শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
ল্যান্ড সার্ভে মামলার বিচার ও কার্যপদ্ধতি

ফলপ্রসূ কার্যকারিতার জন্য প্রয়োজন আইনি কাঠামোর উন্নয়ন

কথায় আছে, বাংলাদেশের জরিপ অফিস, ভূমি অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সরকারি মানুষ যদি কাজকর্মে সঠিক থাকতেন, তাহলে দেওয়ানি আদালতের হাতে তেমন কাজ থাকত না। ডিসি অফিস, এসিল্যান্ড অফিস, তহশিল অফিস ইত্যাদি জায়গা থেকে জমিসংক্রান্ত বিষয়ে সেবা বা প্রতিকার পেতে মানুষজনকে কী পরিমাণ হয়রানির শিকার হতে হয় তা কেবল ভুক্তভোগীরাই ভালো বলতে পারবেন। ল্যান্ড সার্ভে মামলার বিচার ও কার্যপদ্ধতি নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় পর্ব। লিখেছেন কুমিলস্নার বিজ্ঞ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা, যিনি একসময়ে গোপালগঞ্জের ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
সোহেল রানা
  ১০ মার্চ ২০২০, ০০:০০

অনেক সময় ডিক্রি হওয়া কোনো কোনো মামলায় বিচারকরা এমনতর আদেশও দিচ্ছেন যা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আসলেই সমস্যা বা সিদ্ধান্তহীনতায় পড়তে হচ্ছে। যেমন- 'অত্র মামলাটি ১-৪নং বিবাদীদের বিরুদ্ধে দুই তরফায় এবং অন্যান্য বিবাদীদের বিরুদ্ধে এক তরফায় বিনা খরচায় ডিক্রি হয়। রায়ের মর্মানুসারে নালিশা জমিসংক্রান্ত খতিয়ানে বাদীর নাম অন্তর্ভুক্ত করে খতিয়ানটি সংশোধন করতে জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেয়া হলো'। এরূপ দায়সারা ও অসম্পূর্ণ আদেশ দিলে প্রদত্ত ডিক্রি আসলেই ইনফ্রাকচুয়াস হয়ে থাকবে এবং তা বাস্তবায়ন না-করার কারণে কাউকে দোষারোপও করা যাবে না। কারণ, ওই আদেশটি বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রথমে পুরো রায়টি পড়তে হবে এবং কার কার ভাগ থেকে জমি এনে বাদীকে দিতে হবে সেটির জন্য করতে হবে গবেষণা।

আগেই যেমনটি বলা হয়েছে, ল্যান্ড সার্ভে মামলার ডিক্রিকৃত রায়ের অপারেটিভ পোরশনটি হতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, সুনির্দিষ্ট ও সুচিহ্নিত যাতে তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যান্ত্রিকভাবে কলম চালানো ছাড়া অন্যকোনো বিবেচনা বা চিন্তাভাবনার প্রয়োজন না পড়ে। রায়ে যদি রেকর্ডের কোনো অংশকে (যেমন, খতিয়ানের ৯টি কলামের যে কোনো শব্দ বা সংখ্যা) ভুল মর্মে সাব্যস্ত করা হয় তাহলে সঠিক কোনটি হবে তা-ও বলে দিতে হবে, ফাঁক বা অসম্পূর্ণতা রেখে দেয়া যাবে না কিংবা বাটোয়ারা মামলার মতো অন্যের জন্য কাজ রেখে দেয়া যাবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, খতিয়ানে যদি মালিক হিসেবে নতুন কারও নাম ঢোকানো হয় তাহলে প্রাপ্ত জমির পরিমাণ হিসেবে তার প্রাপ্য হিস্যা কত হবে তা যেমন বলে দিতে হবে, তেমনি তাকে জমি দেয়ার জন্য অন্যান্য মালিকের কার হিস্যা কতটুকু কমবে তা-ও বলা থাকতে হবে। মোটামুটি পাটিগণিতের চর্চা করতে হবে।

বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য উদাহরণ হিসেবে ডিক্রিকৃত একটি রায়ের অপারেটিভ পোরশন উলেস্নখ করছি: আদেশ হলো যে, 'মামলাটি ১-২নং বিবাদীর বিরুদ্ধে দুই তরফায় এবং অন্যান্য বিবাদীদের বিরুদ্ধে এক তরফায় বিনা খরচায় ডিক্রি হলো। এতদ্বারা বাদীকে গোপালগঞ্জ সদর থানাধীন জেএল ১২৬নং রঘুনাথপুর মৌজার বিআরএস ৬৯১ ও ২০৮৫ খতিয়ানভুক্ত ৫০৩২ দাগের ০০.৩৮ একর ভূমির স্বত্বদখলকার এবং খতিয়ান দুটি অশুদ্ধভাবে প্রস্তুত হয়েছে মর্মে ঘোষণা দেয়া হলো। খতিয়ান দুটির শুদ্ধকরণ হিসাবে তাতে নিম্নরূপে সংশোধনী আনতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হলো। নির্দেশনাগুলো হলো- ক). ৬৯১ খতিয়ানের ১-২ কলামে মালিক 'জাহানারা বেগম'র বিদ্যমান হিস্যা ১. (ষোলো আনা) থেকে কমে হবে .৭৬৩ এবং ২য় মালিক হিসাবে বাদীর নাম-পরিচয় অন্তর্ভুক্ত হবে .২৩৭ হিস্যায়; খ). ২০৮৫ খতিয়ানের ১নং কলামে মালিক 'অহিদ সরদার'র জায়গায় বাদীর নাম-পরিচয় স্থলাভিষিক্ত হবে। কার্যার্থে অত্র আদেশের কপি কেন্দ্রীয় রেকর্ড-রুম, সংশ্লিষ্ট সিনিয়র সহকারী জজ, জেলা প্রশাসক, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার নিকট প্রেরণ করা হোক'।

ব্যক্তিসৃষ্ট অন্যায় নয় বরং ভূমির সঙ্গে সম্পর্কিত সরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়মপ্রসূত কৃতকর্মের দায় সামলানোর ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশে যে কয়টি আদালত বা ট্রাইবু্যনাল স্থাপিত হয়েছে, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালগুলো হচ্ছে অন্যতম যার বর্তমান সংখ্যা ৪২টি। দেশের চলমান বা সম্পন্ন হওয়া ভূমি জরিপগুলোর মান ও শুদ্ধতার যে নিম্নগতি, তাতে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনাল স্থাপন করা সময়োপযোগী ও জনবান্ধব সিদ্ধান্ত হলেও এগুলোর ফলপ্রসূ কার্যকারিতার জন্য ভিতর-বাইরের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও অনুষঙ্গ নিশ্চিত না হওয়ায় ট্রাইবু্যনালগুলো বেকায়দায় পড়ে আছে। এসবের বাইরেও, সম্প্রতি আরও একটি খবরে ট্রাইবু্যনালগুলো শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়েই পড়ে কিনা সে আশঙ্কাও প্রবল হয়েছে।

কোনো মৌজায় সর্বশেষ রিভিশনাল জরিপের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত রেকর্ডের (খতিয়ান ও নকশা) শুদ্ধতা যাচাই ও শুদ্ধকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক (যতটি ইচ্ছা) ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনাল ও ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইবু্যনাল স্থাপনের জন্য সেই ২০০৪ সালে আইন করে রাখা হলেও (এসএটি অ্যাক্টের অধ্যায় ১৭এ, ধারা ১৪৫এ. থেকে ১৪৫আই.) প্রথমে শুধু ১টি দিয়ে (ঢাকায়) যাত্রা হওয়ার দীর্ঘদিন পর ২০১২-১৩ সময়ে এসে দুইবারে এগুলোর সংখ্যা ৪২টিতে উন্নীত করা হয়, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ল্যান্ড সার্ভে 'আপিল' ট্রাইবু্যনাল স্থাপন করা হয়নি।

তা ছাড়া বিদ্যমান ৪২টি ট্রাইবু্যনালের অধিকাংশেরই নিজস্ব কোনো জনবল নাই, যে অল্প কয়েকটির আছে তাতেও প্রয়োজনের তুলনায় পদের সংখ্যা হাস্যকরভাবে কম। ট্রাইবু্যনাল স্থাপনসংক্রান্ত আইনে যেমন অনেক করণীয় বা প্রশ্নেরই উত্তর নেই তেমনি আজ পর্যন্ত কোনো বিধিমালাও প্রণয়ন করা হয়নি। এরূপ অবস্থায়ই গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে শো যাচ্ছে, আইন সংশোধন করে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালের বিচারক বানানো হবে সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজদের (যুগ্ম জেলা জজের পরিবর্তে)।

বাংলাদেশে আদালত ব্যবস্থার অগ্রগতির ওপর রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের গতিশীলতার যে নজির, তাতে এটা ধরেই নেয়া যায় যে, প্রণীতব্য বিধানের বলে সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজদের বিচারক করে অতিরিক্ত ট্রাইবু্যনাল কিন্তু গঠন করা হবে না বরং তাদের পদাধিকারবলে (পারিবারিক মামলার মতো) ল্যান্ড সার্ভে মামলা গ্রহণ ও নিষ্পত্তির দায়িত্ব দেয়া হবে! উপরন্তুত্ম এটাও বলে দেয়া যায় যে, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালের বিচারক হিসাবে সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজদের নিযুক্ত করা হলে আপিল কর্তৃপক্ষ করা হবে জেলা জজ বা অতিরিক্ত বা যুগ্ম জেলা জজদেরই, বর্তমান আইনে যেটা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক দিয়ে গঠনের কথা বলা আছে।

ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালগুলোর মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কার পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ কিন্তু এটিই। কারণ, ল্যান্ড সার্ভে মামলার আপিল কর্তৃপক্ষ হিসেবে যদি জেলা পর্যায়েরই অন্যকোনো দেওয়ানি আদালতকে নির্ধারণ করা হয়, তাহলে সেটির জন্যও কিন্তু নতুন কোনো আদালত সৃজন করা হবে না, বিদ্যমানগুলোকেই দেখিয়ে দেয়া হবে। এতে আপিল বা রিভিশন মামলার সংখ্যা বাড়তে থাকবে, কিন্তু অন্যান্য মামলার ভারে নিষ্পত্তি আর এগোবে না। আর সহকারী বা সিনিয়র সহকারী জজদের যদি পদাধিকারবলে ল্যান্ড সার্ভে মামলা গ্রহণ ও নিষ্পত্তির দায়িত্ব দেয়া হয়, তাহলে শুধু আপিল বা রিভিশন নয়, আদি মামলাই হয়ে থাকবে স্তূপিকৃত। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে দেশের প্রতিটি জেলায় বিদ্যমান অর্পিত সম্পতি প্রত্যার্পণসংক্রান্ত আদি ও আপিল ট্রাইবু্যনালে বিদ্যমান মামলার সংখ্যা।

অনেকেই ভাবেন এবং বলেনও যে, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালের বিচারক হিসেবে তেমন অভিজ্ঞ অর্থাৎ যুগ্ম জেলাজজ পর্যায়ের কর্মকর্তা নিয়োগের প্রয়োজন নেই। ভাবনাটি কিন্তু মোটেই বিজ্ঞোচিত নয়। আইনবর্ণিত সময়সীমা পাঁচ বছর হলেও আমাদের দেশে জরিপগুলো সম্পন্ন হতে সময় লেগে যায় প্রায় ২০-২৫ বছর এবং জরিপকার্য হয়েও থাকে অনেক স্তর অতিক্রমের মাধ্যমে। এতগুলো স্তর ও সময়ের বিনিময়ে এবং সরেজমিন কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রস্তুত হওয়া রেকর্ডের ভুল-শুদ্ধ সাব্যস্তের কাজটি কিন্তু আর দশটা সাধারণ মামলার মতো নয়। ল্যান্ড সার্ভে মামলার যে প্রকৃতি এবং তা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বিচার্য-বিষয়ের যে বিস্তৃতি, তাতে সংশ্লিষ্ট বিচারকের বাড়তি যোগ্যতা বা দক্ষতা হিসাবে জরিপ প্রক্রিয়ার নূ্যনতম খুঁটিনাটি যেমন জানা থাকতে হবে, তেমনি সম্পত্তি হস্তান্তরবিষয়ক বিধিবিধানের (ধর্মীয় ও বিধিবদ্ধ) প্রায়োগিক দৃষ্টিও হতে হবে প্রখর।

(আগামী পর্বে সমাপ্ত)

ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনালে যদি বিচারক হিসেবে সহকারী জজদের পদায়ন করা হয়ই, তাহলে মামলার নিষ্পত্তি হয়তো একই ধারায় চলতে থাকবে, কিন্তু বিচারিক মানটা যে সেটেলমেন্টের চেয়ে শুদ্ধতর হবে না তা নিশ্চিতই বলা যায়। বলা বাহুল্য, অনেক সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজরাও কিন্তু অনেক যুগ্ম জেলাজজ কিংবা তার চেয়েও ওপরের পদধারী বিচারকদের চেয়ে ভালো দক্ষতা রাখেন, কিন্তু এটা ব্যতিক্রম এবং ব্যতিক্রমকে উদাহরণ হিসেবে নেয়ার সুযোগ নেই। কর্মসম্পাদন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত ব্যবহারিক জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই।

আইনে প্রত্যেক বিচারিক কর্মকর্তার কমপক্ষে চার মাসের সেটেলমেন্ট প্রশিক্ষণ এবং তা সহকারী জজ পর্যায়েই নিশ্চিতের কথা বলা থাকলেও ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃক সরকারিভাবে প্রদত্ত 'সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট' প্রশিক্ষণের মেয়াদকাল কমতে কমতে বর্তমানে নেমে এসেছে পঁয়তালিস্নশ দিনে এবং তা-ও নানান ফাঁকিঝুঁকিতে ভরা। সরকারি কর্মকর্তাদের জরিপকার্য শেখানোর অন্যকোনো সরকারি ব্যবস্থা বাংলাদেশে চালু নেই, এবং সবেধন নীলমণি হিসেবে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃকচালিত প্রশিক্ষণ কোর্সগুলোতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বিচারিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যে সংখ্যাগত-বৈষম্য দেখানো হচ্ছে, তাতে সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ থাকাবস্থায় তো দূরের কথা, বর্তমানকালে নিয়োগ পাওয়া অনেক বিচারক চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের আগে ওই প্রশিক্ষণে ডাক পাবেন কিনা সন্দেহ। দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি ব্যাচে প্রশাসন, বিচার, পুলিশ ও রেলওয়ে ক্যাডার মিলে প্রশিক্ষণার্থী ডাকা হয় ১০০ জন, এর মধ্যে ৪০ জন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তার বিপরীতে বিচারক থাকেন মাত্র ১০ বা সর্বোচ্চ ১৫ জন। অথচ, সেটেলমেন্টবিষয়ক প্রশিক্ষণ অন্যদের চেয়ে বিচারকদেরই বেশি জরুরি ও প্রয়োজনীয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<91844 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1