বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

জেসমিন নাহারের ইতিবৃত্ত

মাসুম বিল্লাহ
  ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

মতিন দ্বিতীয় বিয়েটা করেছিল মানুষকে লজ্জা দিতে। সবাই বলাবলি করেছিলÑ মতিন্যারে পাগলা কুত্তায় কামরাইছে! তাকে পাগলা কুকুরে কামড়ায়নি, ভিমরতিতে ধরেছিল। পাড়া-পড়শীরা মতিনের কাÐ দেখে বেশ কিছুদিন হঁা-হুতাশ করেছে। সে নিজেও স্মৃতি হাতড়ে রাতগভীরে মজনুর ভূমিকায় নামে। কিন্তু চোখের পানি মুছে দিতে প্রথমা স্ত্রী আর আসে না। অপমানিত প্রথমা স্ত্রী নাকি দ্বিতীয় সংসারে সুখেই আছে। সে নিজেও বলে, অমন বউরে যে ছাইড়ে দেয়, সেতো বলদ, কিন্তু আমার মতোন হেই ব্যাডা তো আর বলদ না।

টানাপড়েন সংসারে দ্বিতীয় বউকে নিয়ে ভালো নেই মতিন। ত্রিশ বছরেও সংসার ঠিক সংসারের মতো হলো না। নিত্যনতুন অশান্তির ডালপালা মেলে। তবু সংসার ছেড়ে পালানোর উপায় নেই। প্রতিদিন ভোরে গাড়ি নিয়ে ছুটতে হয়। ইচ্ছে করেই রাত করে বাড়ি ফেরে। কোনো রাতে ফেরেই না। জুয়ার আসরে নিয়ম করে বসে। ঠিকমতো বাসায় না ফিরলেও হেলপারের মাধ্যমে বাজার খরচের টাকাটা পাঠিয়ে দেয়।

কয়েকমাস হলো সে সংসারে বেশ মনোযোগী। রাত করে ঘরে ফেরে না। সংসারের প্রতি খেয়াল আগের তুলনায় বেড়েছে, সেই সাথে বেড়েছে বাজার-সদাইয়ের পরিমাণও। মাসের মধ্যে দুই-একবার স্ত্রীর হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেয়। স্ত্রী অবাক হয়ে বলে, ও সুজনের আব্বা, আপনে কি রাইতে চুরির কামে নামছেন? স্ত্রীর কথায় মৃদু রাগ দেখিয়ে বলে, মেজাজ খারাপ কইরে না, সুজনের মা।

মতিন শুধু টাকার খনি-ই নয়, সাথে রাজকন্যাকেও পেয়েছে। রাজকন্যার নাম হলÑ সুন্দরী জেসমিন নাহার।

সেদিন বাসভতির্ যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে মতিন। চালকের বঁা পাশে মহিলা সিটে বসা ছিল সুন্দরী জেসমিন নাহার। তাকে দেখে মতিন বিচলিত হয়ে পড়ে। ব্রেকের ওপর থেকে পা বার বার সরে যাচ্ছিল। খানিক পর পর আড়চোখে সুন্দরী জেসমিনকে দেখছে। একবার তো গাড়ি খাদেই পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু মতিন দক্ষ হাতে তা সামাল দেয়। আর এভাবেই প্রথম আলাপ মতিন ও জেসমিন নাহারের।

দ্বিতীয় দিন। মতিনকে অবাক করে দিয়ে সামনে এসে দঁাড়ায় জেসমিন নাহার। গোপালপুর থেকে সবেমাত্র যাত্রী নিয়ে এসেছে। হেলপারের কাছে গাড়ি দিয়ে চায়ের দোকানে এলো। তখনই জেসমিনকে দেখতে পায়। আরেকটু হলেই হাত থেকে চায়ের কাপ খসে পড়ত। মতিনের মুখে কোনো রা নেই। মনের রাজ্যে তখন হাজারো কথা উঁকি দেয়। অনেকদিন পর সুন্দরী নারীর প্রতি নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছে। শুধু মনটাই নাÑ শরীরটাও মরুভূমি হয়ে আছে। রুক্ষ মন ও শরীরটা যদি কয়েক ফেঁাটা বৃষ্টিতে ভিজতে পারে, তাতে ক্ষতি কী? এদিকে নিজের বয়সটা নেহাত কম না যদিও, তবে পুরুষের পঞ্চাশ-একান্ন কোনো বয়স হলো নাকি! তার ওপর শরীরের বাঘটাও মরেনিÑ সময়-অসময়ে মাংস চায়। ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছে। একা মনে হিসাব কষছেÑ প্রেম ও অপ্রেমের!

কিন্তু মতিনকে কোনো সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করতে হয়নি। জেসমিন নাহারই মতিনকে রাজকুমারের আসনে বসিয়ে সামনে দঁাড়িয়েছে। চোখের ইশারায় মতিনকে ডেকে নিয়ে বলে, হেইদিন বাসের মধ্যে তো খুব তরপাইতে আছিলাÑ মেশিনপাতি ঠিক আছে, নাকি খালি চোখ দিয়াই তরপাও? মুহূতের্র জন্য ভ্যাবাচ্যাকা খেল মতিন। জবাব খুঁজে না পেয়ে চুপ মেরে রইল। এবারও মতিনকে উদ্ধার করে জেসমিন বলল, হ বুঝছি, তুমি মিয়া এখন ভাব ধরছ, হগল ব্যাডারাই এমুন হরে। এবার মুখ খুলল মতিন, আপনার কথা তো আমি বুঝতেছি নে।

হেইয়া তোমার বোঝা লাগবে না মনু। মোর লগে লও।

Ñসামনে হঁাটতে হঁাটতে জেসমিন বলল।

তারপর মন্ত্রমুগ্ধের মতো জেসমিনের পাশাপাশি মতিকে হঁাটতে দেখা গেল।

যেতে যেতে মতিনের শরীরে আঙুলের খেঁাচা মেরে জেসমিন বলল, তোমার গাড়ির বডির কন্ডিশন তো বেগতিক। ইঞ্জিনেরও কি কামসারা?

ইঞ্জিন ঠিক আছে, অনেক বছর ধইরে চালাচ্ছি।Ñআঙ্গুল উঁচিয়ে দূরের সাদা-গোলাপী রংয়ের গাড়িটি দেখিয়ে বলে মতিন।

ঠিক আছে, লও যাই দেহি।Ñঠেঁাটে হাসি ধরে জেসমিন বলল।

বাকি পথ দুজনের আর কথা হয় না। বাসস্ট্যান্ড থেকে মিনিট পঁচিশ দূরে জেসমিনের খালাতো বোনের বাড়িতে ওঠে দুজন। মতিন কিছু বলতে চাইলে জেসমিন হাত ইশারায় মুখ বন্ধ রাখতে বলে। বাড়ির লোকজনকে আগে থেকে বলে রেখেছিল কিনা বুঝতে পারছে না মতিন। তাদের সামনে চা-বিস্কুট এল। দরজা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় খালাতো বোনের ঠেঁাটে চোরা হাসি দেখতে পেল মতিন। জেসমিন দরজায় খিল দিয়ে এসে মতিনের শরীর ঘেঁষে বসল। মতিনের শরীর কেমন অসাড় হয়ে গেল। ঘরে অন্য কেউ নেই, বাইরে মানুষের কথা শোনা যাচ্ছে। পথে আসার সময় বেশ উত্তেজনা বোধ করলেও এখন নিজের ভেতর গুটিয়ে যাচ্ছে। না জানি কী বিপদ হয়! চরম একটা বোকামি করে ফেলেছে। বিড়বিড় করে নিজেকেই দোষ দিতে লাগল।

ভয় কেটেছে মতিনের। খাটে বসে ক্রমাগত পা দোলাচ্ছে। মতিনের পা দোলানো জেসমিনের চরম অসহ্য ঠেকল। সে তেঁতিয়ে ওঠে, এই যে হুটকা ড্রাইভার, শরীরের ভ্যঁাড়া এহনো কমে নাই?

জেসমিনের ককর্শ আচরণ মতিনের কাছে অবাক লাগল। উত্তর না দিয়ে খাটের ওপর ম্যানতা মেরে বসে রইল সে। জেসমিন নিজেও বিষয়টি অঁাচ করতে পেরে মতিনের পাশে সরে এল। অনাবৃত বুকের ওপর শাড়ির অঁাচল জড়াতে জড়াতে মতিনের কানের কাছে মুখ এনে আদ্রর্কণ্ঠে বলল, গাড়ি তুমি ভালোই চালাও ড্রাইভার।

বিকেল ৪টায় ফিরতি ট্রিপ নিয়ে যেতে হবে মতিনকে। পকেট হাতরে পঁাচশ টাকার নোট জেসমিনের দিকে কুণ্ঠিত মনে বাড়িয়ে ধরে। তা দেখে জেসমিন খিলখিল করে হেসে ওঠে। আবারও ভড়কাল মতিন।

জেসমিন হাসি থামিয়ে বলে, ড্রাইভার, টাহা তোমার পকেডে রাহো। মতিন মিনমিন করে কিছু বলতে গেল, কিন্তু জেসমিন মতিনের বুক পকেটে ৪টি পঁাচশ টাকার নোট গুঁজে দিতে দিয়ে বলল, মোর টাহা না, দরকার তোমারে।

আপনের টাকা আমি নিতি পারবো না।Ñআমতা আমতা করে মতিন বলল।

পারবা না ক্যান, ড্রাইভার?Ñহাহাকারের মতো শোনাল জেসমিনের কণ্ঠ।

তা কতি পারিনে।

মুই তোমারে টাহা দিয়া কিইন্না লইছি, ড্রাইভার।

না, আমারে টাকা দিয়া কিনতি হবি না।

ক্যা, তোমার দাম কি কম হইছে ড্রাইভার?Ñব্যঙ্গের সুরে বলল জেসমিন।

মতি কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে এল। পেছন থেকে মতিনকে থামিয়ে জেসমিন বলে, ড্রাইভার, তুমি মোরে ভুল বুইঝো না, মোর স্বামী-সংসার ব্যাকই আছে, তয় তোমার লাহান একখান পুরুষ নাই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<12273 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1