বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পিকাসো নানা দিকে নানা রঙে

পীযূষ কান্তি বড়–য়া
  ০৯ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

নতুন পথে হঁাটাই সৃজনশীল মানুষের মৌলিকত্বের বিজ্ঞাপন। শিল্পের নতুন পথ তৈরি করে নেয়াই তার আজন্ম সাধনা। প্রচলিত পথে সৃজনশীলতা নিয়ে পথ চলা মানে এক অথের্ অনুকরণ ও অনুসরণ। তাতে শিল্পের কোনো উপকার তেমন হয় না, হয়তো সংখ্যায় বাড়ে। সৃজনশীল শিল্পে যে যত বড় উদ্ভাবক সে তত কালজয়ী। সেই অথের্ পৃথিবীর সকল প্রথমই কালজয়ী। তেমনি যিনি শিল্পের পথে না হেঁটে শিল্পকে নিজের পথে হঁাটাতে পেরেছেন তিনিই কালজয়ী। এরকম এক কালজয়ী মহান শিল্পী পাবলো রুইজ পিকাসো যাকে পৃথিবী চেনে পাবলো পিকাসো নামেই।

‘চেয়ে নিই না, খুঁজে নিই’

কী এমন ছিলেন তিনি? প্রশ্ন উঠতেই পারে। কী ছিলেন না তিনি? উত্তরও এ প্রশ্নেই দেয়া যেতে পারে। বিংশ শতাব্দীর সেরা প্রভাবশালী চিত্রকর তিনি। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি চেয়ে নিই না, খুঁজে নিই।’ এই খেঁাজ মানেই হলো শিল্পের সাধনা, নতুনকে আলোয় আনার প্রসূতি-প্রয়াস। চিত্রশিল্পের ইতিহাসে পাবলো পিকাসো এক স্ফুরিত মহাপ্রতিভা। ১৮৮১ সালের ২৫ অক্টোবর স্পেনের মালাগায় জন্ম তার। ১৯৭৩ সালের ৮ এপ্রিল ৯১ বছর বয়সে শিল্পের দেশ ফ্রান্সের মগিন্সে মহাকাব্যিক এই জীবনের যবনিকা। সুদীঘর্ ৭৮ বছরের সৃজনশীল জীবনে ১৩,৫০০ পেইন্টিং, এক লাখ ছাপচিত্র ও খোদাই এবং ৩৪ হাজার অলঙ্করণ করে গেছেন পিকাসো।

সাহিত্যে যেমন শেক্সপিয়ার, মনোবিজ্ঞানে সিগমান্ড ফ্রায়েড, তেমনি চিত্রকলায় পাবলো পিকাসোই ভুবনজয়ী বীর। শিশুকাল থেকে নিজেকে চিনিয়ে দেয়া জাতশিল্পী পিকাসোই বলেছেন, ‘সব শিশুই একজন শিল্পী, বড় হতে হতে সেই শিল্পীসত্তা বজায় থাকাটাই সমস্যার কথা’।

‘পিজ পিজ’ ও পিকাসো

বাবা ডন হোসে রুইজ বøাসকো ছিলেন চিত্রকর ও অঙ্কনশিল্পের অধ্যাপক। সাত বছর বয়সে তার কাছেই পিকাসোর ছবি অঁাকায় হাতে খড়ি। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই বাবাকে ছাড়িয়ে যায় পুত্র পাবলো। ১৩ বছরেই পাবলো হয়ে ওঠে স্পেনের ইতিহাসে সেরা প্রতিকৃতি শিল্পী। তার অঁাকা পোট্রের্ট ‘আন্ট পেপা’ সেরা প্রতিকৃতির খ্যাতি পায় স্পেনে। মা মারিয়া পিকাসো লোপেজের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে তার ছোটবেলার প্রথম শব্দ উচ্চারণের কথা। সবাই যেখানে প্রথম উচ্চারণে ডাকে মাকে, সেখানে পাবলোর প্রথম বোল ছিল ‘পিজ পিজ’! ‘পিজ’ আসলে লাপিজ যা স্পেনীয় ভাষায় বোঝায় পেন্সিলকে। বড় হয়ে পেন্সিলই তার আপন-সখা হয়ে দঁাড়ায়। অথচ মা পাবলোকে বলেছিলেন, সে যদি পড়ামোনা করে তবে জেনারেল পদবির সেনা কমর্কতার্ হতে পারবে আর যদি আধ্যাত্মিক জগতে যায় তবে তার পক্ষে পোপ হওয়া সম্ভব। মা চাননি পাবলো চিত্রকর হোক। কিন্তু ভবিতব্য ঠেকায় কে? আন্দালুসিয়ার অধিবাসী বলেই পাবলো পিকাসোর বাপ্তিস্মের পর নামের সঙ্গে জুড়ে যায় অনেক সন্ত ও আত্মীয়ের নাম। ফলে নাম হয়ে যায় বিশাল লম্বা যদিও এই নামের আর কোনো ব্যবহার খুব একটা ছিল না।

পিকাসোর শোক ও নীল পবর্

সাত বছর বয়সী বোন কঞ্চিটা ডিপথেরিয়ায় মারা যাওয়ার পরে পাবলোর পরিবারে আসে শোক। এই শোকের পর প্রিয় বন্ধু কালোর্স ক্যাসাগেমার আত্মহত্যা পাবলোকে বিষাদে ভরিয়ে দেয়। শোকাতর্ পাবলো একের পর এক এঁকে যান বিষাদের ছবি। স্পেন থেকে ফ্রান্সে এসে তিনি দারিদ্র্য আর ঠাÐার প্রকোপে কাতর হয়ে পড়েন। তার এ সময়ের সঙ্গী কবিবন্ধু ম্যাক্স জ্যাকব যার কাছে তার ফরাসি ভাষায় হাতে খড়ি। ঠিক এসময়টাতেই পাবলো ও তার কবি বন্ধুর তকমা লেগে যায় স্টাভির্ং আটির্স্ট বা উপোসী শিল্পী হিসেবে। পেটে ক্ষুধা নিয়ে বিছানার অভাবে একজন রাতে জেগে ছবি অঁাকতো আর অন্যজন দিনে লিখতো কবিতা। পিকাসো রাত ১০টা-১১টা থেকে ছবি অঁাকা শুরু করতেন এবং সারারাত ধরে ছবি এঁকে দিনে ঘুমাতেন। কখনো কখনো প্রবল ঠাÐা থেকে বঁাচতে আগুন পোহাত নিজেদের অঁাকা ছবি কিংবা রচিত কবিতা পুড়িয়ে। ১৯০১ থেকে ১৯০৪-এর সময়কালে তার ছবিতে ফুটে উঠেছে দারিদ্র্য। ছবির বিষয়ে উঠে এসেছে ভিখারি, অন্ধ মানুষ, অপুষ্টি, গরিব মানুষ, পতিতা, ভবঘুরে ইত্যাদি। তার বন্ধু ক্যাসাগেমার মরণোত্তর প্রতিকৃতিও তিনি এঁকেছেন অনেক। ছবির পশ্চাৎ পটের রং থেকে শুরু করে ছবির মূল বিষয়ে ছিল কেবল নীল আর নীল আর মূল বিষয়ে ছিল নীল ও সবুজাভ নীলের সমাহার। নীল হলো বিষাদের রং। গ্রিক পুরাণমতে দেবরাজ জিউসের কষ্টেও মেঘের রং যেন হয়ে যায় নীল। এই নীলকেই তিনি বেছে নিয়েছেন তার কষ্টের সময়ে। তাই একে বলা হয় বøু পিরিয়ড বা নীল পবর্। স্বয়ং পিকাসোই বলেছেন, নীল হলো রঙেদের রং, কালার অব কালারস। নীল পবের্র চিত্রকলা সম্পকের্ পিকাসো স্বীকার করেছেন, বন্ধুর অকাল আত্মখুনের পর থেকেই তার নীলযুগের সূচনা। এ পবের্র ছবিগুলো হলোÑ জায়মে সেবাতিের্সর প্রতিকৃতি (বন্ধুকে অঁাকা প্রথম বøু পিরিয়ডের ছবি), সোমরসপায়ী, হেলানো ভঁাড়, নারী ও কবরী, ক্যাসাগেমার মৃত্যু, আত্মপ্রতিকৃতি, নীল হ্যাট ও নারী, সিগারেট ও নারী, লোভী মেয়ে, দ্য ভিজিট (দুই বোন), নারীর মস্তক, মাতাল ক্লান্ত নারী, বুড়ো গিটারবাদক, অন্ধলোকের প্রাতঃরাশ, দ্য ট্র্যাজেডি, বুড়ো ইহুদি ও বালক, কৃচ্ছ্রতা সাধক ইত্যাদি।

ধীরে ধীরে বিষণœতা হতে পাবলো নিজের উত্তরণ ঘটিয়েছেন ১৯০৪ থেকে ১৯০৬-এ অঁাকা ছবিগুলোতে যখন তার প্রফুল্লতার আশ্রয় গোলাপি আর লাল। কখনো কখনো কমলা বণের্র বাহার। তাই এসময়ের কমর্জীবন ‘রোজ পিরিয়ড’ নামে অভিহিত কেননা ফরাসিতে পিংক মানেই রোজ। গোলাপি পবের্র ছবির বিষয় সাকাের্সর ক্লাউন, অভিনেতা, অপ্রকৃত অবয়বের নারী ইত্যাদি। রোজ বা গোলাপি পবের্র ছবিগুলো হলোÑ অভিনেতা, বসে থাকা নগ্নিকা, মা ও শিশু, যুগল নগ্নিকা, বলের উপর দড়াবাজিকর, ভঁাড় ও গøাস, লাল চেয়ারে বসা ভঁাড়, দুই ভাই, দুই যুবক, পাখা হাতে নারী, যুবনারী ও ফুলের ঝুড়ি, ছাগল ও যুবনারী ইত্যাদি।

পিকাসোর ছবিতে আফ্রিকান প্রভাব তৈরি হয় ১৯০৭ থেকে ১৯০৯ সালের কাল-ব্যাপ্তিতে। এই সময়ের ছবিতে মুখোশের ব্যবহার তাই বাড়তে থাকে। তার ভাষ্যে আমরা পাই, ‘অন্যেরা দেখেছে ‘কী’ এবং জেনেছে ‘কেন’। আমি দেখেছি কী হতে পারতো এবং জানতে চেয়েছি কেন নয়?’ এই হলো পাবলো যার কাছে সৃষ্টিকে ভেঙে গড়াটাই মূল। এ কারণেই তার বলা, ‘প্রতিটি সৃষ্টির আগেই ধ্বংসের জন্ম হয়।’ তাই তিনি তার প্রতিটি সৃষ্টিতে আগের সৃষ্টিকে ভেঙে এগিয়ে গেছেন নতুনের উৎসবে। আফ্রিকান প্রভাব-পবের্র ছবিগুলো হলো : অবগুণ্ঠন-নৃত্য, তিনজন নারী, কৃষকের বউ, নগ্নতা, মানুষের মাথা, নারীর মাথা, নারী বক্ষ, মেরিন বাস্ট, বসে থাকা রমণী, বন্ধুতা ইত্যাদি।

কিউবিজম ও কোলাজ

ব্র্যাকের সঙ্গে পিকাসোকেই মানা হয় কিউবিজমের যুগল জনক হিসেবে। মাতিসের মতো শিল্পীরা যখন রংকে প্রাধান্য দিয়েই ছবিকে ভাবতেন তখন পিকাসো ছবিকে অবয়বমুখী করে তোলার প্রয়াস পেতেন। কেননা, তিনিই জানেন, শিল্প হচ্ছে মিথ্যে যা আমাদের সত্যি অনুধাবনে চালিত করে। অবয়বের বহিচিের্ত্রর মধ্যে বিষয়ের অন্তচির্ত্র ফুটিয়ে তোলাটাই শিল্পীর সাধনা। তাই বণর্চাতুযের্র আশ্রয়ে না গিয়ে মনোক্রোমের মাধ্যমে দশর্ককে বিভ্রান্তহীনভাবে বিষয় অনুধাবনে সহযোগিতা করাটাই ছিল পিকাসোর লক্ষ্য। সাধারণ চিত্রকলা কেবল প্রকৃতি ও তার অনুষঙ্গ নিয়ে মেতে থাকলেও কিউবিজমের জনক পিকাসো মেতেছেন দ্বিমাত্রিক তলে অবয়বের অধ্যয়নে। যে কারণে তার অঁাকা প্রতিকৃতিগুলো হুবহু না হয়ে কিছুটা জ্যামিতিক চিত্রের আদল পায়। তার ছবিতেই ইংরেজি বণর্মালার হরফগুলো অবয়ব নিমাের্ণ জীবন পায় এবং কোনো কোনো ছবিতে এ থেকে জেড ব্যবহৃত হয়েছে অবলীলায় নান্দনিকতা ধারণ করে। ১৯১০ থেকে ১২ সালের মধ্যে শুরু হয়েছে বিশ্লেষণাত্মক ঘনকচিত্রকলা এবং এ সময়ের ছবিতে পিকাসো ও ব্র্যাক প্রায় কাছাকাছি ছিলেন বৈশিষ্ট্যে ও শিল্পগুণে। পিকাসোর পছন্দের নিমিির্ত ছিল অবয়বকে সমকৌণিক ও সরলরৈখিক বিভাজন যেখানে একটি প্রতিকৃতি এক দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝার অবকাশ নেই। এক এক অবস্থান ও দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিকৃতির এক একটি অঙ্গ অবলোকন করা যায় এমন। আর একারণেই পাবলো বিশ্বাস করতেন, শিল্পী হচ্ছে আবেগের ধারক যা পরিপাশ্বর্ থেকে তৈরি হয়। বস্তুত ঘনকচিত্রকলা কিংবা বিশ্লেষণধমীর্ ঘনকচিত্রকলার পক্ষে বলতে গিয়ে পিকাসো একটি কোটি টাকা মূল্যের প্রশ্নবাণ ছুড়েছেন অন্যদের প্রতি, ‘কে মানুষের মুখ শুদ্ধভাবে দেখে? আলোকচিত্রগ্রাহক, আয়না নাকি চিত্রকর?’ এ প্রশ্নের উত্তর থেকেই বিশ্লেষণী ঘনকচিত্রকলাবিদ্যার ভিত নিমার্ণ হয়ে যায়। ব্যক্তির অন্তগর্ত সত্তাকে বের করে আনার ক্ষমতা আদতে আলোকচিত্রী কিংবা আয়না কারুরই নেই। কেবল একজন বিশ্লেষণমুখী ঘনকচিত্রকলাবিদের পক্ষেই বাহ্যিক ফঁাদ এড়িয়ে অন্তরের মানুষটির প্রকৃত অবয়ব নিমার্ণ করা সম্ভব। আমরা লিওনাদোর্ দ্য ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ ছবির হাসির প্রকৃত বিশ্লেষণ থেকেই এই সত্যের পক্ষে যথাথর্ তথ্য সম্পকের্ অবগত হই। পিকাসো যেমন উপলব্ধি করেন, কোনো কোনো শিল্পীর হাতে সূযর্ হয়ে ওঠে হলুদ বিন্দু আবার কারও হাতে হলুদ বিন্দুটিই জ্বলে ওঠে সূযর্ হয়ে। ঠিক তেমনি ঘনকচিত্রকলা ও রংপ্রধান চিত্রকলার মধ্যে এরকমই পাথর্ক্য।

বিশ্লেষণধমীর্ ঘনকচিত্রকলা নিয়ে খেলতে খেলতেই পিকাসো নিয়ে আসেন শিল্পের নতুন এক ধারা ‘কোলাজ’ যাতে অঁাকা চিত্রপটের সঙ্গে সিগারেটের মোড়ানো কাগজের এবং খবরের কাগজের ময়লা ছেঁড়া অংশজুড়ে দেয়া হয় এবং সমাবেশ তৈরি করা হয়। প্রথম প্রথম মনে হতো এ আবার কী? কিন্তু দেখতে দেখতে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কোলাজের মধ্যেই ফুটে ওঠে শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গি, কল্পনা ও বাস্তবের সমন্বয়। একটা বড় প্রশ্নের সমাধান হলো কোলাজের মধ্যদিয়ে। ‘চিত্রপটের উপর পৃথিবীকে ধারণ করা যায় কীভাবে’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে শিল্পীরা যখন ঘমির্সক্ত হয়ে উঠেছেন বলা যায়, কোলাজই তখন সমাধান হয়ে দঁাড়ায়। আর এ কারণেই পিকাসো শিল্পের ব্যাটারি বলতে তল, রেখা রং ও আলোকের সমন্বয়কেই বোঝাতেন। কেননা, এদের কোলাজেই ফুটে ওঠে চমৎকার এক একটি চিত্রগল্প। সাদামাটাভাবে অনন্য শিল্প উপস্থাপন করতে গিয়েই পিকাসো নিজেকে স্টাইলবিহীন চিত্রকর আখ্যা দিয়েছিলেন।

পিকাসোর জীবনে নারী

নারী আর পিকাসোর রসায়ন ততটাই বিপরীত যতটা মজাদার এবং নিবিড় পিকাসো ও চিত্রকলা। নারী হলো পিকাসোর শিল্পদাসী। তাই তার কাছে ‘নারীর যন্ত্রণা সৃষ্টির যন্ত্র’। পিকাসোর কমর্জীবন যেমন রঙের নামে নামে পবর্ ধরে ধরে চলেছে তেমনি ব্যক্তিজীবনকেও নারীর নাম দিয়ে পবর্ হিসেবে উল্লেখ করাটা বাহুল্য হবে না। কারও মতে পিকাসোর জীবনে ছিল সাত নারীর সমাহার। এর মধ্যে দুজন করেছে আত্মহত্যা, দুজনের হয়েছে মনোবিকলন। অনেকের মতে, পিকাসোর জীবনে নারীর সংখ্যা পার হয়েছে শতক। এসব নারীকে পিকাসো ব্যবহার করেছেন মডেল হিসেবে। পনিটেইলধারী লিডিয়া ছিল তার অনেক চিত্রকমের্র মডেল যদিও তার মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত তা প্রচার হয়নি তেমন। চিত্রকমের্র মডেল হওয়ার কারণেই লিডিয়ার নামের আগে পনিটেইল খ্যাতিটা বসে যায় পিকাসোর বদৌলতে। লিডিয়াও শেষমেশ পিকাসোর জৈবিক জীবনের সাথী হয়ে যায়।

তাই বলা যায়, পিকাসোর চিত্রকমের্র অধিকাংশই তার ব্যক্তিজীবনের সচিত্র ধারাবণর্না বই আর কিছুই নয়। আত্মজৈবনিক নারীদের বিকৃত চিত্র এঁকেই পিকাসোর শিল্পীসত্তা যেন বিকশিত হয়েছে, উৎফুল্ল হয়েছে। পিকাসোর হাতে অঁাকা গাটুের্ডর প্রতিকৃতি যেন না নারী না পুরুষ। সারাজীবন গাটুর্ডকে এভাবেই চিত্রে রেখেছেন বিকৃত করে। তার জীবনে তাই নারীর স্থান দ্বিবিধ, হয় দেবী নয় পাপোশ।

পিকাসোর নারীরা সময়কাল অনুযায়ী নিম্নরূপ:

* ফানাের্ন্দা অলিভিয়া-১৯০৪-১৯১১

* ইভা গায়েল-১৯১১-১৯১৫

* ওল্গা খোকলোভা- ১৯১৭-১৯৩৫

* মারি থেরেস ওয়াল্টার-১৯২৭-১৯৩৬

* দোরে মার -১৯৩৬-১৯৪৪

* ফ্রঁাসোয়া গিলিত-১৯৪৪-১৯৫৩

* জ্যাকলিন রোক-১৯৫৩-১৯৭৩

অঁাকা ছবি : বিষয় পিকাসো

পিকাসো তার প্রতিকৃতি এঁকেছেন বেশ কয়েকটা। নিজের পনের বছর থেকে নব্বই বছর বয়স পযর্ন্ত প্রায় পনেরটা আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন। সালভাদর দালি ও ১৯৪৭ সালে পিকাসোর একটি প্রতিকৃতি অঁাকেন।

লেখা বই : বিষয় পিকাসো

* মাকর্ হাডসন - ‘পিকাসো : চ্যালেঞ্জিং দ্য পাস্ট’।

* ফানাের্ন্দা অলিভিয়া- ‘লাভিং পিকাসো’।

* মারি থেরেস ওয়াল্টারের কন্যা মায়ার পুত্র অলিভিয়ার ওয়িদমায়ার- ‘পিকাসো : দ্য রিয়েল ফ্যামিলি হিস্টরি’।

* গাটুর্ড স্টেইনÑ ‘অটোবায়োগ্রাফি অব এলিস বি টোকলাস’।

* গাটুর্ড স্টেইন - ‘ইফ আই টোল্ড হিম, অ্যা কমপ্লিটেড পোট্রের্ট অব পিকাসো’ নামে একটি গদ্য-শব্দাবয়ব।

* নরম্যান মেইলার- ‘পোট্রের্ট অব পিকাসো অ্যাজ অ্যা ইয়াং ম্যান’।

চলচ্চিত্র : বিষয় পিকাসো

* ১৯৯৬ সালে নিমির্ত চলচ্চিত্র ‘সারভাইভিং পিকাসো’। পরিচালক জেমস আইভরির তত্ত¡াবধানে এতে পিকাসোর চরিত্র চিত্রায়ন করেন অ্যান্তনি হপকিন্স। চলচ্চিত্রটি অ্যারিয়ানা স্ট্যাসিনোপুলোস হাফিংটন লিখিত উপন্যাস ‘পিকাসো : ক্রিয়েটর অ্যান্ড ডেস্ট্রয়ার’ অবলম্বনে রুথ প্রাওয়ার জাব্বালার চিত্রনাট্য মোতাবেক নিমির্ত।

নাটক : বিষয় পিকাসো

* নাটকের নাম ‘পিকাসো অ্যাট দ্য ল্যাপিন অ্যাজাইল’। রচয়িতা স্টিভ মাটির্ন। নাটকটির ১৯৯৩ সালের ১৩ এপ্রিল প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয়।

পিকাসো মিউজিয়াম

মুউজে পিকাসো মালাগা নামে একটা জাদুঘর পিকাসোর নামে স্পেনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেখানে তার ছোটবেলা তেকে শিল্পী হিসেবে নিমির্ত হওয়া ও বঁাক বদলের বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করা যায়। ষোড়শ শতকের প্রথমভাগে নিমির্ত বুয়েনাভিস্তা প্যালেস নামে এক ভবনের ৮ হাজার ৩০০ বগির্মটার স্থানজুড়ে ২০০৩ সালে এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে পিকাসোর পারিবারিক সদস্যরা পিকাসোর ২২৫টি চিত্রকমর্ দান করেন।

পিকাসোর রসরঙ্গ

একদিন সমুদ্রতটে এক ছোট্ট বালক কুড়োনো এক কাগজ এনে পিকাসোকে দিয়ে বলল অটোগ্রাফ দিতে। বালকটিকে দেখেই তার সন্দেহ হলো, এত ছোট ছেলে কি পিকাসোর ছবি বুঝবে? তিনি জিজ্ঞেস করলেন, অটোগ্রাফ নিতে কে পাঠিয়েছে। জবাবে শিশুটি পিছন ফিরে তার বাবা-মাকে দেখিয়ে দিল। পিকাসো তখন তার হাতে দেয়া কাগজের টুকরোটি ফেলে দিয়ে শিশুটার পিঠে একটা স্কেচ এঁকে স্বাক্ষর দিয়ে দিল। কেউ একজন তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই পিকাসো জবাবে বলেছিল, আমি দেখতে চাই, শিশুটির পিঠে অঁাকা স্কেচটি তার বাবা-মা কতদিন সংরক্ষণ করতে পারবে।

পিকাসো একবার খেতে গেলেন এক রেস্টুরেন্টে। দোকানদার তাকে প্রস্তাব দিল, একটা অটোগ্রাফ দিলে সে পিকাসোকে বিনামূল্যে খেতে দেবে। পিকাসো তখন মুচকি হেসে বলেছিল, ‘আমি কেবল আমার খাবারের বিল পরিশোধ করতে চাই, রেস্টুরেন্ট কেনার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।’

রাজনীতিবিদ পিকাসো ও শান্তির প্রতীক

বিশ্বযুদ্ধের দামামায় তার বন্ধুদের অনেকেই যুদ্ধে গেলেও ফ্রান্সের অধিবাসী নয় বলে পিকাসোকে যুদ্ধ যেতে দেয়া হলো না। কিন্তু যুদ্ধশেষে পিকাসো পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট পাটিের্ত যোগ দেন এবং বিখ্যাত চিত্রশিল্পীকে নিজেদের দলে পেয়ে পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট পাটির্ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালে পোল্যান্ডে শান্তি সম্মেলনেও পিকাসো যোগ দেন। মূলত তার বান্ধবী দোরে মার-এর উৎসাহে পিকাসো কমিউনিস্ট রাজনীতির দিকে আগ্রহবোধ করেন এবং রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এই শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়ার সময় পিকসোকে বলা হয় একটা অঁাকা ছবি প্রতীক হিসেবে নিয়ে যেতে। কিন্তু সময়ের অভাবে পিকাসো সেই মোতাবেক কোনো প্রতীক অঁাকতে না পারায় দলীয় কমীর্রা পিকাসোর স্টুডিওতে এসে একটা পায়রার ছবি নিয়ে যায় এবং তা পোল্যান্ডের শহরে টাঙিয়ে দেয়। ১৯৪৮-এর এই পায়রা প্রতীকই আজ বিশ্বজুড়ে শান্তির পায়রা বা শান্তির প্রতীক হয়ে বেঁচে আছে। নিজের জীবনজুড়ে অন্তগর্ত বেদনায় যিনি নীল হয়েছেন তারই অঁাকা পায়রা হয়েছে সাবর্জনীন শান্তির প্রতিচ্ছবি।

মোনালিসার হুমকি ও অন্যান্য

ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে বেশ কয়েকটা চোরাই চিত্রকমর্ কিনে নিয়েছিলেন পিকাসো যদিও তাতে মোনালিসার ছবিটা ছিল না। কিন্তু চুরি হয়ে যাওয়া মোনালিসার ছবির খেঁাজে পিকাসোর বাসায়ও তল্লাশি করে পুলিশ যা পিকাসোকে ভড়কে দিয়েছিল বেশ। শেষমেশ পিকাসো ওই ছবিগুলো নদীতে ফেলতে মনস্থির করেছিলেন যদিও পরে ফেলেছিলেন কিনা তা জানা যায় না। নিজে যেমন চুরি যাওয়া চিত্রকমর্ কিনেছিলেন তেমনি তার চিত্রকমর্ও নেদারল্যান্ডের কুন্সখাল মিউজিয়াম থেকে চুরি যায় অন্য আরও পঁাচজন নামি চিত্রকরের চিত্রকমের্র সঙ্গে। অপরাধী ধরা পড়ায় অপরাধীর মা ছবিগুলো পুড়িয়ে ফেলেন। ফলে ভষ্ম ছাড়া চিত্রকমর্গুলো আর পাওয়া যায়নি।

অথচ পিকাসোর বাসগৃৃহে নিজের অঁাকা কোনো ছবি নেই। এ প্রসঙ্গে এক জিজ্ঞাসার জবাবে তার বাসায় আগন্তুককে পিকাসো বলেন, ‘আমি এত বড় ধনী নই যে পাবলো পিকাসোর ছবি আমার ঘরে টানাতে পারি।’ এই হলো হেঁয়ালির রহস্যে ভরা পিকাসো।

‘যৌবনের কোনো বয়স নেই’ এই আপ্তবাক্যে বিশ্বাসী পিকাসো যুদ্ধের ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে ছিলেন প্রতিবাদী। ‘কোরিয়া ম্যাসাকার’ ছবিতে তিনি কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সংঘটিত ভয়াবহগার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। নিজের কান্ট্রিসাইড গ্রামে অমানবিক আক্রমণে তছনছ করে তোলার বিরুদ্ধে তিনি অঁাকেন বিখ্যাত চিত্রকমর্ ‘গুয়েনির্কা’ যা যুদ্ধবিরোধী সবাের্পক্ষা আধুনিক উপায়ে প্রতিবাদের শিল্পবিবৃতি।

বিখ্যাত চিত্রকমর্

‘আভিগনন শহরের বারবনিতা’ তার একটি উল্লেখযোগ্য শিল্পকমর্ যা ১৯০৭ সালে কিউবিজম বিপ্লবের পূবের্ অঙ্কিত। ছবিটাতে বাসেের্লানার আভিগনন শহরের রাস্তায় পঁাচজন নগ্নিকা বারবনিতাকে দেখা যায় যাদের মধ্যে আফ্রিকান মুখোশ-শিল্পের প্রয়োগ দেখা যায় এবং এরা কেউ সহজাত নারীদেহধারী নয়, কিছুটা বিকৃত। এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গ সামঞ্জস্যহীন। এর মধ্যে বঁা দিকের তিনজন নগ্নিকার দেহে বাসেের্লানার পাশ্বর্বতীর্ আইবেরিয়ান সংস্কৃতির ছাপ পাওয়া যায়।

‘গুয়েনির্কা’ ছবিটি ১৯৩৭ সালে অঁাকা যাতে গুয়েনির্কা গ্রামে স্পেনে গৃৃহযুদ্ধকালীন জাতীয়তাবাদী সরকারের নিদেের্শ জামার্ন ও ইতালিয়ান সৈন্যরা বোমা মেরে ধ্বংসলীলা চালায়। এই ছবিটি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ।

এরপর ৯ম পৃষ্ঠায়

পিকাসোর অঁাকা ‘উওম্যান অব আলজিয়াসর্’ ছবিটি বিশ্বের এ পযর্ন্ত সবোর্চ্চ দামে বিক্রি হওয়া চিত্রকমর্ যার দাম ১৭ কোটি ৯৯ লাখ ৬৫ হাজার মাকির্ন ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় ১৪০ কোটি টাকা। কিউবিক ধারায় উজ্জ্বল তৈলরঙে অঁাকা ছবিটিতে এক বসনহীনা নারীকে দেখা যায় যাতে ইংরেজি এ থেকে ও পযর্ন্ত বণর্মালার ফমর্ ব্যবহৃত হয়েছে। ছবিটি ১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে অঁাকা।

পিকাসো ও সালভাদর দালি

পিকাসো এবং সালভাদর দালি দুজনেই জন্মসূত্রে স্পেনিশ। মালাগা এবং কাতালান তাদের জন্মস্থান। পিকাসোর চেয়ে ২২ বছরের ছোট সালভাদর দালি ১৯২৬ সালে ফ্রান্স সফরকালে পিকাসোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিকাসোর প্রতি দালির সীমাহীন শ্রদ্ধা ছিল। ল্যুভর মিউজিয়াম দেখাকে তুচ্ছ করে দালি সাক্ষাৎ করেছিলেন পিকাসোর সঙ্গে। এই দুই বিখ্যাত শিল্পী নিজেদের সাক্ষাতে কী বলেছিলেন তা জানা যায় না। তবে এরপর গালা দালি ও দালি নিজে পিকাসোকে কমপক্ষে ১০০টি চিঠি ও পোস্টকাডর্ পাঠিয়েছিলেন। পিকাসো দালিকে সম্মান জানিয়ে ১৯৩৪ সালে নিউ ইয়কের্ তার ছবির প্রদশর্নীতে দালিজ স্পেস নামকরণ করে সৌজন্য প্রদশর্ন করেন। ১৯৪৭ সালে সালভাদর দালি পিকাসোর একটি প্রতিকৃতি অঙ্কন করেন যাকে তিনি নাম দেন ‘পোট্রের্ট অব পাবলো পিকাসো ইন টুয়েন্টি ফাস্টর্ সেঞ্চুরি’। ধারণা করা হয় এর মাধ্যমে দালি পিকাসোকে খাটো করেছেন। এতে পিকাসোর মাথাটিকে একটি পাদবেদীর ওপর স্থাপন করা হয় এবং তার ব্রেইন বা মস্তিষ্ক থেকে চামচ আকারে একটি বঁাশিকে নিগর্মন করা হয়। বুকখানি পাদানির ওপর অলস বিছিয়ে রাখা হয়েছে। দালির স্ত্রী গালা দালির মতে পিকাসো শিল্পকে ধ্বংস করেছেন কেননা তার অঁাকা ছবিগুলোতে অবয়বগুলো কুৎসিত ও বিকৃত। পক্ষান্তরে দালির ছবিতে মুখগুলো সৌন্দযর্মÐিত। দালি ও পিকাসো যুগপৎ প্রতিদ্ব›দ্বী ও গুণগ্রাহী ছিলেন।

পিকাসোর অঁাকা ‘পোট্রের্ট অব ওলগা’ এবং দালির অঁাকা ‘পোট্রের্ট অব মাই সিস্টার’-এর মধ্যে প্রচুর মিল পাওয়া যায়।

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো যিনি আজও তার স্থান থেকে বিন্দুমাত্র চ্যুত হননি তার ভিন্নতার জন্য, তার দূরদশির্তার জন্য। একাধারে চিত্রকর, ভাস্কর, খোদাইশিল্পী, ছাপ চিত্রশিল্পী, অলঙ্করণবিদ, শিল্পদাশির্নক, নাট্যকার ও কবি পাবলো পিকাসোর প্রভাব আজও সেই উচ্চতায় আছে যেমনটি ছিল সূচনালগ্নে কিংবা জীবিতকালেও। কিউবিজমের সহ-সূচনাকারী, কোলাজ শিল্পধারার প্রবতর্ক, পরাবাস্তব চিত্রকলার দৃঢ় ধ্বজাধারী পাবলো পিকাসো নিজেই স্বয়ং একটি প্রতিষ্ঠান। তাকে কখনো অ্যাবস্ট্রাকশনিস্ট, কখনো কিউবিস্ট, কখনো সুররিয়ালিস্ট, কখনো ক্লাসিসিস্ট হিসেবে আমরা অবতীণর্ হতে দেখি। কখনো কখনো মনে হয় তিনি একজন স্যাডিস্ট যার চিত্রমালায় বিকৃতভাবে উপস্থাপিত নারীরা নিজেরাই কষ্ট পায় আজীবন, পিকাসোকে আনন্দ দিয়ে। পিকাসো দিনশেষে থেকে যান পিকাসো-ই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<21539 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1