শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
গ্রন্থালোচনা

হিম নাকি তাপিত রে মন

শাহীন রেজা
  ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

কবিতা জীবনের নিযার্স। অন্য কারো কাছে কবিতা কেমন তা আমি জানি না, তবে আমার কাছে কবিতার একটাই রং, তা হচ্ছে ধূসর। এই ধূসরের আহŸানে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়, পৃথিবীতে জল নামে। পলির উন্মেষ ঘটে এবং সৃষ্টি হয় নতুন সম্ভাবনার। সৃষ্টির আনন্দই কবিতার আনন্দ। একজন কবি তার বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে জানান দিয়ে যান সৃষ্টি ও বিলয়। এই সৃষ্টির সুর প্রবাহিত হয় সবুজের মধ্য দিয়ে এবং তার পরিণতি কৃষ্ণে। কবি ক্রমাগত সেই কৃষ্ণকায় ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হন এবং পরিণত হন মহাকালে। সাধারণ মানুষের দৃষ্টি যেখানে সমাপ্ত ঠিক সেখান থেকেই যাত্রা শুরু একজন কবির। কবি নিজে স্বপ্ন দেখেন এবং স্বপ্ন দেখান সমগ্র জাতিকে। কবির কোনো বিভাজন নাই। কবি এবং কবিতা সকল দ্বন্দ¦, সংঘাত এবং বিভাজনের ঊধ্বের্।

সময়ের বঁাকে বঁাকে কবিতায় জন্ম হয়েছে নতুন সম্ভাবনা। তারুণ্যের হাত ধরে সে প্রতিবারই হয়েছে ঋদ্ধ, স্রোতময়। কবি ফারুক আফিনদী সমসাময়িক কবিতায় সেরকমই এক সংযোজন, যিনি সময়কে বদলে দিতে চান। ছন্দ ও ভাবের দ্যোতনায় কবিতাকামে অঁাকতে চান নতুন কোনো সুর।

পুরনোকে ভেঙে নতুনের নিমার্ণ সে তো তারুণ্যেরই কাজ। আজকের তারুণ্য যে নতুন গতিপথ রচনা করবেন সে পথেই তো এগিয়ে যাবে সভ্যতা, মানবিকতা এবং কবিতা। ফারুক আফিনদীর কবিতায় নতুনের সুর আছে, ভাষায় আছে চমৎকৃত হওয়ার কিছু নান্দনিক কারুকাজ। আছে গভীর চিত্রলতা, মায়াবি ছন্দধারা এবং জীবনঘনিষ্ঠ কিছু নিবিড় আত্ম-উচ্চারণ।

কাল ফাল্গুনে আমন্ত্রণ জানানো এ কবি বাংলাকে দেখেন জীবনানন্দের চোখ দিয়ে। কিš‘ তার বনর্ণা ভিন্নতর। উপমা-উৎপ্রেক্ষা আরও আধুনিক, নান্দনিক এবং উপভোগ্য। ঘৃতজোছনায় পিঙ্গল ছাই ওড়া দৃশ্য দেখে অভিভূত কবি আষাঢ়ে পাটক্ষেতে কঙ্কালপ্রেত দেখে মূছার্ যান। আবার আন্তজাির্তক বৃষ্টিতে মহব্বতের মেঘপাপড়ি পরে আষাঢ় প্রদীপ জ্বালান সোনালতা হাতে।

নগরবাসী কবির মধ্যে আমরা সহজেই আবিষ্কার কবি লোকজমিথ। অবশ্য এ আবিষ্কার নতুন কিছু নয়। এর আগেও তা ধ্বনিত হয়েছে আল মাহমুদে। তিতাসের বোয়ালগুলো অবলীলায় উঠে এসেছে আফিনদীর গোলাপনগরে সন্ধ্যার আকাশ ভেঙ্গে।

‘আকাশে উপুর হয়ে আছে কড়াই

পড়ছে ফেঁাটা ফেঁাটা গলিত ঘি

একজন একাকে জোছনারা এভাবেই অত্যাচার করে’

(অত্যাচার)

কড়াইয়ের সাথে চঁাদের আর জোছনার সাথে ফেঁাটা ফেঁাটা গলিত ঘি এর তুলনা সমকালীন বাংলা কবিতায় এক নতুন সংযোজন। একাকিত্ব নিঃসন্দেহে কষ্টের। তবে সেই কষ্ট-জোছনার অত্যাচার কতটা আনন্দময় কিংবা বেদনার তা একমাত্র কবিই জানেন।

‘মেঘ দেখে শিশু হয়েছিলাম

ও নারী পুণ্যতোয়া, মহতী গো, মহতী, এই মেঘ তুমি’

(মেঘ এবং মহতী)

নারীকে মেঘের সাথে তুলনা কিংবা নারীরূপী মেঘ দেখে শিশু হওয়ার যে আকাক্সক্ষা তা কবিমনের আশ্চযর্ খেয়ালেরই বহিঃপ্রকাশ।

কবি ফারুক আফিনদী কবিতায় শব্দের যে নিরেট বুনন এবং বনর্ণার যে বিরল ছটা স্থাপন করেছেন তা এসময়ের কবিদের মধ্যে ব্যতিক্রম। তার কবিতার একটি নিজস্ব ভঙ্গি আছে। বাস্তবতা, আবেগ এবং সততার মেলবন্ধনে আবদ্ধ এ কবি এগিয়েছেন ধীরে ধীরে তবে তা অবশ্যই আস্থার সাথে এবং পরম ঋদ্ধতায়। কোথাও কোথাও শব্দ এবং বণর্না নিয়ে নিরীক্ষা তাতে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। কবিতার নামকরণ এবং শব্দ বিন্যাসেও এ কবি ধরে রেখেছেন তার স্বাতন্ত্র্যতা। প্রথম ভাদরে ভরা সাদরে, হেঁটে যাচ্ছে খয়েরি শামুক, ধানরোদে কয়েকটি শালিক, মৃতজোছনায় উড়ছে পিঙ্গল ছাই, ছোপ ছোপ তারার মতো কিংবা নিঁেখাজ পঁাজর এখন ধঞ্চের বাড়িতে Ñ কবিতার এমন নামকরণ একজন আলাদা ঘরানার আধুনিক অথচ গ্রামমুখী কবিকে শনাক্ত করিয়ে দেয়।

কাব্যগ্রন্থের নাম ‘হিম নাকি তাপিত রে মন’ হলেও গ্রন্থটির কোথাও এ নামের কোন কবিতা নেই। এটাও কবির একটি বিশেষত্ব হিসেবে চিহ্নিত হয় বৈকি।

কবিতাকে শব্দের চাল হিসেবে মেনে নিলে ফারুক আফিনদীকে সে চালে অভিজ্ঞ ও সফল একজন ব্যক্তি হিসেবে গন্য করা যায়। ধানের স্তূপে উড়াল সাদা বাষ্প খুঁজে ফেরা কবি সবিতার চুলক্ষেতে পিঁপড়ার স্পশের্র মতো জলবায়ুর বিলি কাটা দেখতে দেখতে ঢুকে পড়েন শামুক কুড়ানি মেয়ের ঝুড়িতে আর গাওবাদী বঁাশিটার টানে তার উচাটন মন কাচি ও হুকো নিয়ে অঘ্রাণ সকালে পুড়তে থাকে ক্রমাগত সোনারঙ অঁাচে।

পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় আস্থাহীন কবির কাছে সংসার যেন এক নিকষিয়া তুমুল অন্ধকার। তিনি উচ্চারণ করেনÑ ‘মানুষেরা রৌদ্রে ধেঁায়ায় কাক

কোলাহল করে

সংসারের টানে

সংসার, এই এক নিকষিয়া তুমুল অন্ধকার। ’

(সংসার, এই এক অন্ধকার)

বৃষ্টির প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল কবি তার বষার্র গ্রামজস্মৃতি নিয়ে ফিরে আসেন নগরকীতের্ন। বৃষ্টি বাতাসের সেই দোলা তার কবিতায় ব্যক্ত এভাবেÑ

‘এখানে কত কত দিন ডুবেছি বষার্য়

কত কত দিন মাথার ওপর দিয়ে সঁাই-সঁাই

ছুঁয়ে গেছে পইশ্চাল বৃষ্টি

বষার্ ও বাতাসের ঝাপটায়

বুকের ভেতরে ভাংচুর-বষার্র স্রোত

মনের ডহরে ডোবে শালিকের পাখ

কাকের ডানায় জমা

মেঘের পরিণয়! বরষার শাস!

জীবনের ভার নিয়ে ফিরে আসি আজ

নগরকীতের্ন। ’

(বাইশে শ্রাবণ)

একই কবিতায় কবিগুরুর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় তার উচ্চারণ -

‘২২শে শ্রাবণ দিনটির মধ্যে বৃষ্টির অনেক ভার

২২শে শ্রাবণ কথাটার মধ্যেই বৃষ্টির সম্ভার। ’

ফারুক আফিনদীÑ সময়ের সিঁড়িতে দঁাড়িয়ে কবিতায় এক ব্যতিক্রমী দ্যোতনা রচনায় সদা ক্রিয়াশীল কাব্য যোদ্ধা। কবিতা তার কাছে স্বপ্নের লাটাই, বোধের ঝংকার।

‘হিম নাকি তাপিত রে মন’ কবির সেই সৃষ্টি সলতেতে যেন একবিন্দু অগ্নির স্পশর্। এ গ্রন্থের মধ্য দিয়ে তিনি আক্ষরিক অথের্ই আবিষ্কৃত হয়েছেন এক ভিন্ন মাত্রার চিত্রল সম্ভাবনার মানুষ হিসেবে। কবি হিসেবে তার যাত্রা লোরকা কিংবা বোদলেয়রের মতো না হলেও সে পথ শামসুর রহমান কিংবা আল মাহমুদে মিশে যেতে পারে এমন ধারণা বোধ হয় অতিরঞ্জিত হবে না। অগ্রসরমান কবির কবিতা-যাত্রা নিস্কটক এবং গতিময় হোকÑ এই প্রার্থনা।

হিম নাকি তাপিত রে মন

লেখক : ফারুক আফিনদী

ধরন : কবিতা

প্রকাশক : সাউন্ডবাংলা

মূল্য : ১২০ টাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<13512 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1