শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
জন্মদিনের শুভেচ্ছা

হাসান হাফিজ ‘আধেক অতলে ডোবা’ এক শক্তিমান কবি

দুখু বাঙাল
  ১২ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

জীবন ও জগৎকে দেখার শৈল্পিক অভিব্যক্তি থেকেই জন্ম নেয় যে-কবিতা, তা মানুষের মৌলিক আচরণের একটি। তাই বুঝি মানবসভ্যতার ইতিহাসে রাজ-রাজরাদের চেয়ে কবির স্থান আলাদা। বলা যায়, কবি বিশেষ মযার্দায় সমাসীন। কাব্যশৈলীতে বাণী হয় কবির আপন মনের প্রতিনিধি; যা কবিকে নিয়ে যায় স্বকাল থেকে ভাবীকালে। নিজেই নিজের স্বরূপ খুঁজে পাওয়া কবিতা, আপনার যুক্তিতে আপনি অনিবাযর্ হয়ে ওঠা কবিতা একদিন মুদ্রিত হয়ে যায় মহাকালের পৃষ্ঠে।

হাসান হাফিজ সত্তর দশকের জীবনবাদী কবি। গদ্য, কবিতা, শিশুসাহিত্য ও সম্পাদিত প্রকাশনা মিলিয়ে এ যাবত তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দেড়শ’র অধিক। কলকাতা থেকেও বেরিয়েছে তঁার কবিতার বই। সদ্যস্বাধীন যুদ্ধ ক্লান্ত দেশে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে তার কবিজীবনের প্রকাশ। সংগত কারণেই তার গায়ে লেগে আছে স্বাধীনতার গন্ধ; যা তার মনন ও মেধাকে প্রভাবিত করেছে দারুণভাবে। ‘লক্ষ লক্ষ করোটি কঙ্কাল চিরে জেগে ওঠা/উদ্ভিদের পাতায় সত্য তোমাদের স্মৃতি/তপ্ত শোণিতের দামে এ দৃশ্য নিমির্ত’। তঁার প্রথম প্রকাশিত বই ‘এখন যৌবন যার’ বইয়ের কবিতায় এভাবেই ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার বিনম্র শ্রদ্ধা। স্বাধীনতার দশকটিকে কবি দেখেছেন আমাদের যাবতীয় শিল্পকমের্র অহংকার হিসেবে। যেমন তিনি তঁার ‘সত্তরের শুদ্ধতা ও সৃষ্টিশস্য’ কবিতায় উচ্ছ¡সিত হয়ে বলেনÑ ‘সত্তরের শিল্পচচার্ সৌধ ছঁুয়ে গেছে/বঁাধভাঙা তারুণ্যের উদ্দাম সৃষ্টি ও শস্য শুদ্ধ যা আগুনে...’।

প্রেমিক কবি হাসান হাফিজ প্রেমের সাথর্কতার আকাক্সক্ষায় ভেতরে ভেতরে একদমই যেন উত্তেজিত। তার উচ্চারণÑ ‘ভীতু প্রেমিকের মনে/কখন কবে যে/সঞ্চালিত হবে/তাজা রোদ’। প্রেমাস্পদের সান্নিধ্য লাভের পর তিনি আর জগৎ-সংসারে ফিরতে চান না। তিনি বলে ওঠেনÑ ‘আমি আর ফিরতে ইচ্ছুক নই/হতচ্ছাড়া পুরনো ও নিঃসঙ্গ সংসারে’। ভালোবাসাহীন জীবন মরুভূমির সমান। কিন্তু এই কবিই আবার যখন উচ্চারণ করেনÑ ‘পৃথিবীতে ইদানীং ভালোবাসা বড়ো আকালে পড়েছে’ তখন এই বলে সংশয় জাগে যে ভালোবাসায়ও কি তা হলে অবক্ষয়?

মানুষের হাতে প্রকৃতি আজ ধ্বংসের পথে। আপন স্বাথের্ মানুষ প্রকৃতির কাছ থেকে নিয়েছে অশেষ; প্রকৃতিকে সে দিতে শেখেনি কিছুই। প্রকৃতিকে তাই প্রতিবাদী হয়ে ওঠার আহŸান জানিয়ে কবি বলেনÑ ‘এই নীরবতা ভাঙো, নিন্দা প্রতিবাদে তুমি কিছুটা সরব হও/নড়াচড়া করে ওঠো’। আবার প্রাকৃতিক সৌন্দযের্র লীলাভূমি আপনার স্বদেশকে কবি দেখতে চান চিরকালের লাবণ্যবতী জননী হিসেবে। কবি বলেনÑ ‘জীবন সাথর্ক হবে/সেঁাদাগন্ধে হে জননী/তোমারই প্রশ্রয়ে/তোমার দরিদ্র ছবি/কল্পনায়ও দেখতে চাই না/আতক্সক ও ভয়ে’।

কবি শুধু নিজের কথাই বলেন না। মানুষের কথাও বলেন। শিল্প কবিতা ও যে-কোনো ধরনের সৃষ্টি সবই তো মানুষের জন্য। শ্রমিকের ঘাম হাসান হাফিজের কবিতায় ফুটে ওঠে অসাধারণভাবেÑ ‘এই ঘাম এই শ্রম/এই ত্যাগ রূঢ়তা সত্যের/কবিতাপঙ্ক্তির মতো পবিত্র মহান!’। হাসান হাফিজের কবিতায় আছে নিপীড়িত মানুষের মুখ, আন্দোলনে ঝরে যাওয়া গোলাপ শহীদ নূর হোসেনের মুখ এবং আছে ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে স্বাধীনতাকামী মানুষের রক্তাক্ত এবং সাহসী মুখ।

তার কবিতার বড় বৈশিষ্ট্য সারল্যবোধ ও সাবলীলতা, যা সহজে পাঠককে টেনে রাখে। খুব কমক্ষেত্রেই তিনি শব্দকুহকতার আশ্রয় নিয়েছেন। বোধ করি নিজস্ব কাব্যভাষার কারণেই তিনি পাঠকপ্রিয় কবি। ইতিমধ্যে তার কবিতাসমগ্র বেরিয়েছে তিন খÐে; যা পঠনে বোঝা যায় ছন্দ ও রীতি নিয়ে খেলার প্রয়াস পেয়েছেন কবি। শিশুসাহিত্য নিয়ে আমাদের কবিরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মনোযোগিতার পরিচয় দিয়ে উঠতে পারেন না। হাসান হাফিজ এইক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ছড়া, গল্পকথা, রূপকথার অনুবাদ এমনকি ফুটবলসহ খেলাধুলো নিয়েও রয়েছে তঁার বিস্তর লেখা। শিশুসাহিত্যে তিনি নিরন্তর সক্রিয়।

পরিণত বয়সে হাসান হাফিজ অনুভব করেন স্বল্পায়ু জীবনের কথা। তার উচ্চারণÑ ‘শয়নে সিথানে/আয়ুর সামান্য বাকি’। মৃত্যুর পাথেয় কি তা কারো জানা নেই। ‘পুণ্য পঁুজি কিছু নাই’ বলে বিলাপ করলেও মৃত্যু নিয়ে কবি যে মোটেই ভাবিত নন, তা বোঝা যায় এই পঙ্ক্তিতেÑ ‘মৃত্যু নিয়ে হঠকারী বিলাসিতা তোমাকে মানায়?’। আংশিক প্রাপ্তি বা অধর্দশের্ন কবি যেন স্থিত সৌম্য শান্ত। তিনি বুঝে ফেলেন জীবনে পূণর্তা বলে কোনোকিছু নেই। তার উচ্চারণ ‘আধেক দিয়েছে ধরা/আধেক রহস্যাবৃত/আধেক অতলে ডোবা’। কবিতার মতো বায়ুবীয় বস্তুকে ঘিরে কেটে যায় কবিদের জীবন। কবিতা সৃষ্টির যে ঐন্দ্রজালিক ও মোহনীয় শক্তি, তা কি শুধু শব্দ ছন্দ উৎপ্রেক্ষা চিত্রকল্প রচনার পারঙ্গমতা প্রদশের্ন সীমাবদ্ধ? চচার্ ও পঠনে এক্ষেত্রে বাহাদুরি করা যায়, কবিতা সৃষ্টি হয় না। কবিকে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে হঁাটতে হয়Ñ স্বপ্ন সুন্দর আর কল্পনার ভাবরাজ্যে। এই অভিজ্ঞতালব্ধ দীঘর্ পথ-পরিক্রমা শেষে কবিকে গেয়ে উঠতে হয় জীবনের গান। বলা যায় কবিজীবনের দীঘর্পথ পেরিয়ে হাসান হাফিজের কণ্ঠেও যেন উচ্চারিত হয়ে ওঠে জীবন ও ভালোবাসার জয়গানÑ

‘রাত হলো অঁাধারের নিকষ কঠিন পদার্ নেমে এলো যবনিকা রাত

ঠিক জেনো ভোর হবে, ধরে থাকো প্রেমিকের অচঞ্চল হাত।’

১৫ অক্টোবর কবি হাসান হাফিজের জন্মদিন। এই শুভ জন্মদিনে তার কবিতার পাঠক হিসেবে তার প্রতি রইল আমাদের অশেষ শুভেচ্ছা। প্রত্যাশা, সৃষ্টির নতুন নতুন বিভায় নিশ্চয় এই শক্তিমান কবি উন্মীলিত হতে থাকবেন জীবনের আগামী দিনগুলোয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<16975 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1