মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

বোধ

মনিজা হাবীব
  ১৯ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

Ñ মুখটা একেবারে ঝঁাঝরা অইয়া গেছে ।

Ñ সারা শরীরে আর কোনো গুলির চিহ্ন নাই, খালি মাথাডাই একছের......

Ñ গতকালও অরে দেখছি শিকদার সাবের লগে।

Ñ অর এমন হাল কে করলো, শিকদার সাহেব জানতে পারলে খবর আছে।

Ñ শিকদার সাহেবের মাটিের্নর এমন হাল! এটা যে বিশ্বাসই করা যায় না।

আমজনতার কথার মাঝে শেষের কথাগুলো কানে এসে লাগে। দু’-তিন হাত দূরে কিছু একটা ঘিরে ওখানে জটলা হচ্ছে। নানাজনে নানা মন্তব্য করছে। প্রথমে ওসবে কান দেননি রাশেদ মঈন চৌধুরী। পুরো পাকর্ চক্কর দিয়ে প্রতিদিনের মতো পুরনো জারুল গাছটির নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আজকাল আর আগের মতো দৌড়াতে পারেন না, আর কত? আসছে নভেম্বরে পয়ষট্টিতে যাবেন। ওনার বাবা তো পঞ্চান্নতে চলে যান। পারিবারিক ইতিহাস ঘাটলে পজেটিভ কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না। সব অল্প বয়সে চলে যাওয়ার রেকডর্। তাই আজকাল সামান্য কিছু হলেই ভয় পেয়ে যান প্রবল পরাক্রম রাশেদ মঈন চৌধুরী। এতক্ষণ নিবির্কার থাকলেও আরফান সাহেবের মন্তব্যটা উদগ্রীব করে তোলে রাশেদ মঈন চৌধুরীকে। আমজনতাকে কোনোদিন তিনি মানুষ বলেই মনে করেননি। আরফান সাহেবের কথা আলাদা। তিনি একজন সাবেক সচিব। প্রাতভ্রর্মণে প্রায়ই দেখা হয়। অল্প-স্বল্প কথাও হয়, কখনো-সখনো। নাহ, দেখতেই হয় বিষয়টি। কিছুটা বিরক্তি নিয়েই উঠে দঁাড়ান রাশেদ মঈন চৌধুরী। সাতসকালে পাকের্র মধ্যে আবার কী হলো। জটলা ঠেলে ভিতরে মুখটা বাড়িয়ে দেন। আরফান সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেন, কি হয়েছে? আরফান সাহেব বিস্ফোরিত চোখে মাটিের্নর নিথর দেহটার দিকে ইঙ্গিত করেন। নাহ, তাকানো যাচ্ছে না। মাছিতে মরা মুখটা একেবারে ঢেকে গেছে। অস্ফুটে শুধু বললেন, অবলা একটা জীব! তাকে এভাবে! রাশেদ মঈন চৌধুরীর কেমন যেন গা গোলাতে থাকে। টলতে টলতে বাড়ি ফেরেন।

২.

ঠিক ভোর সাড়ে পাঁচটায় রেবেকা বেগমের ঘুম ভেঙে যায়। এত চেষ্টা করেন একটু ঘুমানোর, সব চেষ্টাই বিফল। ঘুমের ওষুধ খেয়েও কোনো কাজ হয়নি। শেষে রাগে-দুঃখে ওষুধ খাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছেন। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা বড়লোকদের স্ট্যাটাসের একটি অংশ। দুপুর বারোটা- একটা পযর্ন্ত না ঘুমালে মান থাকে কি? এই সেদিনও পাটিের্ত মিসেস তরফদার বলছিলেন দুপুর দুইটা থেকে নাকি ওনার মনিং শুরু হয়। নাহ, কেন যে সবকিছু মনের মতো হয় না। নিজে নিজেই শুয়ে শুয়ে গজরাতে থাকেন রেবেকা বেগম। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে উঠে বসেন। সিঁড়িতে রাশেদ মঈন চৌধুরীর পায়ের আওয়াজ পান। ভুল শুনছেন না তো। উনি কঁাটায় কঁাটায় সাড়ে আটটায় ফিরে আসেন, পাকের্ যান সাতটায়। ওনার সবকিছু ঘড়িতে বঁাধা। সাড়ে ন’টার মধ্যে রেডি হয়ে অফিসে চলে যান। গত বাইশ বছরে এর ব্যত্যয় ঘটেনি। কেবল পারিবারিক কোনো মৃত্যু সংবাদের ঘটনা না ঘটলে এ রুটিনের কোনো হেরফের হয়নি। এত তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এলেন কেন? কোনো সমস্যা হয়নিতো? রাশেদ মঈন ঘরে ঢুকেই ওয়াসরুমে চলে যান। একটু পরেই বমির বিকট শব্দ কানে আসে।

৩.

মায়ের চিৎকার শুনে তামান্না দৌড়ে আসে। এসে দেখে ওয়াসরুমে মেঝেতে পড়ে আছেন রাশেদ মঈন। রেবেকা বেগম তাকে ধরে কান্নাকাটি করছেন। তামান্না দ্রæত কাজের ছেলে ফজলকে ডাক দেয়। আগে বাবাকে ধরে বেডে আনতে হবে। তারপর ডাক্তার চাচাকে ফোন দিতে হবে। বাবার মতই ঠান্ডা মাথার মানুষ তামান্না। বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখা জরুরি। সবাই মিলে রাশেদ সাহেবকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেয়। রাশেদ সাহেব জ্ঞান হারিয়েছেন। তামান্না দ্রæত ফোন করে ডাক্তার চাচাকে। ঠিক দশ মিনিট পরেই ডাক্তার আজিজ চলে আসেন। রাশেদ সাহেবের দীঘির্দনের বন্ধু। দুই বাড়ি পরেই ওনার বাড়ি। জ্ঞান ফেরার পর রাশেদ সাহেবের কাছে ডাক্তার আজিজ জানতে চান, ঠিক- কী হয়েছিল। কারণ এত বছর ধরে রাশেদ সাহেবকে দেখছেন, উনি খুব সচেতন মানুষ। ঘড়ি ধরে সব কাজ করেন। ডায়াবেটিস, প্রেসার বা অন্য কোনো রোগ এখনো তার ধারেকাছে আসেনি। তাহলে? রাশেদ সাহেব বিছানায় থাকলেও তার চারপাশে মানুষের ভিড়। স্ত্রী এবং ডাক্তার আজিজ ছাড়া সবাইকে বাইরে যেতে বললেন। কিছুক্ষণ দম নিয়ে তারপর ধীরগতিতে আস্তে আস্তে বললেন, আসলে হয়েছে কি, প্রতিদিনের মতো আজও পাকের্ দৌড়ে ওই জারুল গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এর একটু পর বেশ কিছু মানুষের জটলা আর কথা শুনে ভিড়ের মধ্যে গিয়ে দেখি, লিয়াকত শিকদারের পোষা কুকুর মাটির্ন মাটিতে মরে পড়ে আছে। মুখটা মাছিতে ভরে গেছে। উহ, কি বীভৎস্য সে দৃশ্য! ভয়ে নিজের মুখটা দু’হাত দিয়ে চেপে ধরেন। রাশেদ সাহেব ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে থাকেন। আচ্ছা, হয়েছে হয়েছে বলে ডা. আজিজ তাকে আশ্বস্ত করেন। আবার যেন উত্তেজিত না হন, সেই চেষ্টা করেন। প্রাথমিকভাবে কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে যান ডা. আজিজ। আর বলেন বিকালে আর একবার আসবেন। তবে বিশেষভাবে যতœ নেয়ার কথা বলে যান রেবেকা বেগমকে। আজ অফিসে না যাওয়াই ভালো বলে পরামশর্ দেন। তবে ডা. আজিজ ও রেবেকা বেগম দুজনই মনে মনে বিস্মিত হন, কারণ রাশেদ সাহেবের মতো শক্ত ধাতের মানুষ মৃত কুকুর দেখে কেন এত ঘাবড়ে যাবেন। তাও অন্যের কুকুর। বিষয়টির মাথা-মুÐু ওরা কেউ বুঝতে পারছে না। ওদের দুজনকেই ভাবিয়ে তোলে বিষয়টি।

৪.

আলতামাস গ্রæপ অফ ইন্ডাসট্রিজের হেড অফিসে তুলকালাম কাÐ চলছে। এমডি নাসিরউদ্দিন আজ সকাল সকাল অফিসে এসেছেন। নাসির সাহেব সাধারণত বেলা সাড়ে বারোটার আগে অফিসে আসেন না। তার অন্যান্য অফিস এবং সাইট ঘুরে দেখার পর হেড অফিসে আসেন। এখানে এসে পারসোনাল সেক্রেটারি রুমানার হাতে গরম এক কাপ কফি খান, তারপর নিজের রুমে ডাকেন প্রধান নিবার্হী কমর্কতার্ রাশেদ মঈন চৌধুরীকে। ব্যবসার বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এ সময় অন্য কারো রুমে ঢোকা নিষেধ। রোজকার মতো কফি শেষ করার পর রাশেদ মঈনকে ডেকে পাঠান তিনি। রুমানা এসে জানায়, রাশেদ সাহেব রুমে নেই। মানে কি? রুমে নেই, তাহলে কোথায়? নাসির সাহেব খেঁাজ নিতে বলেন রুমানাকেÑ এখনই ফোন কর। জি স্যার বলেই রুমানা ফোন দেয় রাশেদ সাহেবকে। কয়েকবার চেষ্টা করার পর রুমানা জানায় ফোন বন্ধ। নাসির সাহেবের মেজাজ আরও একধাপ উপরে উঠে, সব নবাব-বাদশা নিয়ে আমি চলি। ফোনও বন্ধ থাকে। ল্যান্ডফোনে কল দাও। আর শোনো, মঈন সাহেবকে আমার সাথে কথা বলতে বলবা। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। অফিসে কলিগরা ডাকেন রাশেদ সাহেব, নাসির সাহেব ডাকেন মঈন সাহেব আর পিয়ন শ্রেণির সবাই বলেন চৌধুরী সাহেব। একজন মানুষকে তিন শ্রেণির লোক তিন রকমে ডাকে। এর কারণ কি, কেউ জানে না। নাসিরউদ্দিনের নিদেের্শ রুমানা আবারও ফোন করতে যাবে, ঠিক এ সময় রাশেদ সাহেবের বাসা থেকে ফোন আসে। রেবেকা বেগমই ফোন করেছেন। রাশেদ সাহেবের অসুস্থতার কথা জানান। সব শুনে রুমানা নাসিরউদ্দিনকে বিষয়টি অবহিত করেন।

খবরটি শুনে নাসিরউদ্দিনের কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বোঝা যায় না। বিরক্ত ভঙ্গিতে বসে থাকেন। কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে বাচ্চু সাহেবকে আসতে বলেন। বাচ্চু সাহেব উপনিবার্হী হিসেবে আছেন। মঈন সাহেব না থাকলে কাজ তো আর পড়ে থাকবে না! নাসিরউদ্দিন কাজ ফেলে রাখা পছন্দ করেন না। রাশেদ সাহেব পুনরায় কাজে যোগদান না করা পযর্ন্ত বাচ্চু সাহেবকে সব দেখতে বলেন। মনে মনে দারুণ খুশি,কিছুটা উত্তেজিতও বটে বাচ্চু সাহেব। এতকাল পরে স্যারের কাছে আসার সুযোগ পেয়ে নিজেকে দারুণ সৌভাগ্যবান মনে করেন। এতদিন পর নিজেকে যোগ্য প্রমাণের সুযোগ এলো তাহলে!

৫.

রাত আড়াইটার দিকে ঘুম ভেঙে যায় রাশেদ সাহেবের। অসম্ভব তেষ্টা পেয়েছে। রেবেকা বেগমকে ডেকে ওঠান। পানি খেয়ে চুপচাপ বসে থাকেন। কি হলো ঘুমুবে না? এভাবে বসে আছ কেন? খারাপ লাগছে, আমাকে বল। রেবেকার কপালে দুশ্চিন্তার ভঁাজ পড়ে। আসলে এরমধ্যে রাশেদ সাহেব একটা মাইল্ড স্ট্রোক করেছেন, তাকে এটা জানানো হয়নি । ডা. আজিজই নিষেধ করেছেন। বলেছেন, এ মুহূতের্ এটা জানানো ঠিক হবে না। ক’দিন পর আর একটু সুস্থ হলে না হয় তখন দেখা যাবে। কিছুক্ষণ কী সব ভাবেন রাশেদ। তারপর রেবেকার হাত ধরে বলেন, রেবেকা আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই। এই রাতদুপুরে আবার কী বলবে, সকালে বলো। এখন ঘুমাও। রাশেদের শরীরের কথা চিন্তা করেই কথাগুলো বলেন রেবেকা। নাহ, এখনই। প্রতিত্তোরের অপেক্ষা না করেই রাশেদ বলেন, রেবেকা আমার দৃঢ়বিশ্বাস মাটির্নকে লিয়াকত সাহেব নিজেই মেরেছেন। অবাক হয়ে অসুস্থ স্বামীর দিকে তাকিয়ে রেবেকা বলেন, এত রাতে তুমি এসব বলছো কেন? আর এটা বলার মতো কোনো কথা নয়? যার কুকুর সেই মেরেছে, হয়তো কুকুরটা কোনো ঝামেলা করেছিল। না হলে এত বছরের পোষা প্রাণীকে কেনই বা মেরে ফেলবেন। সবচেয়ে বড় কথা, তাতে আমাদেরই বা কি? রেবেকা তুমি বুঝতে পারছ না, মাটির্ন লিয়াকত সাহেবের খুব বিশ্বস্ত ছিল। ও জীবন দিয়ে কয়েকবার তার প্রাণ বঁাচিয়েছে। এবার কিছুটা বিরক্ত হন রেবেকা। কি মুশকিল এই বিষয়টি নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কেন? ক্ষীণ স্বরে স্বাগোক্তি করেন রাশেদ, এত বছরের বিশ্বস্ততার দাম মাটির্নকে এমন মমাির্ন্তকভাবে দিতে হলো। অসুস্থতার কথা ভেবে রেবেকার মন নরম হয়ে যায়, ভাবেন শরীর দুবর্ল বলেই রাশেদ কত কি ভাবছেন ! আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। চোখ বন্ধ কর। দেখো ঘুম এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে বলে স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।

ডা ঃ আজিজের তত্ত¦াবধানে চলছেন রাশেদ। প্রেসারও ঠিক আছে, তবে কিছুতেই শরীর ঠিক হচ্ছে না। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। কেমন যেন অবসাদগ্রস্ত! সারাদিন শুয়ে থাকেন। মনির্ংওয়াকে যান না। কারো সাথে ঠিকমতো কথা বলেন না। কথা যা বলেন তা ওই রেবেকা বেগম আর ডা. আজিজের সাথে। রাতেও মাঝে মাঝে উঠে বসে থাকেন, কখনো স্ত্রীকে ডাকেন, কখনো ডাকেন না। তার মনের মধ্যে যে কোনো বিষয় নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে তা বুঝতে পারছেন কিন্তু কোন প্রশ্ন করতে পারছেন না রেবেকা বেগম। ডাক্তারের নিদের্শ। প্রয়োজন হলে উনি নিজে বলবেন। জেরা করা ঠিক হবে না।

পনের দিনের মাথায় নাসিরউদ্দিন নিজে ফোন করেন রাশেদকে। রেবেকা বেগমই সব ফোন রিসিভ করেন। প্রয়োজন হলে স্বামীকে দেন। তেমন দরকার না হলে দেন না। বস বলে কথা। নাসিরউদ্দিন দু-এক কথা বলে রাশেদ সাহেবকে আরও কিছুদিন রেস্ট নিতে বলেন। রেবেকা কাছে বসেছিলেন বুঝতে পারেন ওপাশ থেকে কী বলা হচ্ছে। হু, হ্যঁা করে কিছু সময় পর ফোন ছেড়ে দেন রাশেদ। এরপর গুম হয়ে বসে থাকেন। রেবেকাকে বলেন কিছু সময় তিনি একা থাকতে চান। কোনো কথা না বলে রেবেকা ঘর থেকে বেরিয়ে যান।

সারাদিন কেটে গেছে রাশেদ বিছানা থেকে ওঠেননি। দুপুরে শুধুমাত্র একটু সবজি স্যুপ খেয়েছেন। খেয়ে আবারও শুয়ে পড়েন। রেবেকা মনে মনে একদিকে যেমন বিরক্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে ভয়ও পাচ্ছেন। রাশেদের ভাব-গতিক ভাল ঠেকছে না তার কাছে। তবে এখন অসুখ বলে নয় রেবেকা যেচে কখনো রাশেদকে কিছু জিজ্ঞাসা করেন না। কোন বিষয় নিয়ে কৌতুহল রাশেদ পছন্দ করেন না। একদিন অফিসের কি একটা ঝামেলা নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, তাতে রাশেদ যে আচরণ করেছিলেন- বাব্বাহ মাফ চাই। তারপর আর কখনো কিছু জানতে চাননি কোনো বিষয় নিয়ে। ধরেই নিয়েছেন নিজে থেকে যা বলবেন তাই শুনবেন। আসলে ঘরে-বাইরে এক অপ্রয়োজনীয় বলয় তৈরি করেছেন রাশেদ। যার কোনো কারণ নেই। একমাত্র মেয়ে তামান্নার সাথেও দরকার ছাড়া কোনো কথা বলেন না। রাশেদের ভাইবোন বা নিজের বাবা-মায়ের সাথেও সম্পকর্ ধরে রেখেছেন রেবেকা বেগম। সব দায় যেন তার। মাঝেমধ্যে হঁাপিয়ে পড়েন রেবেকা বেগমও । ইচ্ছে করে সব ছেড়ে কোথাও চলে যেতে। পারেন না। সংসার নামক শিকল তার পায়ে। কতদিন ভেবেছেন, মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে কোনো এক দিকে চলে যাবেন। ভাবনাই সার, হলো কোথায়?

৬.

ঠিক রাত আড়াইটায় আবারও রাশেদের ঘুম ভেঙে যায়। ধড়ফড় করে উঠে বসে, ধাক্কা দিয়ে রেবেকাকে ওঠায়। রোগীর সেবা করতে গিয়ে সেবাকারীও একসময় প্রায় রোগী হয়ে যায়। বেশ কয়েকদিন ধরে রেবেকারও শরীর ভালো যাচ্ছে না। অথচ কাউকে কিছু বলতেও পারেন না। মাত্র চোখটা লেগেছিল, ঠিক তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল। বেশ বিরক্ত হয়েই বলে উঠল, কি, হলোটা কি? রাশেদ বেশ নরম গলায় বললেন, পানি খাব। তোমার হাতের কাছেই তো পানির বোতল, গøাস। রেবেকা যে বিরক্ত হয়ে বোতল থেকে গøাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিলেন, তা বুঝতে পেরে রাশেদ বললেন, আসলে আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই। বিরক্তি নিয়ে রেবেকা বললেন, তা কাল সকালেও তো বলা যায়। রাশেদ বললেন, সে সুযোগ যদি না পাই। রেবেকা বিস্মিতভাবে বললেন, কি বলছো এসব ? হ্যঁা, যা বলছি তা মন দিয়ে শোন। রেবেকা তুমি কি জান আমার দাদাজানের মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল। রেবেকার মাথায় কিছুই ঢুকছে না, তার স্বামী এসব কথা কেন বলছে। শুধু বলল, না জানি না। রাশেদ নিবির্কারভাবে বলল, দাদাজানের হয়েছিল ইচ্ছামৃত্যু। আমারও তাই হবে। আমি আজই চলে যাব। তাছাড়া নাসির সাহেবও আমাকে বঁাচতে দেবে না। আমি তার ব্যবসার অনেককিছু জানি। এখন আমি অসুস্থ। আমাকে তার কোনো প্রয়োজন নেই। শিকদারের মাটিের্নর মতো নাসির সাহেবও আমাকে বঁাচতে দেবে না।

বেশকিছুক্ষণ চুপ থেকে রাশেদ বললেন, রেবেকা আমি আজিজের কাছে শুনেছি শিকদার সাহেব নিজেই তার কুকুর মাটির্নকে মেরে ফেলেছেন। রেবেকা কি একটা বলতে যাচ্ছিলেন, হাতের ইশারায় থামতে বললেন রাশেদ। তারপর নিজেই বলা শুরু করলেন, রেবেকা আমার এই ত্রিশ বছরের কমর্জীবন ভুলে ভরা। চাকরিতে মালিককে খুাশ করতে গিয়ে আমি মনুষ্যত্ব হারিয়েছি। সারাটা জীবন কেবল অফিস অফিস করেছি। অথচ দেখো এমডি স্যার এ ক’দিনে ঠিকমতো আমার একটা খবর পযর্ন্ত নেননি। তার উদ্দেশ্য আমি বুঝে গেছি। অথচ স্যারের জন্য, অফিসের জন্য কি না করেছি। তাকে খুশি করতে গিয়ে আমি অফিসের সবার কাছে ঘৃণার পাত্র হয়েছি। কতজনের কত ছোটখাটো সমস্যা, তাতেও কোনো ছাড় দেইনি। জানো, একবার হয়েছে কি, সেলস এক্সিকিউটিভ আমীর সাহেবের ছোট ছেলে হাসপাতালে ভতির্। মিটিং এ একটু দেরিতে এসেছিলেন। সবার সামনে আমি তাকে যা নয় তাই বলে অপমান করি। সবাই খুব অবাক হয়ে যায় আমার ব্যবহারে। কিন্তু সামনে কেউ কিছু বলেনি। আমি জানি সবাই আমাকে ঘৃণা করে। এতদিন হয়ে গেল অফিসের একজন সহকমীর্ একটা ফোন করেনি। রেবেকা সাথে সাথে বললেন, করেছে তো। রাশেদ দীঘর্শ^াস ছেড়ে বললেন, মিথ্যা বল না। আমি জানি সব। জানো রেবেকা অসুস্থ হয়ে আরেও দেখলাম, আমার মেয়ের সাথেও কত দূরত্ব তৈরি হয়েছে আমার। আগে ভাবতাম আমাকে ছাড়া সংসার অচল, অফিস অচল। সব ভুল। আমি ছাড়াও এ সংসার তুমি ঠিক চালিয়ে নিতে পারবে। তুমি জানো, অফিসে এমডি স্যার আমাকে ডাকেন মঈন, সহকমীর্রা রাশেদ, পিয়নরা চৌধুরী বলে ডাকে। একটা মানুষকে এত নামে ডাকার কোনো মানে আছে? ওরা আমাকে বিদ্রƒপ করে ডাকে। আমার নামের ঠিক নেই। যার নামের ঠিক নেই, তার জন্মেরও ঠিক নেই। বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন রাশেদ।

রেবেকা কিংকতর্ব্যবিমূঢ়। কিছুক্ষণ পর নিজেই ধাতস্ত হয়ে বলেন, মাটির্ন তিন থেকে চারবার শিকদারের জীবন বঁাচিয়েছে। অথচ তাকেই কি বীভৎস্যভাবে মারা হয়েছে, তুমি তা সহ্য করতে পারবে না। মাটিের্নর অপরাধ কি, তা জানা যায়নি। অবলা একটা জীব! রেবেকা উপরওয়ালাকে কখনো খুশি করা যায় না। তামান্নাকে বল, ওর বাবা ওকে অনেক ভালোবাসত, মুখ ফুটে কোনোদিন বলতে পারিনি। ভালো থেক। আমি চললাম। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে আবারও শুয়ে পড়েন রাশেদ সাহেব।

দূরে কুকুরের কান্নার শব্দ রেবেকাকে আতংকিত করে তোলে। বারবার রাশেদকে ডাকতে থাকেন। কোনো শব্দ নেই। সাড়া নেই। তবে যে একটু আগে রাশেদ বলছিল...। ওর দাদাজানের ইচ্ছামৃত্যুর কথা। তবে কি, রাশেদেরও ...? কেবল মুয়াজ্জিনের আজান শোনা যায়- আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম... ..

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<18147 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1