শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তারপর, অন্ধকার দুঃসময়

আশরাফ উদদীন আহমদ
  ১৬ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

শ্যালো চালিত নৌকায় নোয়াবালী পাট আনল যখন, বেলা তখন সারে আট কি নয়টার কাছাকাছি। পাটভতির্ নৌকা এখন ঘাটে বঁাধা। আড়তদার মোখলেশ চাকলাদার বেশ ধুরন্ধর মানুষ বটে, ব্যবসা বোঝে ভালো, অস্থি মজ্জায় নাকি ব্যবসার সুঘ্রাণ মিশে আছে তার। এমন ধারার কথা জাহির করে বেড়ায় বরাবরই সে। নিজেকে ভারি ওজনদার মানুষ মনে করে। নোয়াবালীকে আড়তের মুখোমুখি আসতে দেখেই গদি ছেড়ে উঠে হঁাক দেয় কাকের মতো।

কুতকুতে চোখে একবার চারদিকটা দেখে জলচৌকিটায় ন্যাকড়া বুলিয়ে বসার আমন্ত্রণ জানায়। নোয়াবালী পাটের কৃষক হিসেবে বেশ খ্যাতি আছে সাততল্লাটে; ওর পাটে ভেজাল নেই, স্বণর্লতার মতো ঝরঝরে আর পরিপাটি-আর তাই ব্যাপারীরা ওর পাট কেনার জন্য একটু বেশি পয়সা দিতেও আপত্তি করে না। নোয়াবালীর সঙ্গে পাকাপাকি কথা হয় এক সময়; মোখলেশ চাকলাদার নিজের বিশ্বাসকে আরো খানিকটা গাঢ় করবার জন্য আগবাড়িয়ে বলে ওঠে, তোমার পাটের দাম এর চেয়ে কেউ যদি বেশি দেয়, আমি শালা ব্যবসা ছেড়ে দেব তোমাকে বলে দিলাম...

নোয়াবালী সাত ঘাটে পানি খাওয়া মানুষ বটে, বাজার দর সে জানবে না তো কে জানবে? দু’চার হাটবারের অনেক খেঁাজখবর তার নখদপের্ণ, কোন হাটবাজারে কত দাম সবই সংগ্রহ করেÑ কীতর্নখোলার হাটে আজ পাটভতির্ শ্যালো নৌকা ভিড়িয়েছে। কিষান দুজন বড় চটপটে আর বাচাল। তবু কাজ ওরা ভালোই করে। যতই কথা বলুক আর শরীর দুলিয়ে ইয়ারকি-ফাজলামি করুক না কেন কাজটুকু কিন্তু ঠিকঠিকই করে অবশেষে।

ব্যাপারীর আড়তে পাট তুলে টাকা বুঝে নেয়। বিকেলের গোলাপী আলো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে তখন। টুকিটাকি গেরস্থালি জিনিসপত্র কিনেটিনে কিষান দুজনের হাতে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, সেই ব্যাপারীর কাছ থেকে টাকা বুঝে নেয়ার পরপরই। এখন একেবারে ঝাড়া হাত-পা বটে নোয়াবালীর। বেশ হালকা লাগে নিজেকে, কতদিন পর কেমন যেন একটু স্বাধীন লাগে তার, সত্যসত্যি সে যেন আজ মুক্তপাখি, নানান কথা এলোমেলোভাবে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে, আচমকা বানেশ্বরের নবাব শেখের গুড়ের আড়তে ঢোকে এক সময়, নবাব শেখের রমারম অবস্থা এখন বটে; গুড়ের ব্যবসা করে কে কবে এমন কলা আঙ্গুরের গাছ হয়েছে কে বা জানে?

চোরাই পথে গুড় এনে ব্যবসাটাকে বেশ ফুলিয়ে ফালিয়ে পাকাপোত্ত করেছে এ কয়েক বছরের মাথায়। সিঁথি কেটে চুলে কঁাকই মেরেছে, জবর মানুষ লাগছে। অথচ এই তো ক’বছর আগেই ওর বাপ গঁা-গ্রামে-মফঃস্বলে মাথায় ঝঁাকা নিয়ে ফেরি করে গুড় বেচত, সে তো খুব বেশি দিনের ঘটনাও নয়। কিন্তু আজ যেন সব কেমন ঘষটানো স্মৃতি বৈ তো কি? মানুষ যে কখন কিভাবে লাউডগার মতো তরতর করে বেড়ে যায়, সে খবর কে আর রাখে? তবে ওর বাপ লোকটা নেহাৎই ভালো মানুষ ছিল সন্দেহ নেই কারো, আর হয়তো এ জন্যই উপরওয়ালা ভালো মানুষকে বেশিদিন পৃথিবীতে রাখে না। নোয়াবালীর চোখে এখনো ভাসছে, এই তো সেদিনের কথা, কালে-কালে মানুষ সব কোথায় চলে যাচ্ছে। সব যেন ধরাছেঁায়ার বাইরে।

মফঃস্বল থেকে ফেরার সময় বাসস্ট্যান্ডে দেখা হয় দুজনের। হালকা রেশমি হাসি ছড়িয়ে বলেছিল, ব্যবসাপাতি ভালো না রে ভাই, মানুষজন এখন দোকান বাজারে সওদা কিনতে অভ্যস্থ, ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে কেনই বা...

নোয়াবালী এখনো ভুলতে পারে না মানুষটাকে। এমনও মানুষ কি আর দুনিয়াতে আসবে! দিনে-দিনে ভালো মানুষগুলো নিকেশ হয়ে গেলে কারা থাকবে আর?

বঁাশঝঁাড়ের ছোটছোট বঁাশ পাতার মিহি বাতাসে শরীর আপনা থেকেই জুড়িয়ে যায়। অনেক দূরে একটা কোকিল থেমে থেমে ডাকছে অবাির্চন তার ওই ঘর ছাড়া উচাটন ডাক, বিষকঁাটা লাগে যেন। নবাব শেখ টাকার তোড়ার ওপর আরাম করে বসে, লাখ-লাখ টাকা এখন তার। সমাজটাকে টাকার জোরে কিনে রেখেছে পায়ের তলায়। নোয়াবালীর সাড়ে তিন বিঘে ধানি জমি এখনো ওর দখলে, দাদন ব্যবসা-কডের ব্যবসা আর বগার্ চাষাদের ঠকানো ব্যবসায় ওর জুড়ি নেই। তারপর সীমান্তের ওদিকে বিয়ে করার ফলে দুপাড়ের সম্পর্ক বেশ তেলে-ঝোলে। গোছানো ভাষায় বড় মিষ্টি করে কথা বলার কারণে সীমান্ত-রক্ষীরাও বেড়ালের মতো সমীহ করে। বউয়ের ভায়েরাও তেমনি ডিয়ারিং, ভগ্নিপতির তাবৎ ভালো-মন্দ গুণ আষ্টেপৃষ্ঠে পেয়েছে বটে।

দুপাড়ের নিঃস্ব মানুষদের ভাগ্য এখন নবাব শেখের রোদেলা হাসির চমকে। টাকা কিভাবে কোন প্রকারে পয়দা করতে হয় তার তামাম কায়দা-কানুন রপ্ত করেছে, ফুলমতি নামের একটা বিবাহিত মেয়েকে উঠতি যৌবনে ভাগিয়ে এনেছিল এই নবাব শেখ। এখন ওসব পুরানো কাসুন্দি কেউ ঘাটতে চায় না, কারণ মামলা-মকদ্দমার বিষয়গুলো নাকি আবার ভালোই জানে, কখন কার ফঁাটা কপালে ওসব এসে জুড়ে যায় ! কাকে কোন ছুঁতোয় ফঁাসিয়ে দেবে সে আতঙ্কে গঁায়ের মানুষ ছিনাল মাগিদের মতো সরে-সরে থাকে। গত বছর নগেন বাগচির পৈতৃক বাড়িখানা কিনল শানবঁাধানো দীঘি সমেত, ঠেঁাট কাটারা কানাঘুষা করছে, নগেনকে সীমান্ত দিয়ে পাড় করে দিয়েছে নামÑ কাওয়াস্তে একটা মূল্য ধরিয়ে। সাত গঁায়ের লোকে এমনও কথা বলাবলি করছে, নগেনকে কেটে গাঙে ভাসিয়ে দিয়েছে, বলা তো যায় না, কার মনে কি আছে কে জানে? এদিকে গঁায়ের সমাজসেবি শিরোনামের কেতাদুরস্ত গÐমূখর্ মানুষ, আবার শরীর বঁাচিয়ে চলে এসব বড়-বড় ঘটনাকে আড়ালে রেখে। নোয়াবালীর জমিটুকু বন্ধকে যেত না, নবাবের হামামদিস্তির পেষণে, বড় ছেলে ছহিদুল মেট্রিক পাস দিয়ে দীঘর্ দিন বাড়ি বসে ছিল হাত পা ছাড়িয়ে। মাঝে আবার বখাটে আর অষ্টনম্বা ছেলে ছোকরাদের পাল্লায় পড়ে গোল্লায় যাচ্ছিল, নোয়াবালীর স্বপ্ন আর ইচ্ছে থাকা সত্তে¡ও ছেলে কলেজে ভতির্ হয়েও আর ওদিকে পা মারালো না। শেষাশেষি উলক্ষণে যাওয়া সব বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো ছোকড়াদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছেতাই অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার পূবার্ভাস পেয়েই নোয়াবালীর সংবিৎ ফিরে আসে।

তারপর আরেকটা দায়িত্ব ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছিল,ছোট মেয়েটাকে পাত্রস্থ করা। বেগতিক অনুধাবন করে দিগভ্রান্ত নোয়াবালী একদিন ছুটির দিন সন্ধ্যার ঠিক পরপর নবাব শেখের দেহেলি ছঁুয়ে দলিজ ঘরে প্রবেশ করে। সেদিন নবাব শেখের মুখে হাসি আর যেন ধরে না। আশ্বিন/কাতির্ক মাসের সূযর্টা ছিল আলো অঁাধারির মাঝামাঝি, কিন্তু ঘুপসি অন্ধকারের মধ্যে নোয়াবালীর দলিল বঁাধা পড়ে।

আজ কতগুলো বছর কেটে গেল নবাব শেখের তালমিছরি কথা শুনতে শুনতে। শঁাখের করাতের মতো এধার ওধার দুধারই কেটে সাবাড় করে দেয় দুবৃর্ত্ত এবং দুদার্ন্ত প্রকৃতির ওই মানুষটা। বড় ছেলে ছহিদুল দালালদের খপ্পরে পড়ে অতোগুলো টাকা দিয়ে বিদেশে গিয়েও আবার পালিয়ে এলো কাগজপত্রের কিসব ঝুট ঝামেলার কারণে।

মাঝখান থেকে সমস্ত পুঁজিপাট্টা গোল হলো নোয়াবালীর! সাধ্যমতো মেয়েটাকে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিলেও ছেলের বাপের বাড়তি চাওয়ায় হিমশিম খেয়ে নাকাল আজ। মেয়েটা বাপের বাড়িতেই দিনাতিপাত করছে যাত্রাদলের বিজ্ঞাপনের মতো। জীবন-সংসার আর বিশ্বব্রহ্মাÐ কেমন সব ফ্যাকাসে ঠেকছে চোখের সামনে। আলোহীন একফালি আকাশটাকে কারা যেন পেয়াজ আর শশাকুচির মতো ফালা ফালা করে নিজেদের দখলে রাখতে চায়। জীবনের কম্পমান শিখার প্রদীপ কখন যে নিভে যায় জানে না, শুধুই ফালতু মরিচিকার পেছনে আলো-আলো করে ছুটে চলা অশান্ত হরিণীর মতো।

নোয়াবালীকে দেখেই নবাব শেখ লম্বা সালাম ঠুকে বসবার জায়গা দেয় এগিয়ে। কি হলো চাচা, ছহিদুল কি টাকা পয়সা আর ফেরৎ পাবে? মতিবানুর শ্বশুর বা এখন কি বলছে আবার...

মানুষজন পরচচার্ পরনিন্দা করতে ভালো পারে আজকাল। কার হঁাড়িতে ভাত ফুটছে কি ফুটছে না সে নিয়ে ঘেঁাট পাকায়, কেন দুটো চাল ফেলে দিয়ে আয় না খেয়ে বঁাচুক, তা না তো, শুধু ফালতু ব্যাগড়া, সব শালারা পরের পোদে লাগতে নাছোড়বান্দা! সমাজের লোকেদের কঁুচুটে চোখ দেখতে আর পছন্দ হয় না। নবাব শেখের কথাগুলো গায়ে কঁাটার মতো বিঁধতে থাকে। কিন্তু কিছু বলে না, হাজার হোক এখন তো গঁায়ের মাতব্বর গোছের একটা কিছু ।

অলিখিত একটা বঁাশের খঁুটি বেশ জোরজবরদস্ত করে হলেও পেয়ে গেছে। সেখানে নোয়াবালীর যাচ্ছেতাই অবস্থা, ঠঁুটো জঘন্নাথ বৈ তো কি আর ! বঁাশের চেয়েও কনচির জায়গা বেশি এবং তার খেঁাচায় আঘাতও বেশি। নোয়াবালীর সমস্ত মুখের ভাষা মুহূতের্ হারিয়ে যায়। আদার বনে শিয়াল বাঘ হয়ে বসে আছে দেখে সে সংকুচিত, থেতলানো শরীর তার আর নড়তে চাই না যেন। তারপরও সে কেঁচোর মতো হলেও হঁাটবে সামনে এগিয়ে যাবে।

নবাব শেখ আবার তানপুরার সুরে বলল, চাচা আপনার জমিটুকু আর কিছু টাকা নিয়ে পাকা দলিল করে দেন, তা দিয়ে ছহিদুলকে আবার বিদেশ পাঠান আর মতিবানুর শ্বশুরকে কিছু টাকা ধরিয়ে মতিবানুকে স্বামীর ঘরে পাঠান...

নোয়াবালীর ঠেঁাটে ফিকে হাসি উপছে পড়ে। ধুরন্ধর মানুষ হয়ে উঠেছে নবাব শেখ। দেশ-গঁায়ের তালেবর বটে। কোনো ফঁাকফোকর রাখতে জানে না।

দূরেদূরে তালগাছ বটগাছ আর বঁাশঝঁাড়ের মতো বুদ্ধিমান, শুধু আকাশ ছুঁতে চায়। বাপের সঙ্গে নাগরদোলায় ওঠা সেই ছেলে আজ নিজেই আস্ত একটা নাগরদোলা। কথা বলার কৌশল বেশ শিখেছে কেষ্টনগরের মাটির পুতুলের মতো সেই ছোট্ট শিশু নবাব শেখ আজ কত বড়টি হয়েছে, নিবির্কারভাবে তাকিয়ে থাকে ফাল্গুন-চৈত্র মাসের পড়ন্ত বেলার উঠোনে রৌদ্র পড়ার মতো। নোয়াবালী আড়ত থেকে বের হয়ে আসে ধীর পায়ে যেভাবে কেন্নো তার আপন গন্তব্যে চলে যায়। দূরের আকাশটাকে থিতিয়ে যাওয়া অন্যরকম কিছু মনে হয়। বুকের ভেতরটা কেমন হ্যাচরপ্যাচর করতে থাকে মুহূতের্।

বাপ-দাদার আমলের জমিগুলো কি তাহলে এক্কেবারে একে একে ওই ঘুপসি অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যাবে! নিজের মধ্যে যুদ্ধ করতে করতে বাড়ির পথে হঁাটতে থাকে। বাতাবিলেবু গাছের ফঁাক দিয়ে এক চিলতে রোদ ছটার মতো নোয়াবালীর চোখে এসে পড়ে আচমকা। মজুমদারদের হাজামজা পুকুরটার ধার ঘেঁষে হঁাটতে থাকে। বুকের মধ্যে দুরুদুরু একটা উত্তেজনা, বড় বেশি হঁাপিয়ে ওঠে এক সময়। জোচ্চোরের এমন মতিগতি তাহলে, কোন ফঁাকে কাকে চরমভাবে ফঁাসাতে হবে, তা বেশ রপ্ত করেছে। কিভাবে অতগুলো টাকা জোগাড়যন্ত্র করবে, কে বা প্রসারিত করবে ভালোবাসার হাত। ছেলে কি আর কোনোকালে টাকা ফেরৎ পাবে? ঠগ-বাটপাড়-দালাল-বেনিয়ারা কি নগদ টাকা হাতে পেলে আর ছাড়তে চায়? ওসব জারজদের হাতে টাকা, দলিল আর নারী মানে জীবনের মোক্ষম সম্পদ, ঘরপোড়া গরু আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। অঁাটোসঁাটো বেঁধে নিজেকে আপ্রাণ ধরে রাখার চেষ্টা করলেও হয়তো পারে না, কারণ মরুভুমির উট মরুর প্রচÐ লু-হাওয়ায় বিশাল বালি রাশির মধ্যে মুখ লুকোনো ছাড়া আর কোনো রাস্তা খঁুজে পায় না, তাছাড়া কি-ই বা করতে পারে!

মেয়েটাকে পাঠাবে কেমন করে, গত বষার্য় পর পর দুবারই বন্যা এলো ধাওয়া করে, মাটির ঘর দুটো পড়ে গেল, নদীর দিকে গোয়াল ঘরটাও ধ্বসে গেল রাতারাতি, গাইটা পাতলা পায়খানা করতে করতে মরল, বাছুরটা যায় যায় করেও শেষাশেষি টিকলো ঠিকই, কিন্তু লাভের লাভ তো ঝরে গেল ফালতু বাছুর রেখেই বা কি, উপায় না বুঝে একদিন ক্যালো গাজীর শ্যালক ধেনো সদার্র কসায়ের হাতে নামকাওয়াস্তে মূল্যে ছেড়ে দিল। সে টাকা দিয়ে পাটের বীজ কিনে ওইটুকু জমিতে পাট লাগিয়ে দুটো পয়সা এলেও নবাব শেখের কাছ থেকে সারে তিন বিঘের জমির দলিল কিভাবে খালাস করে আনবে ভেবে কুল-কিনারা পায় না। নিজের মধ্যে নিজেই হঁাপিয়ে ওঠে, জমি-জিরাত ব্যাপারটা বড় স্পশর্কাতর বিষয়। কারণ ও জিনিস যার কাছে থাকে সেই প্রকৃতপক্ষে মালিকানা সূত্রে অংশিদার বটে।

সপ্তাহ দুয়েক যেতে না যেতেই নবাব শেখ আকুলিবিকুলি হয়ে একদিন কাক ডাকা সাত সকালে ফেকু পালাদারকে নোয়াবালীর বাড়ি পাঠাল। সদ্য কেনা চোরাই সাইকেলে চেপে হুড়মুড় করে বঁাশের বঁাকারি দিয়ে বানানো ঝাপটার কোণে এসে একটা পা দিতে গিয়ে শরীরের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে সাইকেলসুদ্ধ পড়ে গেল। সবাই জানে ফেকু নতুন সাইকেল চালানো শিখছে, কিন্তু সেটা কোনো বড় ঘটনা নয়, আসল ঘটনা হলো নবাব শেখ তার পালাদার ফেকুকে দিয়ে নোয়াবালীকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, সামনের ধান ওঠার পরপরই টাকা জমি ফেরৎ না নিলে অথবা বাকি টাকা বুঝে নিয়ে সেটেলম্যান রেকডের্ তার নামে দলিল করে না দিলে জমির মালিকানা তামাদি অথার্ৎ বাতিল হয়ে যাবে...

নোয়াবালী সংবাদদাতার মুখের দিকে তাকিয়ে নিবার্ক হয়ে যায়। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। ফেকু পালাদারের ঠেঁাটে জেল্লাই দেয়া হাসির ঝিলিক, পুরনো ব্যথা ভুলে গেছে আচমকা, বাড়ির ভেতর গোবর নিকানো উঠোনটার দিকে তাকিয়ে থাকে আর কাকে যেন ইতিউতি খঁুজে যায় ওর করাতের মতো তীক্ষè চোখ। নোয়াবালী যতই বিমষর্ এবং নিবির্কার হয়ে যায় ফেকুর মুখটা ততই হাসোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কারণ মনিরের কথা এই প্রথমবার হলেও দাড়ি-কমা-বিস্ময় চিহ্ন ভুল না করে পুরোদস্তুর একেবারে খাপে খাপে বলতে পেড়েছে, এ জন্য তার অহং বোধ হয়।

নোয়াবালীর বুকের পঁাজরটা ভেঙে যায় ভারিক্কিভাবের নবাব শেখের বাক্যবাণে।

ফেকুকে দিয়ে ওমন কঠিন বাক্য না বলালে কি আর চলত না। গতরাত্রি থেকে আকাশটা বড় মুখ গোমড়া করে আছে, যে কোনো মুহূতের্ ঢেলে দেবে হয়তো বা। ঝেঁপে বৃষ্টি এলে রাত্রে ঘুমটা বেশ ভালোই হবে আজ। কতদিন যেন চোখ জুড়ে ঘুম নামেনি, শরীরখানা বড় ক্লান্ত, মাথাটাও কেমন ভারী-ভারী ঠেকছে, যাবতীয় সাংসারিক চিন্তাভাবনা ছেড়েছুড়ে নোয়াবালী এখন থিতু হয়ে যায় আকস্মিকভাবে।

ফেকুকে অনেকদূর থেকে দেখা যায় সাইকেল দাবড়িয়ে চলে যাচ্ছে, সকালের রোদটাকে আজ বড় অদ্ভূত লাগে। আম-কঁাঠাল-জাম-তাল-নারকেল-খেজুরের মাথায় রোদের তেরছা আভায় ভরে গেছে, ওদিকের বঁাশঝঁাড়ের ভেতর দিয়ে পায়ে চলা পথটার দিকে অনিের্মষ নয়নে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা কেমন ভারি হয়ে যায়। ছহিদুল-মতিবানু আর নবাব শেখ একটু একটু করে এগিয়ে আসছে টাকার জন্য, ফেকুর চোখে হাসি। ইজ্জত ঘরামির মুখ ভেসে আসে, এক সময় দুজনের খুব দোস্তি ছিল, গতবারের বন্যায় সাপের দংশনে মানুষটা জগৎ সংসার ছেড়ে পালিয়ে গেল একেবারে। নোয়াবালীর চোখ দুটো স্থির এবং শীতল হয়ে আসে। চারদিকে এর মধ্যে শুরু হয়ে গেছে কিসের ডামাডোল। সব মানুষ তোড়জোড় করে এগিয়ে আসে কিছু একটা ঘটনা দেখার জন্য। কিন্তু কেউ আর কথা বলে না। কারো ঠেঁাট নড়েচড়ে না, অনেক দূরে একটা দঁাড় কাক কা-কা-কা স্বরে ডেকে যায়, ডেকে-ডেকে মরে, সকরুণ বিষণœ সেই সুর ! সবাই স্তম্ভিত হয়ে থাকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<22614 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1