্ঠান ও সরকার অনুশাসিত জনজীবনের প্রাত্যহিকতা নিয়ে ক্রনিকল করেছেন। বিশ শতকে মাসের্ল প্রæস্ত ব্যক্তিজীবনের ওপর অতীতের প্রভাব অনুসন্ধান করেছেন; জয়েস প্রশ্ন তুলেছেন বতর্মান অনুধাবনে মানুষের সামথর্্য নিয়ে। মিলান কুন্ডেরা তার ঞযব অৎঃ ড়ভ ঃযব ঘড়াবষ গ্রন্থে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে শিগগিরই সাহিত্যের সব স্বীকৃত রীতিনীতি অসার প্রতিপন্ন হবে এবং অযৌক্তিকতায় পযর্বসিত হবে। আধুনিক ঔপন্যাসিক ফ্রানস্ কাফ্কা, রবাটর্ মুসিল এবং হারম্যান ব্রচ ইতোমধ্যেই তার নমুনা দেখিয়েছেন। সাহিত্যের সব জানরার মধ্যে একমাত্র উপন্যাসই আধুনিক মানুষের উদ্ভবের সঙ্গে সহগামী ধারণাগুলোর পরিবতের্নর ধারাকে সফলভাবে প্রতিফলিত করতে পেরেছে। সেই বিচারে প্রদোষে প্রাকৃতজনও একটি সাথর্ক উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত পাবার যোগ্য।

উপন্যাসটি বিভিন্ন ভাষার অনেক আধুনিক ক্লাসিক উপন্যাসের মতোই গুরুত্বপূণর্। আবহমান বাঙালি সমাজের এক বিশেষ মুহূতের্র সামাজিক পরিবতের্নর ধারণাগুলো যথেষ্ট বিশ্বস্ততার সঙ্গে ধারণ করেছে। শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন যে কোনো তাত্তি¡ক বিচারে গত দেড়শ বছর ধরে বাংলা ভাষায় রচিত সেরা উপন্যাসগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<24666 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1