শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

লাল নীল বেগুনি উৎসবে সুলতানা আফরোজ

সালেহ আহমাদ
  ০৬ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

[গত সংখ্যার পর]

সামাদ বাই খঁা বংশের পোলা ঠিকই। তয় আপনার লগে এক্কেবারেই মানায় নাই!

আবার হাসলো সুলতানা আফরোজ। হাসির মাঝেই বলল, ঠিক আছে বাজারে যাও। রহমান চলে গেল। সুলতানা আফরোজ দঁাড়িয়েই থাকল। তার মনে হলো, রহমানকে যতটা বোকা মনে হয় তার চেয়েও বেশি বোকা। সামাদের সাথে তাকে মানায়নি, কোনো অতিমাত্রায় বোকা লোকের পক্ষেই কেবল এমনটা বলা সম্ভব। একটা বিষয় তাকে স্বীকার করতেই হবে, রহমানের শুধু দৈহিক গড়ন নয় মুখের গঠনও দেখার মতো। সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে হলো, সে এমন করে রহমানকে নিয়ে ভাবছে কেন? বাড়ির কাজের মানুষ সম্পকের্ তার মতো উচ্চবংশীয় গৃহবধূর এমন ভাবনা শুধু অশোভন নয় নীতিবিরুদ্ধও। সুলতানা সিদ্ধান্ত নেয়, রহমানের সামনে সে আর আসবে না। রহমানের সঙ্গে কথাবাতার্ যা বলার সখিনা খালাই বলবে। সে দোতলায় চলে আসে।

সুলতানা আফরোজ টেলিভিশন অন করে জানালার পাশে বসে। একটার পর একটা চ্যানেল চেঞ্জ করতে থাকে। কোনো অনুষ্ঠানেই তার মন বসে না। টেলিভিশন বন্ধ করে মোবাইল হাতে নেয়। কাকে ফোন করবে বুঝতে পারে না। বিছানায় ঢিলের মতো করে মোবাইল ফেলে দেয়। সামাদের কথা মনে হয়। রহমানের কথাও মনে হয়। রহমানকে এড়িয়ে যেতে চায়, পারে না। তার বারবার মনে হয় রহমানের বলা কথা-‘তয় আপনার লগে এক্কেবারেই মানায় নাই! তয় আপনার লগে এক্কেবারেই মানায় নাই! তয় আপনার লগে এক্কেবারেই মানায় নাই! রহমানের কণ্ঠ ছিল চমকিত। বিয়ের পর অনেক বন্ধুরাও তাকে বলেছিল, বানরের গলায় মুক্তার মালা। সামাদ উচ্চবংশীয়, এ কথাটা কারো মাঝে প্রভাব ফেলেনি। তো সামাদ তাকে প্রচÐ ভালোবাসে এটা ঠিক।

বিয়ের ক’দিন পরই সুলতানা বিশ্বাস করতে থাকে, সামাদ জোড়াতালি দেয়া পুুরুষ। সত্যিকার পুরুষ সে নয়। অনেক মেয়েদের জীবন বরবাদ করার জন্য কিছু মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে সামাদও রয়েছে। বিষয়টা সামাদও বুঝতে পারে। আর বুঝতে পেরেই পালিয়ে বঁাচতে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।

সুলতানা নিয়তি মেনে নিয়ে বলে, বিদেশ যাওয়ার দরকার কি? তোমাদের এত সম্পত্তি। ওগুলো দেখাশোনা করলেই হয়? তার কথা সামাদ শোনেনি। বলেছে, এই ক’টা বছর মাত্র। ধলেশ্বরী মরে গেছে। আমাদেরও মেরে গেছে। জমিজমা সবই এখন বালুচর। বাইরে যেটুকু আছে, তা দিয়ে বেঁচে থাকার সুখ আসবে না। ছয় মাসের মধ্যেই সামাদ চলে গেল।

রহমানের ডাকে সুলতানার চিন্তাস্রোত থেমে যায়। দৌড়িয়ে নিচে নেমে আসে। বলে রহমান সব এনেছ?

ব্যাগ খুলে দেখেন, ভুল য়ইছে নাকি।

ব্যাগ দেখে বলে, না তোমার কোনো ভুল হয়নি। বাচ্চাদের স্কুল কিছুক্ষণ পরই ছুটি হবে, তুমি যাও। আর শোন, দুপুরে তুমি এখানে খাবে।

তার দরকার নাই ভাবী। আমি হইটালে নাস্তা করমু।

অত কথা বলো না, বলছি খেয়ে যাবে, ব্যস। সখিনা খালাকে বাজার নেয়ার কথা বলে সুলতানা আফরোজ দোতলায় চলে আসে। রুমে আসতেই ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তার চোখ পড়ে। সুলতানা আবিষ্কার করে, তার গায়ে ওড়না নেই! চমকে যায় সুলতানা। রহমানকে এভয়েট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিছুক্ষণ আগে। আর রহমানের কণ্ঠ শুনে সে ওড়না পরার কথাই ভুলে গেছে! বিস্মিত হয় সুলতানা। সে যতটা রহমানকে দূরে রাখাতে চাইছে, রহমান ততই তার নিকটে আসছে। সুলতানা বুঝতে পারে না, তার এমনটা হওয়ার কারণ কী? এটা কী রহমানের পৌরুষসুলভ দেহ, না তার দেহের দীঘির্দনের অতৃপ্তি? বাচ্চাদের পদশব্দে বাস্তবে ফিরে আসে সুলতানা। অনেকদিন পর অনৈতিক চিন্তা থেকে মুক্তি দিতেই যেন এ সময় বাচ্চাদের আগমন, এমন ভাবনায় বাচ্চাদের অনেক আদর করল। বাচ্চারা বুঝতে পারল না, আজকে মায়ের এ অভিনব ব্যবহার কেন? সুলতানা বলল, আমার প্রিয় বাবা-মা, চেঞ্জ হয়ে এসো, খাবে। আমি খালাকে বলে দিচ্ছি খাবার দিতে। ইচ্ছে করেই রহমানের কথা জিজ্ঞেস করল না। ভাবল, দেখি কি হয়- রহমান খেয়ে যায় কি না। টিভি অন করল সুলতানা।

বাচ্চারা খেয়ে রুমে ফিরে আসতেই সুলতানার মনে হলো, তার ক্ষুধার ভাব হয়েছে। সুলতানা নিচে নেমে এলো। সখিনাকে খাবার রেডি করতে বলে ওয়াশরুমে ঢুকল। সখিনা বলল, খাবার রেডি করতে দেরি হবে খালাম্মা।

কেন? দেরি হবে কেন?

রহমান ভাই খাইছে। খালাম্মা গো খালাম্মা, একজন মানুষ এত খাইতে পারে, আমি বাপ-দাদার জন্মেও দেহি নাই। সখিনা উচ্চকণ্ঠে হাসতে থাকে।

সুলতানার মুখেও হাসি আসে। হাসি লুকিয়ে বলে, এতে হাসির কি আছে খালা- যেমন দেহ তেমনিতো খাবে নাকি?

তাই বলে তিনজনের খাওন একা! সখিনার কণ্ঠে বিস্ময়।

ঠিক আছে এরপর যেদিন খাবে সেদিন বেশি করে রান্না করবা। গঁায়ের মানুষ। কখনো খাওয়ার খোটা দেবে না। এইড্যা কি কইলেন খালাম্মা খাওনের খোটা দিতে যামু কোন দুঃখে। আর রহমান ভাইয়ের গায় ষঁাড়ের শক্তি।

তা বুঝলা কেমনে খালা?

আমি কইলাম, রহমান ভাই এই পাটাটা একটু সরিয়ে দাও তো। আবার কইলাম আমার কি ধরন লাগব। রহমান ভাই আমার কথার জবাব না দিয়া আমার দিকে এমন কইরা চাইল, যেন এই কামডা তার জন্য কিছুই না।

তুমি কি রহমানের সাথে পাটা ধরেছিলা?

কিযে কন খালাম্মা! রহমান ভাই বামহাত দিয়াই পাটা সরাইয়া ফালাইল। আমি কইলাম, আপনার গায়তো দশজনের জোর!

তো কি বলল রহমান?

কিছুই কইল না। একটু হাসল। তারপর কইল, ভাবীরে কইবেন, প্যাট ভইরা খাইছি।

আমি ওপরে গেলাম। খাবার হলে খবর দিও খালা।

সুলতানার ভাবনায় সামাদ এলো। গত সাতদিনে সামাদ মাত্র একবার টেলিফোন করেছে। এর আগে দুইদিন পরপরই টেলিফোন করত। এবার ব্যতিক্রম। বিদেশে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় জানে সুলতানা। তাই বলে সাতদিনে একবার টেলিফোন করা কেন? সামাদকে হটিয়ে ভেতরে জায়গা নেয় রহমান। তিনজনের খাবার একা খেতে পারে- বিষয়টি তার খারাপ লাগে না। বরং ভালো লাগে। তার দাদাকে দেখেছে, গ্রামে যারা বেশি খেতে পারত, তাদের দাওয়াত দিত। সবাই খেত, দাদা বসে বসে দেখত। যে সবার চেয়ে বেশি খেতে পারত, তাকে পুরস্কারও দিত। দিন কত পাল্টে গেছে! এখন যে বেশি খায়, তাকে কেউ খাবার কথা বলেই না। সুলতানা সিদ্ধান্ত নেয়, দাদার মতো সেও একদিন রহমানের খাবার খেতে দেখবে। দাদার মতো বলবে, সামনের সব খাবার খেতে পারলে বকশিশ পাবে।

সুলতানা রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই অতীত তার সামনে চলে আসে।

ছোট শহরের সব’চে স্মাটর্ মেয়ে হিসেবে খ্যাতি ছিল তার। প্রচুর বন্ধু ছিল। শহরের পরিচিত মুখ তার বাবা-মামারা। একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি তার বাবা। মামাদের সম্পদ আরও বেশি। দুই ভাইয়ের একটি মাত্র বোন- কত আদরের ছিল সে। সেই সুলতানার সব আছে অথচ কেউ নেই। কত বছর হলো, বাবা-মায়ের সঙ্গে তার দেখা নেই। ভাইয়েরা এসে নিচ থেকেই চলে যায়। কারো সঙ্গে তার কথা বলতে ভালো লাগে না। সারাক্ষণ একা থাকে। দোতলা থেকেও তার নামতে ইচ্ছে করে না। রূপ আর যোগ্যতা দিয়ে দুনিয়াটা জয় করতে চেয়েছিল যে সুলতানা, সে আজ স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব গ্রহণ করে আছে। কেন?

সামাদকে সে বিয়ে করতে চায়নি। বাবার বন্ধুর ছেলে। সামাদের বাবা খঁা সাহেব বনেদি পরিবারের। সামাদের যোগ্যতা মোটামুটি। শুধু পরিবারের কারণেই তাদের মতো একজন তার স্বামী। মেনেও নিয়েছিল সুলতানা। বিয়ের আগে সামাদ মাঝে মাঝেই তাদের বাড়িতে এসেছে। টুকটাক কথা হতো। খাট শ্রেণির একজন হলেও মানুষ হিসেবে খুব একটা খারাপ লাগেনি তার। কিন্তু কখনো একমুহূতের্র জন্যও স্বামী হিসেবে ভাবেনি। সেই সামাদ তার স্বামী হলো। ভেবেছিল অনেকের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। অনেকের অনেক চাওয়া অধরা থেকে যায়। বিয়ের পর দেখলো, সামাদ একজন জোড়াতালি দেয়া মানুষ। জোড়াতালি দেয়া কোনো পুরুষ কোনো নারীর পছন্দ নয়। প্রথম প্রথম তার মনে হয়েছিল, এটা কেটে যাবে-কাটেনি। তার মানসিক কষ্ট বাড়তে থাকে। মুখে কিছু বলে না। একটা অশান্তির জালে আটকে যায়। যে হাসি দেখে বন্ধুরা বলতো, ভুবনজয়ী হাসি- সেই হাসি মিলিয়ে যেতে থাকে। তার মুখের কথা কখনো শেষ হতে চায়নি। কথা বলতে কতই না ভালো লাগত। তার কথা বলার ধরন ছিল অপূবর্। সে কথা শুনে বন্ধুরা বলতো- সুলতানা আফরোজ কথার জাদুকর। সেই কথা তার থেমে যেতে থাকে। কথা বলার মধ্যে সে আগের মতো প্রাণের স্পন্দন খঁুজে পায় না। বাইরে ঘোরাঘুরি করতে ছোট শহরে আর একজনও ছিল না তার মতো। দৌড়ে দৌড়ে চলত। বন্ধুরা বলত, সুলতানা আফরোজ সাদামেঘ। ছুটে চলাই তার কাজ। একদÐও স্থির থাকা তার স্বভাবে ছিল না। উচ্ছল চিরচঞ্চল সেই আফরোজ এসব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব গ্রহণ করে চার দেয়ালের ভেতরে। সামাদ বিষয়টি বুঝতে পারে। সে চেষ্টা করে নিরলস কিন্তু পারে না। সামাদ বিশ্বাস করতে থাকে শুধু সুলতানা নয়, একটি মেয়ে যেভাবে চায়, সেভাবে দেয়ার ক্ষমতা তার নেই। অসময়ে সে সময়ের কাজ করে নিজেকে অনেকটা দুবর্ল করে ফেলেছে। হাজারও চেষ্টাতেও সেখানে নিজেকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সে কারণেই বাবার অঢেল সম্পত্তি রেখে বিদেশ পাড়ি দেয়। সুলতানা বলেছিল, পালিয়ে যাচ্ছ?

না পালিয়ে যাচ্ছি না। নিজেকে ফিরে পাওয়ার মিশনে যাচ্ছি।

ডাল ভেঙে গেলে অনেক যতেœর পরও সে পূবার্রূপ ফিরে পায় না। চলছে তো, চলুক। আমিতো কোনো অনুযোগ অভিযোগ করছি নে। তবু পালিয়ে যাবে কেন?

পালিয়ে যাওয়া বলছ তুমি? আমি তেমন করে ভাবছি না। আমার ভাবনা বিয়ের আগে দেখা সুলতাকে ফিরিয়ে আনা।

ঠিক আছে চেষ্টা কর। সামাদ চেষ্টা হয়ত করেছে। তবে নিজেকে ফিরে পায়নি । আর ফিরে পায়নি বলেই তিন বছর পর এসেও তিন মাসের অধিক সময় সে দেশে থাকেনি একবারও।

বাচ্চাদের কথায় বতর্মানে ফিরে আসে সুলতানা আফরোজ। ছেলে তারেক বলল, আম্মু রহমান চাচা এখন বাসার ভেতরে আসে না কেন?

তাতো জানিনে বাবা। কেন তোমাকে কিছু বলেছে?

না কিছু বলেনি। আমার মনে হলো তাই বললাম।

ঠিক আছে, চেঞ্জ হয়ে খেয়ে নাও।

ওকে আম্মু।

বাচ্চা দুটো নিচে যেতেই, সুলতানার মনে হলো, তাইতো গত বেশ কিছুদিন রহমানের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। রহমানের কথা তার মনেই ছিল না। কেন? এই কেন’র জবাব পায় একাধিক। প্রথমত, এই রহমানদের সঙ্গে কখনো তাদের সম্পকর্ ছিল না। তার বাবার বাড়িতে এমন ডজন খানেক রহমানের অস্তিত্ব এখনো আছে। তাদের থাকার আলাদা ঘর । তাদের জন্য আলাদা রান্না হয়। তেমন একজন রহমানের কথা তার ভাবনায় আসার নয়। দ্বিতীয়ত, এই রহমানকে মনে হয় পৌরুষত্ব সম্পন্ন একজন সুপুরুষ। এমন একজন সুপুরুষকে তার দেখতে ইচ্ছে হয় না। মনের ভেতরটা নাড়া দিয়ে ওঠে, অন্যরকম একটা শিহরণ জাগে। পনেরো বছর ধরে মনটাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। কোনো ভাবেই এই নিয়ন্ত্রণ দুবর্ল হোক তা সে চায় না। রহমানকে এভয়েট করার আরও কারণ কি আছে? নিজেকে জিজ্ঞেস করে, জবাব পায় না।

সুলতানা আফরোজের ভাবনার পরিবতর্ন হয়। ভাবে এই রহমান দীঘির্দন তার শ্বশুরবাড়িতে কাজ করেছে। সামাদও তাকে পছন্দ করে। আর পছন্দ করে বলেই অনেক টাকা খরচ করে অটো কিনে দিয়েছে। তার দুটো সন্তানকে দেখাশোনা করে। আজকে তারেকের কথায় মনে হলো, তারা ভাইবোন উভয়েই রহমানকে পছন্দ করে। বাচ্চারা যাদের পছন্দ করে, তাকে অবহেলা করা অযৌক্তিক। সে নিচে নামবে। সখিনাখালা যেভাবে বাজার করছে, তার মান ভালো হচ্ছে না। এ বাড়ির রুচির সঙ্গে সখিনাখালার রুচির পাথর্ক্য থাকাই স্বাভাবিক। কাল থেকে বাজার করার বিষয়টা সে নিজেই দেখবে। রহমানকে এভয়েট করে বাচ্চাদের কষ্ট দেয়ার কোনো মানেই হয় না। রহমানের চোখে অশোভন কিছু দেখেনি। আর ওর বোকা বোকা হাসিও নিমর্ল। অনেকটাই আরিফের মতো।

আরিফের কথা মনে পড়ে আফরোজের। তাদের পাড়ার ছেলে। বেশ হ্যান্ডসাম এবং স্মাটর্ একজন। তার চার বছরের সিনিয়র। ভালো ফুটবল খেলত। বেশ পেশিবহুল শরীর। দেখতে যেমন সুদশর্ন ছিল, তেমনি তার হাসি ছিল জাদুময়ী । আরিফকে অনেকেই পছন্দ করত। সে নিজেও। আরিফ কাউকে পছন্দ করত না। তার একটাই ধ্যান-জ্ঞান ছিল- ফুটবল। জাতীয় দলের জাসির্ পরে দেশ-বিদেশের মাঠে ছুটে বেড়াবে, এমন স্বপ্নে সে বিভোর থাকত। আরিফের স্বপ্ন সফল হয়নি। ঢাকা প্রথম বিভাগে একটা বড়দলে চাঞ্চ পেল। দলের দেয়া সম্মানীর টাকায় একটা মোটর সাইকেল কিনল। শখের সেই মোটর সাইকেলই তাকে নিয়ে গেল না ফেরার দেশে। আরিফের সঙ্গে খুব একটা কথা হয়নি সুলতানার। তবুও সেদিন সে খুব কেঁদেছিল। সে শুধু নয় শহরের সবাই কেঁদেছিল।

সুলতানার মনে হয়, আরিফের সঙ্গে রহমানের অন্তত দুটি মিল আছে। হাসি এবং পেশিবহুল শরীর। সুলতানা একটা বিষয় বুঝতে পারে না, শরীরের বিষয়টা সে মাথা থেকে সরাতে পারে না কেন? একজন মানুষের শরীরটাই সব! তাহলে কি সে ক্রমশ নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে!

আম্মু ক’দিন ধরে রান্না কিন্তু ভালো হচ্ছে না! এমন রান্না হলে কিন্তু আমি আর খাবই না। ভাবনার তার ছিঁড়ে যায় তারেকের কথায়। বলে রান্না ভালো হয়নি বেটা?

না আম্মু একটুও না। তুমি একটু দেখ না মা। এভাবে সারাদিন একটা রুমের ভেতরে বসে থাকলে তুমিতো বঁাচবে না ।

আমি বঁাচব না, এমন কথা তোমাকে কে বলেছে?

আজ ক্লাসে এক মিস্ বলল, ভালোভাবে বঁাচার জন্য হাসতে হবে, খুশি থাকতে হবে। মন খুলে কথা বলতে হবে। আমি মিস্কে বললাম, আমার আম্মুতো হাসে না, চুপচাপ থাকে। তাহলে কি আমার আম্মু বঁাচবে না।

মিস্ কিছু বলল না। চুপ করে থাকল। স্কুল শেষে আমাকে ডেকে নিয়ে বলল, তোমার মাকে আমি চিনি। তাকে বলো, এভাবে নিঃশেষ করে কেবল বোকারাই। জীবন একটাই এবং তা এক জনমেই সীমাবদ্ধ।

তোমার এই মিস্-এর নাম কী?

আমরা সুইটি ম্যাম ডাকি। তোমাকে চেনে বলল।

হ্যঁা আমরা কলেজে একসঙ্গে পড়েছি। ঠিক আছে ব্যাটা এরপর বাজার আর রান্নার বিষয়টা আমিই দেখব। কালকে তোমার মিস্কে বলো আম্মু যেতে বলছে।

সকালে নাস্তা করে বাড়ির লনে হঁাটতে থাকে সুলতানা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন লন। দেখেই তার মন জুড়িয়ে গেল। সখিনাখালা অনেকটা সময় ব্যয় করে লন পরিষ্কার রাখার কাজে। সুলতানা মনে করতে পারল না, শেষ কবে লনে হেঁটেছে। বেশ ক’টা গাছে ফুল ধরেছে। একটি ফুল ছিঁড়ে খেঁাপায় পরতেই হাততালি কানে এলো। অদ্ভুতভাবে হাততালি দিচ্ছে রহমান। সুলতানা জানে, এই হাততালি তার বাচ্চাদের জন্য। হাততালি দেয়ার অথর্ রহমানের উপস্থিতি- ভালোই, ভাবে সুলতানা। সুলতানার দিকে চোখ পড়তেই মুখে কিছুটা হাসি এনে রহমান বলল, ভাবী কেমন আছুন।

আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ।

আমিও বাল আছি।

তোমার বউ সন্তানদের একদিন নিয়ে এসো, দেখব। একদিন লইয়া আসমু ভাবীসাব।

শোন, বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে বাসায় আসবে। আজকে তুমি বাজার করবে। সখিনাখালার বাজার বাচ্চারা খেতে পারছে না। আর তুমিও খেয়ে যাবে।

আমি না খাইলে য়য় না ভাবী?

তোমার খেতে কোনো অসুবিধা আছে?

তা নাই।

তাহলে অবাধ্য হওয়ার দরকার কী?

হাছা কতা য়ইল ভাবী, আমার খাওনডা বেশি লাগে। তাই অন্যের বাড়িতে খাইতে শরম লাগে।

শোন, আমার দাদারা তাদের বেশি নিমন্ত্রণ করত যারা বেশি খেতে পারত। সবার চেয়ে যে বেশি খেতে পারত, তাকে পুরস্কারও দিত। বেশি পরিমাণে রান্না করলে রান্না বেশি মজা হয় তা জান?

এইডা জানি।

তাহলে আজ থেকে প্রতিদিন দুপুরেই তুমি খেয়ে যাবে।

ঠিক আছে ভাবী সাব।

তোমার আয় রোজগার কেমন হচ্ছে।

খুব বাল ভাবী।

তাহলে এমন পচা পোশাক পর কেন?

কিছু টাকা পরতিদিন জমাইত্যাছি। তাই নতুন কাপড় কিনতে পারতাছি না।

টাকা জমাচ্ছÑ এটা খুব ভালো কথা। এই টাকাটা নাও। আজকেই একটা ট্রাউজার আর একটা টি-শাটর্ কিনবে।

ট্রাউজার টি-শাটর্-ঠিক বুঝলাম না।

সব সময় পরার জন্য পাজামা আর হাতা ওয়ালা রঙিন গেঞ্জি কিনবা। ভালো পোশাক পরা ড্রাইভারদের গাড়িতে যাত্রীরা বেশি আগ্রহী হয়, জান?

জ্বী ভাবীসাব। বাচ্চারা বেরোতেই তাদের আদর করে সুলতানা বাসায় ভেতরে প্রবেশ করে। নিজের রুমে প্রবেশ করতেই সুলতানার মনে হয়, সুইটির কথাÑ জীবন একটাই এবং তা এক জনমেই সীমাবদ্ধ। ছেলেটার কথাও মনে হয়Ñ এভাবে তুমি বঁাচবে না মা। তার প্রতি ছেলেটার ভালোবাসা দেখে সে চমকপ্রদ হয়। এই দুটি সন্তানের জন্যই সবকিছু সে ভুলে আছে। সেই বাচ্চাদের জন্যই তাকে বঁাচতে হবে। আর বঁাচার জন্য মনের সুস্থতা দরকার। মনের সুস্থতার জন্য সেসব করবে।

খালা তোমার রান্নায় একেবারেই মনোযোগ নেই, বিষয়টা কি বলতো।

ক্যান খালাম্মা কি হইছে।

তারেক বলছিল, তার খেতে ইচ্ছে করে না।

মাজে মইধ্যে রান্নাডা খারাপ হইয়া যায় খালাম্মা। তয় আর অইব না।

আজ থেকে আমিও রান্নাঘরে থাকব। তোমার রান্না দেখব। আর রহমানকে বলেছি প্রতিদিন দুপুরে খেতে। সে জন্য বেশি করে রান্না করবা।

ঠিক আছে খালাম্মা।

রহমানের সঙ্গে সুলতানার সম্পকর্ এখন অনেক ভালো। ডাকলে দোতলাতেও আসে। প্রথম প্রথম দোতলায় আসতে চায়নি। এলেও বাচ্চাদের রুম পযর্ন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। বাচ্চাদের সঙ্গে গল্প করে। গল্প মানে বাচ্চারা যে কথা বলে, তাতেই সায় দেয় রহমান। এ কারণে বাচ্চারা রহমানকে বেশ পছন্দ করে। ক’দিন ধরে তার ঘরেও আসছে ডাকামাত্রই। কখনো সুলতানার মনে হয়, রহমান যেন ডাকার অপেক্ষাতেই থাকে। এসেই ড্রেসিং টেবিলের টুলে বসে। কথা বলে। পুরুষের মতো কথা বলতেও জিব আটকে না। সুলতানা বুঝতে পারে না, এ কারণে তার রাগ হয় না ভালো লাগে। তবে এটুকু বুঝতে পারে মাঝে মাঝেই তার ভেতরে শিহরণ জাগে। কঠিনভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। বাচ্চাদের উপস্থিতি এই নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

সামনের ক’টা দিন সুলতানার জন্য বেশ কঠিন বলে মনে হচ্ছে। ছোটভাই এসে বাচ্চা দুটিকে নিয়ে গেছে। সাথে সখিনাখালাকেও যেতে হয়েছে। মা’র কাজের মেয়েটা বাড়ি গেছে। আসবে এক সপ্তাহ পর। রহমান বিষয়টা সকালে জেনে গেছে। তবুও প্রতিদিন অন্তত দু’বার তাকে এ বাড়িতে আসতে হবে। রাতে অটো রেখে যেতে এবং সকালে নিয়ে যেতে। এই দু’বারই তাকে নিচে আসতে হবে গেট খুলে দেয়ার জন্য। সুলতানা জানে, না ডাকলে রহমান ওপরে আসবে না। কিন্তু সুলতানা কি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? যেদিন থেকে রহমানের সাথে তার দুরুত্ব কমেছে, সেদিন থেকেই পনের বছরের অতৃপ্তির বিষয়টা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে প্রায়ই। ভেতরে উদিত হয়েছে অনেক প্রশ্ন। জবাবও এসেছে ভেতর থেকেই। শেষ জবাবটা ছিল, রহমান অটো ড্রাইভার তাতে কি এসে যায়। সে একজন পৌরুষ দীপ্ত পুরুষ! এ জবাবে চমকে যায় সুলতানা। তবু স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয় রহমানকে দু’তলায় আসতে বলবে না। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই কলিংবেলের আওয়াজ হয়। বিছানা থেকে ওঠতে ইচ্ছে হয় না। সুলতানা জানে একবারের বেশি কলিংবেলের বোতাম টিপবে না রহমান। এটা সুলতানারই নিদের্শ। ক’মিনিট পর সুলতানা নেমে আসে। দেখল লনের ট্যাপ ছেড়ে হাত-মুখ ধুইছে রহমান। আবছা আলোতে রহমানকে আরো ভয়ঙ্কর পুরুষের মতো দেখায়। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে রহমান বলে, ভাবী কি ঘুমাইছিলেন? সুলতানা কথা বলাটা এড়িয়ে যেতে চায়। রহমান একই প্রশ্ন আবার করে। এবার সুলতানা রেগে যায়। তা দিয়ে তোমার দরকার কী। কঠিনভাবে বললেও রহমানের দিকে চোখ পড়তেই, সুলতানা বদলে যায়। তার মনে হয়, তার পছন্দের শিশুর সারল্যেভরা আরিফ মুখ কালো করে দঁাড়িয়ে আছে। ভাবে একজন সহজ সরল মানুষের সাথে এমন রুঢ় আচরণ ঠিক হয়নি। মনের অজান্তেই কোমল কণ্ঠে বলল, অটো রেখে গেট লাগিয়ে ওপরে আস। পেছন না ফিরে সুলতানা দু’তলায় চলে এলো। গেট লাগানোর শব্দ হলো। কিন্তু রহমান আসছে না দেখে এগিয়ে এলো সুলতানা। বলল, আস রহমান। রহমান ভেতরে ঢুকতেই উন্মাদ হয়ে গেল সুলতানা। ভুলে গেল নিজেকে। ভুলে গেল সময়। ভুলে গেল বংশমযার্দা। ভুলে গেল সমাজ সংসার। সহজ সরল বোকা রহমান কিছু বুঝে ওঠতে পারলো না- ভাবী তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! পুরুষের শরীর তার। তাই জাগতে সময় নিল না খুব একটা। সুলতানার মনে হতে থাকে, এই সময়ে সে একটা রেল লাইন। তার ওপর দিয়ে হাজার কিমি গতিতে বিশাল এক ট্রেন ছুটে চলেছে। সবকিছু দুমড়ে-মোচড়ে ছুটে চলেছে। এত দ্রæত ছোটার গতি এতটা মধুর, এতটা কাক্সিক্ষত, এতটা ভালোলাগার কল্পনাতেও আসেনি তার। অবশেষে তাকে ভেঙেচুরে নিঃশেষ করে শেষ গন্তব্যে থামল ট্রেন। আকাক্সক্ষার পরিপূণর্তায় তার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। তার মনে হলো, কেবলি মনে হতে থাকল লাল নীল আর বেগুনির অভিনব আনন্দ উৎসব চারদিকে। হৃদয় ছঁুয়ে যাওয়া এমন উৎসবের সাথে আজই তার প্রথম দেখা। আর এই আনন্দ উৎসবের রূপকার রহমান। রহমানকে জড়িয়ে থাকল অনেকক্ষণ। আনন্দ আবেশে জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল, রহমান তুমি কিছু বলো।

কি কমু ভাবী?

কিছু একটা বলো।

আমার কইতে শরম লাগতাছে।

তাহলে তোমার শরমের কথাটা তো শুনতেই হয়, বলো।

আমার মুনে য়ইল, আমি সিনামার নায়িকার লগে হেই কামডা করলাম।

রহমানের কথায় হাসি পেল সুলতানার। হাসিটা ঠেঁাটে রেখে বলল, অহন থাইক্যা সিনামার এই নায়িকার লগে হেই কামডা পরতিদিনই করন লাগবো। বলেই রহমানের বিশাল লোমশবুকে মাথা রাখল সুলতানা আফরোজ। [শেষ]

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<2146 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1