শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
জন্মদিনের শুভেচ্ছা

আধুনিক বাংলা কবিতা ও নির্মলেন্দু গুণ

সালাম সালেহ উদদীন
  ০৩ জুলাই ২০২০, ০০:০০

আহসান হাবীবের মতো ভাবগাম্ভীর্য কিংবা শামসুর রাহমানের মতো অতি সরলতা তার না থাকলেও তিনি অনন্য এক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সর্বদা সাদামাটা জীবনযাপনের মাধ্যমে নিজের মধ্যে নির্মাণ করেছেন এক ঐশ্বর্যময় ভুবন। বেশভূষা ও চেহারার আদল অনেকটা রবীন্দ্রনাথের মতো। তিনি ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি নির্মলেন্দু গুণ। আমরা সবাই যাকে গুণদা বলে ডাকি। তার গুণের শেষ নেই। তিনি একাধারে কবি, গদ্যশিল্পী, চিত্রশিল্পী ও অভিনেতাও। তিনি রবীন্দ্রনাথের চরিত্রেও অভিনয় করেছেন।

ষাটের দশকের কবিদের কবিতার একটা উজ্জ্বল দিক হচ্ছে স্বাধীনতাপূর্ব রাজনৈতিক উত্তাল সময়টাকে তারা কবিতায় সফলভাবে তুলে এনেছেন। এর ফলে কবিতার শিল্পমান রক্ষার চেয়ে এক ধরনের স্স্নোগানসর্বস্ব ইমেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কবিতার নান্দনিক দিক উপেক্ষিত হয়েছে অনেকের কবিতায়-ই। নির্মলেন্দু গুণের প্রথম দিকের কাব্যগ্রন্থ যা সত্তর দশকের শুরুতে প্রকাশিত হয়েছে যেমন- প্রেমাংশুর রক্ত চাই, না প্রেমিক না বিপস্নবী, দীর্ঘ জীবন দীর্ঘ রজনী, চৈত্রের ভালোবাসা এবং আশির দশকের শুরুতে অর্থাৎ এরশাদের সামরিক শাসনের সময় প্রকাশিত দূর হ দুঃশাসন। এসব কবিতায় রাজনীতি প্রেম দ্রোহ এবং মানব মনস্তত্ত্ব উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে। রাজনৈতিক কবিতা লিখতে গেলে সব সময় শিল্পগুণ রক্ষা করা যায় না- সময় ও আবেগই সেখানে প্রাধান্য পায়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়ও এ প্রবণতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেবল শামসুর রাহমান। তার আসাদের শার্ট, স্বাধীনতা তুমি, তোমার জন্য হে স্বাধীনতা কিংবা বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় কবিতায় রাজনীতি সমকাল ও শিল্প সমভাবে উঠে এসেছে। রাজনৈতিক কবিতার ক্ষেত্রে প্রবণতার দিক থেকে গুণদা নজরুলের উত্তরসূরি।

যে গুণদাকে নিয়ে লিখছি তাকে কেন্দ্র করে অদ্ভুত এক স্মৃতি রয়েছে আমার। নব্বই দশকের শুরুর দিকের ঘটনা। আধুনিক প্রগতিশীল দৈনিক আজকের কাগজে সবে যোগ দিয়েছি। যোগদানের শুরুর দিকে আজকের কাগজ ও সাপ্তাহিক খবরের কাগজে প্রতি সপ্তায় দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিতাম। সাহিত্যের পাতায়ও প্রতি সপ্তায় একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হতো। আসছে সপ্তায় গুণদার সাক্ষাৎকার নেব বলে স্থির করলাম। গুণদা প্রতি সন্ধ্যায় কাঁটাবনের কবি অসীম সাহার ইত্যাদি প্রিন্টার্সে আড্ডা দিতেন। আড্ডায় আসতেন মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, হাবিবুলস্নাহ সিরাজী, তসলিমা নাসরিন, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুলস্নাহসহ অনেক তরুণ কবি।

এক সন্ধ্যায় কথামতো গুণদার সাক্ষাৎকার নিতে সেখানে যাই। আড্ডার ফাঁকে তাকে বললাম সাক্ষাৎকারের বিষয়টি। তিনি হেসে বললেন, সালাম, আজ থাক। আজ না কাল এভাবে গুণদা আমাকে তিন-চারদিন ঘুরালেন। আমার মেজাজ বিগড়ে গেল।

সাক্ষাৎকার যেদিন আজকের কাগজ সাময়িকীতে প্রকাশিত হলো, সেদিন বিকালে গুণদা রীতিমতো আমার দপ্তরে হাজির। হেসে বললেন, সালাম, কাজটি ভালোই করেছেন। গুণদাকে দেখে আমি কিছুটা আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। ভেবেছিলাম, তিনি সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদের কক্ষে ঢুকে আমার 'অপকীর্তি'র বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে প্রতিবাদ ছাপতে বলবেন। না, গুণদা তা করেননি। একজন কবির সহনশীলতা, উদারতা ও মহানুভবতা আমাকে মুগ্ধ করে। আমি এ পর্যন্ত একশর বেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। 'অন্তরঙ্গ আলোকে' নামে একটি সাক্ষাৎকার গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে ২০০৩ সালে। তবে এ সাক্ষাৎকারটি ছিল ব্যতিক্রম।

আসলে গুণদা আমাকে কোনো সাক্ষাৎকার দেননি। তার 'নির্বাচিতা' বইটি আমার কাছে ছিল। ভূমিকাংশে কবিতা বিষয়ে অনেক কথা ছিল গুণদার নিজস্ব জবানীতে। সেটা পড়ে, প্রশ্ন উত্তর আমি নিজেই তৈরি করি। যা কেবল, গুণদাই বুঝতে পেরেছিলেন। সাক্ষাৎকারটি আসলেই সুন্দর হয়েছিল। অনেক পাঠকই তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন।

\হকোনো লেখকের ওপর ইতিবাচক কথা কেউ লিখলে এবং তাতে রং চড়ালেও ওই লেখক ক্ষিপ্ত হন না। কিন্তু তার বিরুদ্ধে একটি শব্দ লিখলেও তিনি ক্ষেপে যেতে পারেন এবং অধিকাংশ লেখকই ক্ষিপ্ত হন। সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা ও সহনশীলতা আমাদের লেখকদের মধ্যে একেবারেই অনুপস্থিত। সবাই চায় স্তুতি, যত বাড়িয়ে করতে পারেন ততই ভালো। আর এ স্তুতিবাচক সংস্কৃতিই আমাদের সাহিত্যে গড়ে ওঠার চেষ্টা চলছে।

এ দেশের এক বিখ্যাত লেখকের ওপর একটি লেখায় তার বিরুদ্ধে একটি বাক্য থাকায় তিনি তা হলুদ কালিতে দাগিয়ে কাজী শাহেদ আহমেদের কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে ছিলেন। এ ধরনের লেখা কেন ও কী উদ্দেশ্যে ছাপা হলো- তার জন্য আমাকে জবাবদিহি করতে হয়েছিল। একবার শওকত ওসমান এ দেশের আরো একজন লেখকের বাবার বিরুদ্ধে শেখের সম্বরা লেখায়, ওই লেখক তো কাগজে লেকা বন্ধ করে দিলেন। দায় পড়লো আমার ঘাড়ে এসে।

পরিস্থিতিগত ও লেখকের হীন মানসিকতার কারণেই আমাদের দেশে সমালোচনা সাহিত্য গড়ে ওঠেনি। ইদানীং আবার একটি গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। তারা কেবল তাদের নিজস্ব ঘরানার লেখকদের স্তুতি করেন। বলেন তারাই সেরা। এ প্রবণতা সুস্থ ধারার সাহিত্য বিকাশের পরিপন্থি।

গুণদা দেশ ও সাহিত্যের কারণে গোষ্ঠীবদ্ধ হলেও গোষ্ঠীপ্রীতি তার মধ্যে নেই। তার অগোছালো জীবনযাপন হয়তো অনেকের পছন্দ নয়। তবে কবিতার পাশাপাশি তিনি যে গদ্য লিখেছেন, তা অসাধারণ। সাধারণত কবিদের গদ্যে মাত্রাতিরিক্ত আবেগ ও কাব্য-প্রভাব থাকে। এ ক্ষেত্রে কবি আল মাহমুদ, আবুবকর সিদ্দিক ও নির্মলেন্দু গুণ মুক্ত বলে আমার ধারণা।

কবিতার অতি আবেগী প্রভাববলয় থেকে মুক্ত হয়ে গদ্য লেখা সত্যিই কঠিন ব্যাপার। এই অসাধ্য সাধন করেছেন গুণদা। গুণদা বেশকিছু ছবিও এঁকেছেন। তার কয়েকটি ছবি যায়যায়দিনের সাহিত্যের পাতায় ছেপেছিও।

এ দেশে বঙ্গবন্ধু যখন প্রায় নিষিদ্ধ ছিল স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র প্রতিক্রিয়াশীলদের কারণে, তখন গুণদাই বাংলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে পিনপতন নীরবতার মধ্যে বপ্রন্ধুকে নিয়ে কবিতা পাঠ করে অসীম সাহসিকতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ভক্ত গুণদা আজও একই আদর্শে বিশ্বাসী ও আপসহীন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আজও তিনি কবিতা লিখে চলেছেন। আধুনিক বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ তিনি।

গুণদাকে নিয়ে একটা গল্প চালু রয়েছে। তাকে শাহবাগ থেকে একবার পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। সম্ভবত এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়। থানায় নিয়ে গেলে গুণদা নিজের পরিচয় দিলে ওসি সাহেব তা বিশ্বাস করেননি। অবশেষে তাৎক্ষণিক কবিতা লিখে ও আবৃত্তি করে তার কাব্যপ্রতিভার প্রমাণ দিতে হয়েছিল। ২১ জুন ছিল কবি নির্মলেন্দু গুণের ৭৬তম জন্মদিন। এ দিনে তিনি নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মদিন উপলক্ষে তাকে শুভেচ্ছা।

শুনেছি, নিজ এলাকায় তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠাসহ জনহিতকর নানা কাজ করে যাচ্ছেন। প্রায়ই তিনি এলাকায় যান। তার এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। জয়তু কবি নির্মলেন্দু গুণ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<104543 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1